জগদ্দল পাথরে গাঁইতির প্রথম আঘাত

বাংলাদেশের মতিন মিয়াকে ঠেকাতে ব্যস্ত ফিলিস্তিন। ছবি: বাফুফে
বাংলাদেশের মতিন মিয়াকে ঠেকাতে ব্যস্ত ফিলিস্তিন। ছবি: বাফুফে
বাহরাইন ও ফিলিস্তিনের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে ১-০ গোলে হেরে এএফসি অনূর্ধ্ব–২৩ বাছাইপর্ব থেকে ছিটকে গেছে বাংলাদেশ। তবে প্রশংসা কুড়িয়েছে তরুণদের লড়াকু পারফরম্যান্স।


দমবন্ধ এক রুদ্ধদ্বার ঘরে আচমকা জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া ঢুকলে যে অনুভূতি হয়, দেশের ফুটবলে যেন ছুঁয়ে গেল তেমনই এক ভালো লাগা। ফুটবলের নেতিবাচক খবরে চারপাশ যখন সয়লাব, তখন এএফসি অনূর্ধ্ব–২৩ বাছাইপর্বে শক্তিশালী বাহরাইন ও ফিলিস্তিনের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ না হওয়া পর্যন্ত শেষ না-মানার লড়াই তো সেই দমকা হাওয়ারই পরশ। টানা দুটি ম্যাচে ১-০ গোলে হারলেও মাসুক মিয়া, জনিদের লড়াকু পারফরম্যান্স নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি।

কেউ ঠোঁট উল্টে বলতেও পারেন, হারের পরেও দেখো আদিখ্যেতা! হ্যাঁ, হার তো হারই! তবে কখনো কখনো হারের মধ্যেও থাকে বীরত্ব। পরাজয়ের মধ্যেও থাকে লড়াইয়ের উচ্ছ্বাস। কখনো কখনো ফুটবল মাঠে এমন দিনও আসে, সবাই মানতে বাধ্য হয়, পরাজয় আসলে শেষ বিচারে পরাজয়ও নয়।

দেশের ফুটবল নিয়ে একের পর এক মন খারাপ করে দেওয়া খবরের ছাইগাদায় বসে কাল ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ম্যাচটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বোধ হয় আবেগ তাড়িতই। প্রতিপক্ষের মান ও খেলার বিচারে ন্যূনতম ব্যবধানে হেরে যাওয়াটাই তো বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য অভাবিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের হোমপেজেও ফুটে উঠছে সেই পূর্বাভাস। দেশের ফুটবল নিয়ে নাক সিটকানো মানুষটাও প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন জনিদের।

র‍্যাঙ্কিংয়ে ৮১ ধাপ এগিয়ে থাকা স্বাগতিক বাহরাইন ও ১০০ ধাপ এগিয়ে থাকা ফিলিস্তিনকে টপকে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেবে বাংলাদেশ, দেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপটে অলৌকিক স্বপ্ন মনে হতে পারে। কিন্তু আনিসুর রহমান জিকু, বিশ্বনাথ ঘোষরা দেখিয়ে দিয়েছেন, কেন স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছিলেন জেমি ডে। স্বপ্ন পূরণ হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তবে ধাক্কা তো দেওয়া গেছে। না, এই ধাক্কা শুধু অনেক দূরে এগিয়ে থাকা দুই প্রতিপক্ষকে নয়; নিজেদের ফুটবল নিয়ে হতাশায় নিস্তেজ হয়ে পড়া মনটাকেও!

বাংলাদেশের ফুটবলাররা দৌড়াতেই পারেন না। খেলবে কী! দেশের ফুটবলের গল্প উঠলেই কথাটি তাচ্ছিল্যের সুরে ব্যবহৃত হয়। এর বিরোধিতা করার সুযোগও নেই। তবে এই তরুণ ফুটবলাররা এবার কথাটির প্রতিবাদ করতেই পারেন। এশিয়ান গেমসের পর এএফসি বাছাইপর্বে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, ‘কিছু ব্যতিক্রমও আছে।’ কাতার ও থাইল্যান্ডের মতো দলকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে গেছেন তাঁরা। আর এবার বাহরাইনে দেখাল বাংলার তারুণ্যের ঝলক। এতেই তো বোঝা যায়, এই তরুণেরা ব্যতিক্রম।

এই ব্যতিক্রম দল হয়ে ওঠার রহস্য উন্মোচন এককথায় করতে গেলে উত্তর ফিটনেসের উন্নতি। দলটা খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে পারে একই ছন্দে। এর ফলে বিদায়ের আগ পর্যন্ত হার মানব না, এ দৃঢ় মানসিকতাটা ফুটে ওঠে শরীরী ভাষায়। শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত ম্যাচের প্রতিটি মুভে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। কীভাবে সম্ভব?

ফুটবলে ‘ফোর এস’ বলে একটা মৌলিক বিষয় আছে—স্পিড (গতি), স্ট্রেংথ (শক্তি) ও স্ট্যামিনা (দম) ও স্কিল ( দক্ষতা)। বাংলাদেশের ফুটবলারদের স্কিল নিয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন না থাকলেও শেষের তিনটি ‘থ্রি এস’–এ ছিল যত গন্ডগোলের মূল। ফুটবলের ব্যর্থতায় বারবার উঠে এসেছে এই শেষ তিন থ্রি এসের অভাব। কিন্তু জেমি ডের শিষ্যরা এ জায়গায় উন্নতি করেছে বলেই শেষ ৯০ মিনিট পর্যন্ত একই ছন্দে খেলতে পারে।

প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়া ফিলিস্তিনের সামনে বাংলাদেশ উড়ে যাবে বলেই হয়তো ভেবেছিল অনেকে। কিন্তু প্রথমার্ধের ২২ মিনিটে গোল হজমের পর শেষ পর্যন্ত সমতায় ফেরার লড়াই করে গেছেন তরুণেরা। ছোট একটা পরিসংখ্যান দিয়েই প্রমাণ করা যাক। প্রথমার্ধে ফিলিস্তিনের ৭৪ ভাগ বলের দখলের বিপরীতে ২৬ ভাগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষের ৩৭ ভাগের বিপরীতে বাংলাদেশের ৬৭ ভাগ। স্বাভাবিকভাবে গতি, শক্তি ও দম বাড়াতেই দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ এভাবে খেলতে পেরেছে।

দুটি ম্যাচের ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়, তা দেশের যেকোনো ফুটবলপ্রেমীকে আশা দেখাবে নিশ্চিত। অনেক এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে রক্ষণ সামলানোর সময় কতটা ওয়ার্ক লোড নিতে পারে যুবারা, তা এশিয়ান বাছাইপর্বের দুটি ম্যাচেও ফুটে উঠেছে। হাসিমুখে দাঁতে দাঁত চেপেও যে রক্ষণ সামলানো যায়, তা দেখিয়েছেন বিশ্বনাথ-বাদশা-সুশান্তরা। ডি-বক্সের সামনে বিপজ্জনক মিডল করিডরে প্রতিপক্ষকে কোনো জায়গা না দেওয়া, সাপোর্টিং পাসগুলো বন্ধ করা এবং ধাঁধায় পড়েও নিজেরা জমাট থাকা। রক্ষণ চরিত্রের প্রধান তিনটি বিষয়ে বাংলার রক্ষণভাগ পাবে লেটার মার্কস। এ ছাড়া প্রতিটি ম্যাচেই যুবাদের দেখা গিয়েছে এক সুতোয় গাঁথা। নিচ থেকে বিল্ডআপ খেলে একসঙ্গে ওপরে ওঠা, আবার বল হারালেই মৌমাছির চাকের মতো দ্রুত প্রেসিং।

বাহরাইনের ডিফেন্ডারদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন ইব্রাহিম। ছবি: বাফুফে
বাহরাইনের ডিফেন্ডারদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন ইব্রাহিম। ছবি: বাফুফে

যে ফিটনেসের কারণে আগে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ, তা-ই এখন উন্নতির কারণ। আর এটা সম্ভব হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক খাদ্যাভ্যাসে। বর্তমানে কঠোর নিয়মে বাঁধা ফুটবলারদের খাবার তালিকা। কোচ ও ট্রেনার মিলিয়ে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে দিয়েছেন, এর বাইরে গিয়ে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চিনি, জাঙ্ক ফুড, কোমল পানীয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবারেরও কোনো সুযোগ নেই। ভাত খাওয়ার সুযোগ আছে, এক বেলা, তা-ও পরিমাণে খুবই অল্প। বোঝাই যাচ্ছে, সবকিছুতেই একটা বদলের আভাস।

আপাত এই বদলে ফুটবল মানচিত্রে বাংলাদেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি, হয়তো বদলাবে না দীর্ঘদিনের অচলায়তনও। কিন্তু যেকোনো জগদ্দল পাথরকে সরাতে হলে গাঁইতির প্রথম আঘাতটা তো দেওয়া চাই। শাবল দিয়ে একটা হ্যাঁচকা টানও তো দিতে হয়। সেই প্রথমটা হয়ে থাকুক এবারের এই এএফসি অনূর্ধ্ব–২৩ বাছাই!