টিকতে পারবেন তো জিদান?

জিদানের সামনে এখন বিশাল পরীক্ষা। ছবি: এএফপি
জিদানের সামনে এখন বিশাল পরীক্ষা। ছবি: এএফপি

জিনেদিন জিদানের সামনে একটি করে দিন কমছে। একটি করে ম্যাচ যাচ্ছে আর ঝালিয়ে নিচ্ছেন তারকাদের। আগামী মৌসুমের জন্য রিয়াল মাদ্রিদকে প্রস্তুত করছেন একটু একটু করে। কিন্তু তাঁর দল সে সুযোগ দিলে তো? মৌসুমে কম সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়দের ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ যেখানে, সেখানে ভ্যালেন্সিয়ার কাছে হেরে বসেছে রিয়াল মাদ্রিদ। জিনেদিন জিদানের কপালে চিন্তার বলিরেখা তৈরি করছেন খেলোয়াড়েরা। দ্বিতীয়বারের মতো রিয়ালের ডাগ-আউটে ফেরত আসা জিদানকে লড়তে হবে অনেক কিছুর সঙ্গেই।

জিনেদিন জিদানের হঠাৎ চলে যাওয়া, আবার হঠাৎ ফিরে আসা ফুটবল দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। দুই মৌসুম আগেই ইয়ুপ হেইঙ্কেস ফেরত এসেছিলেন বায়ার্ন কোচ হিসেবে। জিদান নিজের ছোট্ট ক্যারিয়ারে অভিজ্ঞ হেইঙ্কেসকেও হারের স্বাদ দিয়েছেন। এসি মিলানে আরিগো সাচ্চি, বার্সেলোনায় লুই ফন গালও একবার হাল ছেড়ে দিয়ে আবার ধরেছিলেন। তবে দুজন এর মাঝে অন্য দল ঘুরে এসেছিলেন। জিদান তা করেননি। রিয়াল কোচের দায়িত্ব ছেড়ে ফিরেছেন সেই একই ক্লাবে, একই দায়িত্বে।

জিদানের জন্য অশনিসংকেত এই সাবেকরাই। আরিগো সাচ্চি ইতালির জন্য মিলানের চাকরি ছাড়ার আগে জিতেছিলেন সম্ভাব্য সবকিছুই। টানা দুই ইউরোপিয়ান কাপ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ, সিরি আ। কিন্তু পাঁচ বছর পর মিলানে ফিরে টিকতে পারলেন মাত্র ৭ মাস। বাজে পারফরমেন্সের কারণে নিজেই সরে দাঁড়ালেন কোচের পদ থেকে। বার্সেলোনাকে টানা দুই লিগ জেতানো লুই ফন গালও বার্সায় ফিরে কিছুই দিতে পারেননি। বরং ৬ মাস পর দলকে ১২তম অবস্থানে রেখেই বিদায় নেন ফন গাল।

রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে জিদান সব সময়ই বিশেষ কিছু। রেকর্ড মূল্যে জুভেন্টাস থেকে রিয়ালে যোগ দিয়ে জিদান অবসর নিয়েছিলেন রিয়ালেই। পেরেজের সময়ে রিয়াল থেকে অবসর নেওয়া বড় খেলোয়াড় একমাত্র জিদানই। এরপর মরিনহোর সহযোগী, তারপর কাস্তিয়ার কোচ, শেষ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদ মূল দলের কোচ। ধাপে ধাপে যেখানেই প্রয়োজন পড়েছে, সেখানেই জিদানকে টেনে এনেছেন পেরেজ। কিন্তু মাঝপথে পেরেজকে খালি করে চলে যাওয়া জিদান বেশি দিন দূরে থাকতে পারেননি। আট মাসের মাথায় আবারও পেরেজের ডাকে সাড়া দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু প্রথমবারের চেয়ে এবার মানে দ্বিতীয় দফায় সাফল্য পাওয়া জিদানের জন্য বেশি কঠিন।

জিদান কি পারবেন তার প্রিয় খেলোয়াড়দের বিদায় বলতে? ছবি: সংগৃহীত
জিদান কি পারবেন তার প্রিয় খেলোয়াড়দের বিদায় বলতে? ছবি: সংগৃহীত

জিদানের সামনে গতবার ছিল শুধু শিরোপা এনে দেওয়ার ক্ষুধা। কিন্তু এই রিয়াল মাদ্রিদের শুধু শিরোপা হলেই হবে না। এই রিয়াল মাদ্রিদের শিরোপার সঙ্গে দরকার ভবিষ্যৎও পুনর্গঠন করা। সমস্যা এখানেই। দল পুনর্গঠন একটা লম্বা কাজ। তার ওপর দলটার নাম যদি হয় রিয়াল মাদ্রিদ। পুনর্গঠনের ফল হিসেবে শিরোপা ছাড়াই কয়েক মৌসুম কাটাতে হয় দলকে। কিন্তু তা মেনে নেওয়ার মতো অবস্থা আছে কি সমর্থকদের? জিদান রিয়ালের সোনার ডিম পাড়া হাঁস, যার কাছ থেকে প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম পাওয়া অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার। কিন্তু সেই জিদান যখন ম্যাচের পর ম্যাচ হেরে আসবেন বা মৌসুম শেষে শিরোপার দেখা পাবেন না, তখন তা সহ্য করতে পারবেন সমর্থকেরা?

শুধু সমর্থকের কথা বলতে হচ্ছে, কারণ ২০২১ সাল পর্যন্ত সভাপতি পদটা আগলে আছেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। জিদানকে ভালোভাবেই বুঝতে পারেন এই স্প্যানিশ। তাঁর পরামর্শেই প্রতি মৌসুমে তারকা না কিনে তরুণ খেলোয়াড়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছে রিয়াল। তাই শিরোপা না পেলেও তাঁর ওপর আস্থা রাখবেন পেরেজ। কিন্তু ২০২১ পর্যন্ত যথেষ্ট সাফল্য না পেলে পেরেজও নিজের গদি ঠিক রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। যে কারণে জিদান ও পেরেজ দুই পক্ষের জন্যই কাজটা কঠিন।

জিদানের জন্য কঠিন কাজ এই পুনর্গঠনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়ে যাঁরা তুরুপের তাস হয়েছিলেন, তাঁদের কি দল থেকে বিদায় করতে পারবেন জিদান? সাচ্চি কিংবা ফল গালের ক্ষেত্রেও এই কাজ হয়েছিল। ফিরে এসে পুরোনো সেনানীদের ওপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরাও। ফল ভালো হয়নি। কারণ বয়সের ভারে আগের খেলা আর থাকে না। দুই বছর আগের মার্সেলোর সেই গতি এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। আগে নিয়মিত রক্ষণ থেকে আক্রমণে ওঠানামা করা মার্সেলো এখন উঠলে বাম পাশ থাকে অরক্ষিত। একই কথা মদরিচ, ক্রুসের ক্ষেত্রেও। বয়সের ছাপ আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করেছে খেলাতেও। ফলে দল থেকে না হলেও অন্তত প্রথম একাদশে তাঁদের নিয়মিত রাখা যাবে না।

স্যার অ্যালেক্স হওয়া অনেক দূরের পথ জিদানের জন্য। ছবি: টুইটার
স্যার অ্যালেক্স হওয়া অনেক দূরের পথ জিদানের জন্য। ছবি: টুইটার

জাতীয় দলের কথা বিবেচনা করলে একই কথা বলা যায় মার্সেলো লিপ্পির ক্ষেত্রেও। ২০০৬ সালে লিপ্পি যাঁদের নিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন, ২০১০ বিশ্বকাপে অন্ধের মতো তাঁদের ওপরেই ভরসা রাখতে গিয়ে ভুল করেছিলেন তিনি। যার মাশুল দিতে হয়েছিল ইতালিকে, ২০১০ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে। প্রতিভাবান তরুণদের সুযোগ না দিয়ে ঘুরেফিরে বুড়োদের নিয়ে দল গড়েছিলেন তিনি।

জিদানের মূল পরীক্ষাটা এখানেই। তবে মার্সেলো, ভারানেকে বেঞ্চে বসিয়ে নিয়মিত রেগুলিয়ন কিংবা ভায়েহোকে খেলানো এত সহজ নয়। ১০ বছর ধরে স্ট্রাইকিং পজিশন আগলে থাকা বেনজেমাকে বেঞ্চে বসানোও সহজ নয়। তাও আবার ইনফর্ম বেনজেমা! জিদান যত সহজভাবে এই কাজ করতে পারবেন, রিয়ালও তত সহজে জিততে শুরু করবে।

নিজের হাতে গড়া তারকাকে ছুঁড়ে ফেলার স্বভাবটা খুব ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কোচ হিসেবে তাই তাঁর নামটা প্রথমে আসে। প্রায় চার প্রজন্ম সামলানো স্যার অ্যালেক্স যখন দায়িত্ব ছাড়লেন, তখন তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অন্য নাম। রিয়াল সমর্থকেরা জিদানকে সে রকমই একজনই ভাবেন। স্যার অ্যালেক্সের মতো খারাপ খেললেই তাঁকে দলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, জিদানের পরিণতি হবে আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো। আর্সেন আর্সেনালের সমার্থক হয়েছেন বটে, কিন্তু ক্লাব ছেড়েছিলেন চোখের বালি হয়ে। তাই সময়ই বলে দেবে জিদান কোনটি হবেন, স্যার অ্যালেক্স না আর্সেন?