রিয়ালের ত্রাতা হয়েও যাঁকে 'রক্তাক্ত' হতে হয়

>গত এক দশকের সবচেয়ে বাজে মৌসুম কাটাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চলে যাওয়ার পর তাঁর শূন্যস্থান পূরণে সেরাটা দিয়েও সমর্থকদের চোখের মণি হতে পারেননি করিম বেনজেমা।
ত্রাতা বেনজেমা। ছবি: এএফপি
ত্রাতা বেনজেমা। ছবি: এএফপি

করিম বেনজেমা প্রসঙ্গে একটি কথা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। বেনজেমা হলেন একজন ‘নম্বর টেন’, যাঁর গায়ে ‘নম্বর নাইন’ জার্সি চাপানো হয়েছে। নামে স্ট্রাইকার হলেও দায়িত্বটা থাকে সঙ্গীদের দিয়ে গোল করানোয়। বক্সে ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে আক্রমণে অংশ নেওয়া আর আক্রমণ সৃষ্টিতেই তাঁর বেশি মনোযোগ। রোনালদো থাকা পর্যন্ত প্রথাগত স্ট্রাইকার হিসেবে তাঁকে দলে চাননি কোনো কোচই।

রিয়াল মাদ্রিদে গত নয় মৌসুমেই রোনালদোর ছায়াসঙ্গী হয়ে খেলেছেন। যদিও রিয়ালে তাঁর আগমন হয়েছিল মূল স্ট্রাইকার হিসেবে। দুই মৌসুমের মধ্যেই দলে তাঁর ভূমিকা পাল্টে যায় আপাদমস্তক। লিঁওর পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার হয়ে উঠলেন রোনালদোর পাশে থাকা ‘ছায়া স্ট্রাইকার’। আক্রমণভাগ আরও শক্তিশালী করতে টটেনহাম থেকে আনা হয় গ্যারেথ বেলকে। ১০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে আনা বেল, ক্রিস্টিয়ানো আর বেনজেমাকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘বিবিসি’। সেই ‘ত্রিফলা’ আক্রমণভাগেও আড়ালের তারকা হয়ে ছিলেন বেনজেমা।

কিন্তু রোনালদো মাদ্রিদ ছাড়ার পর গ্যারেথ বেল নয়, বরং রিয়ালের আক্রমণের সব দায়িত্ব এসে পড়ে বেনজেমার কাঁধে। যে দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল, প্রস্তুত করা হয়েছিল অন্য আরেকজনকে, সেখানে সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় এই ফ্রেঞ্চকে। হঠাৎ এই গুরুদায়িত্ব পেয়ে ভড়কে যাওয়া দূরের কথা, বরং নতুন দায়িত্বে কোচের ভরসার পাত্র হয়ে উঠছেন বেনজেমা।

হাতের চোট নিয়েই তিন মাস ধরে খেলছেন বেনজেমা। ছবি: এএফপি
হাতের চোট নিয়েই তিন মাস ধরে খেলছেন বেনজেমা। ছবি: এএফপি

সেই ভরসা পাত্রই এই মৌসুমে রিয়ালের সবচেয়ে বড় ত্রাতা। দলের প্রয়োজনে অন্যদের তুলনায় বেনজেমাই বেশি ভূমিকা রেখেছেন। এই মৌসুমে মোট ৩৬ গোলে তাঁর সরাসরি অবদান। ২৬ গোলের পাশাপাশি রয়েছে ১০ ‘অ্যাসিস্ট’। এর মধ্যে লিগে ১৭ গোল ও ৬ অ্যাসিস্ট। চ্যাম্পিয়নস লিগে বাদ পড়ার আগে ৪ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট নিয়ে দলের সেরা তারকা ছিলেন এই বেনজেমাই। ঝলক দেখিয়েছেন কোপা ডেল রেতেও (৪ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট)। কিন্তু বাজে রক্ষণ আর অন্যদের আশানুরূপ সহযোগিতা না পাওয়ায় রিয়ালের মৌসুম শেষ হয়েছে আগেভাগেই। চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়াক্সের মাটিতে বেনজেমা দুটি মূল্যবান ‘অ্যাওয়ে গোল’-এ অবদান রাখলেও রিয়াল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারেনি।

প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের পাশাপাশি এই মৌসুমে বেনজেমার আরেক ‘শত্রু’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল চোট। মোট তিনবার চোটে পড়েছেন। প্রথম দুবার কোনো বিরতি ছাড়াই মাঠে ফিরলেও তৃতীয় চোট ভোগাচ্ছে অনেক দিন ধরে। বেটিসের সঙ্গে চোট পেয়েছিলেন আঙুলে। চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু দল–অন্তঃপ্রাণ বেনজেমা সামনে মৌসুমের অর্ধেকের বেশি বাকি থাকায় অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। কারণ, ওই অস্ত্রোপচার তাঁকে মাঠের বাইরে রাখত প্রায় দুই মাস। এক ম্যাচ বিশ্রাম নিয়ে আঙুল ব্যান্ডেজ করে নেমে পড়েছিলেন মাঠে। প্রায় তিন মাস ধরে নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন চোট নিয়েই।

চোটে পড়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৮ ম্যাচ খেলেছেন বেনজেমা। এই ১৮ ম্যাচের সব কটি ম্যাচেই প্রথম একাদশে ছিলেন তিনি। এমনকি এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের ৫০ ম্যাচের মধ্যে ৪৮ ম্যাচেই প্রথম একাদশে ছিলেন বেনজেমা। মাত্র একটি ম্যাচে শুরু করেছেন বেঞ্চ থেকে। আর আঙুলের চোট নিয়ে এই ১৮ ম্যাচে করেছেন ১৪ গোল ও ৪ অ্যাসিস্ট। এমনকি রিয়ালের শেষ ৫ গোলের মধ্যে ৪টি বেনজেমার, বাকি ১টি গোল বানিয়ে দেওয়ার কাজটুকুও করেছেন এই বেনজেমাই।

খেলা তৈরি থেকে গোল করা—সব দায়িত্বই যেন বেনজেমার। ছবি: এএফপি
খেলা তৈরি থেকে গোল করা—সব দায়িত্বই যেন বেনজেমার। ছবি: এএফপি

বেনজেমা এই মৌসুমে গোল করে ও করিয়ে রিয়ালকে এনে দিয়েছেন মোট ২৪ পয়েন্ট। ইউরোপে একমাত্র লিওনেল মেসি তাঁর চেয়ে বেশি পয়েন্ট এনে দিয়েছেন দলকে। মৌসুমে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগও পাননি এই ফরাসি। ইউরোপের বড় দলগুলোর মধ্যে একমাত্র রিয়াল মাদ্রিদই আক্রমণভাগে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার ছাড়া খেলে যাচ্ছে। যে কারণে মৌসুমের প্রায় ৯০ ভাগ সময়েই মাঠে দেখা যাচ্ছে বেনজেমাকে, যা এই মৌসুমে খেলা স্ট্রাইকারদের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ গোলদাতা বেনজেমার গোল আরও বাড়তে পারত। যদি পেনাল্টির দায়িত্বটা সার্জিও রামোস নিজে বুঝে না নিতেন। তবু মৌসুমে গোলের সংখ্যায় রোনালদো, কেইন, সুয়ারেজ, সালাহ তাঁর পেছনে। নিষ্প্রভ বেল, ভাসকেজ আর তরুণ ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে বেনজেমা যতটুকু লড়াই করেছিলেন, তাও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে দলের রক্ষণের ভুলে। জিনেদিন জিদান তো শুধু শুধু বলেননি, ‘বেনজেমা সব সময় দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। করিম অসাধারণ মৌসুম পার করছে এবং গোল করছে। এতে ওকে নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, কিন্তু সে সব সময়ই দলের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’

জিদানের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, প্রায় প্রতি মৌসুমে নতুন নতুন স্ট্রাইকার নিয়ে গুঞ্জন সৃষ্টি হলেও কেন বেনজেমাই শেষ পর্যন্ত আক্রমণভাগের সামনে থাকেন। অথচ একটা বাজে ম্যাচ খেললে এই বেনজেমাই রিয়াল–সমর্থকদের চক্ষুশূল! অনেক সময় তো ম্যাচ বাঁচালেও রক্ষা মেলে না! রিয়ালের মৌসুম থেকে বেনজেমার গোলগুলো মুছে ফেলুন—সঙ্গে সঙ্গে লিগে রিয়াল তিন থেকে তেরোতে চলে যায়! অনেকটা ‘ব্যাটম্যান’-এর মতো। বারবার গোথামকে রক্ষা করেও সব দায় সেই ব্যাটম্যানেরই। তেমনই বেনজেমা রিয়ালের জন্য নিজেকে দিলেও পান থেকে চুন খসলেই চোখের বালি!