বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই মৃত্যুহীন প্রাণ

>শহীদ জুয়েল আর শহীদ মুশতাক এভাবেই জড়িয়ে আছেন একে অন্যের সঙ্গে, জীবন-মৃত্যু বা ক্রিকেটে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েছে এই দুই মৃত্যুহীন প্রাণের নামে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের দুটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করে। শহীদ জুয়েল একাদশ বনাম শহীদ মুশতাক একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয় প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে
শহীদ জুয়েল, শহীদ মুশতাক
শহীদ জুয়েল, শহীদ মুশতাক

২৭ মার্চ ১৯৭১। সেই বিভীষিকাময় কালরাতের পর একটা দিন পেরিয়ে গেছে, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বেরিয়েছেন বন্ধু সৈয়দ আশরাফুল হককে নিয়ে। দুই ক্রিকেটার বেরিয়েছেন আরেক আপনজনকে দেখতে। বলা ভালো, লাশ দেখতে। লাশের নাম মুশতাক—আজাদ বয়েজের মুশতাক। হ্যাঁ, এই আজাদ বয়েজ ছাড়া এ দেশে মুশতাকের আর কোনো পরিচয় ছিল না কোনো দিন।

যা হোক, পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে মুশতাকের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহটা দেখে বুক ভেঙে কান্না আসছিল জুয়েলদের। জুয়েলকে ক্রিকেটে নিয়ে আসা এমন এক আপনজনকে এভাবে নিথর পড়ে থাকতে দেখে হয়তো জুয়েলের হৃদয়ে আগুন জ্বলছিল দাউ দাউ করে। ২৫ মার্চ গণহত্যায় হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর একের পর এক জমে ওঠা লাশের পাহাড় তো ছিলই চারপাশে। হয়তো মুশতাকের প্রাণহীন শরীরটা নিঃশব্দ আকুতি জানাচ্ছিল জুয়েলকে, এ দেশের নিরস্ত্র সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর নির্মম গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করতে।

জুয়েল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, ২ নম্বর সেক্টরের অধীন দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের অংশ হয়ে লড়েছিলেন ঢাকার গেরিলা যুদ্ধে। ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত হামলায় আহত অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন জুয়েল। আর ফিরে আসেননি। স্বাধীন বাংলাদেশ আজও তাঁকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবয়বহীন প্রথম ট্রফিটাও সম্ভবত শহীদ জুয়েলই, গর্বে মাথা উঁচু করে রাখার অনুপ্রেরণা। স্মরণ করা হয় মুশতাককেও। হয়তো জুয়েলের মতো এত বিখ্যাত কেউ নন, তবু তাঁকে ভোলার সুযোগ কোথায়? শহীদ জুয়েলের মতো অসংখ্য তরুণের ক্রিকেটার হয়ে ওঠা কিংবা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি জড়িয়ে আছেন এ দেশের ইতিহাসে।
শহীদ মুশতাক নিজে ক্রিকেট খেলতেন না, প্রাণান্ত ছুটতেন আজাদ বয়েজ ক্লাবের জন্য। ক্রিকেটার খুঁজে বেড়াতেন, তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে এ দুয়ার থেকে ও দুয়ারে ছুটে বেড়াতেও তাঁর ক্লান্তি ছিল না। জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন আজাদ বয়েজের নেপথ্যে থেকে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ভারত থেকে এসেছিলেন ঢাকায়। পরিবার-পরিজনের খোঁজ কেউই জানত না। ক্লাবটাই ছিল তাঁর সংসার আর ক্লাবের ক্রিকেটাররাই পরমাত্মীয়। পল্টন ময়দান-সংলগ্ন গুলিস্তান সিনেমা হলের উল্টো দিকের আজাদ বয়েজ ক্লাবেই থাকতেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে সেই ক্লাবসংলগ্ন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে পাকিস্তানিরা হত্যা করে মুশতাককে।

৪৮ বছর পর আরেক ২৫ মার্চে মুশতাককে স্মরণ করতে গিয়ে বর্ষীয়ান ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘মুশতাকের শিকড়ের খবর কেউ জানত না। তাঁর আত্মীয়স্বজন ছিল কি না, তা-ও না। মুশতাকের জীবন বা সংসার যা-ই বলি, সবই ছিল আজাদ বয়েজ ক্লাব। ক্রিকেটারের খোঁজে তিনি ঘুরে বেড়াতেন সব সময়। ক্রিকেটার খুঁজে এনে তাঁদের খেলানো, প্রয়োজনীয় খোঁজখবর রাখা, এসব করেই জীবনটা কাটিয়েছেন তিনি।’
শহীদ মুশতাকের খুঁজে আনা বহু ক্রিকেটারের একজন তো শহীদ জুয়েল, আরেকজন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান। মুশতাকের কথা বলতেই যিনি ফিরে গেলেন বহু বছর আগে, সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের দিনগুলোয়। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রকিবুল খেলতে এসেছিলেন তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামের বাইরের মাঠে, এখন যেখানে হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম। সেখানেই শহীদ মুশতাকের চোখে পড়েন, ‘আজ এত দিন পরে এসেও আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই, মুশতাক ছিলেন আমার ক্রিকেটের গডফাদার। শুধু আমি নই, আমার মতো আরও অনেকে ক্রিকেটার হয়েছিল মুশতাকের কারণে। সেদিন আমি সম্ভবত ৪৮ রান করেছিলাম ইয়ং লায়ন্স নামের দলের বিপক্ষে। ওই দলে পূর্ব পাকিস্তান দলের সব ক্রিকেটার খেলতেন। তো আমার খেলা দেখে মুশতাক আমাকে আজাদ বয়েজের অনুশীলনে আসতে বলেন। তারপর থেকে শুরু হলো আমার নতুন পথচলা। সেন্ট গ্রেগরি থেকে সদরঘাট, সেখান থেকে আজাদ বয়েজের নেট। আমাকে ও জুয়েলকে তিনি বাবু বলে ডাকতেন।’

শহীদ জুয়েল আর শহীদ মুশতাক এভাবেই জড়িয়ে আছেন একে অন্যের সঙ্গে, জীবন-মৃত্যু বা ক্রিকেটে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েছে এই দুই মৃত্যুহীন প্রাণের নামে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের দুটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করে। শহীদ জুয়েল একাদশ বনাম শহীদ মুশতাক একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয় প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে।
যখন মিরপুর স্টেডিয়ামে গর্বে ওড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, অন্য কোনো ভুবন থেকে হয়তো তৃপ্তির হাসি হাসেন শহীদ জুয়েল ও শহীদ মুশতাক।