ব্রাজিলে কেন 'ব্রাজিল' নেই, উত্তর খুঁজছেন তিতে

ব্রাজিল কোচ তিতে। ছবি: টুইটার
ব্রাজিল কোচ তিতে। ছবি: টুইটার

তারকারও অভাব হয়নি কখনো। এক প্রজন্ম যাচ্ছে তো আরেক প্রজন্ম উঠে আসছে। কিন্তু সেই হলুদ জার্সির দ্যুতি যেমন হারিয়েছে, তেমনি উবে গেছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের আসল রূপ-রস-গন্ধ। একসময় সাম্বা ছন্দে নাচন উঠত সমর্থকদের রক্তে; ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীরা আজও সেই নাচনের অপেক্ষায়। কত দিন হয়ে গেল, কত তারকা এল-গেল! এখনকার ঘরও বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, নেইমার-কুতিনহোরা আছেন, ভিনিসিয়ুসের মতো প্রতিভারা ঘর আলো করছেন। কিন্তু ব্রাজিলের খেলায় সেই ব্রাজিলীয় সৌরভ কেন জানি আর দেখা যায় না।

ব্রাজিলের কোচ তিতের কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে। তরুণ প্রতিভারা পরিণত হয়ে ওঠার আগেই পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে। এতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ধাঁচটা ঠিক পুরোপুরি রপ্ত হচ্ছে না। ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলও দুর্বল হচ্ছে। যার আসল খেসারত দিতে হচ্ছে ব্রাজিলকে। এত প্রতিভা থাকারও পরও ব্রাজিল বড় প্রতিযোগিতায় গিয়ে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আয়োজিত এক সম্মেলনে হার্ভার্ড ও এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) ছাত্রদের ব্রাজিল কোচ বলেছেন, ‘(বিশ্বকাপ না জেতার) অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের ঘরোয়া লিগগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। অর্থনৈতিকভাবে এমন কিছু করা প্রয়োজন যেন আমাদের সেরা ফুটবলাররা ব্রাজিলে থেকে যায়।’

তিতে অবশ্য এ কথাও বলেছেন, ঘরোয়া লিগে পারিশ্রমিক ও খেলার মান বাড়ালেই সমস্যার সমাধান হবে না। ব্রাজিলের শীর্ষ লিগের সমস্যাগুলো বের করতে প্রয়োজন গবেষণা এবং অনুসন্ধান। বের করে আনতে হবে ইউরোপের শীর্ষ লিগের সঙ্গে ব্রাজিলের শীর্ষ লিগের পার্থক্যের কারণ কী? যুব ফুটবল কাঠামোতেই বা পার্থক্য কেমন।

ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবল লিগ দুর্বল হয়ে পড়ার আলোচনাটা অবশ্য নতুন নয়। দক্ষিণ আমেরিকার ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’ কোপা লিবার্তাদোরেসের গত ৫ আসরে ব্রাজিলের ক্লাবগুলো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র দুবার। ব্রাজিলের ফুটবলের মূল যে নির্যাস, সেটি হারিয়ে ফেলার বড় কারণও মনে করা হয় ব্রাজিলের প্রতিভা পাচারকে। ব্রাজিলের পেশাদার লিগে খেলেছে কি খেলেনি, এমন বয়সেই ইউরোপে চলে গেলে সেই তরুণদের আসলে নিজ নিজ ক্লাবের ধাঁচ ও ধরন মানিয়ে নিতে হয়। সেটা আদতে ইউরোপীয় ফুটবলই।

ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের কথাই ধরুন। ১৮ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডকে নেইমারের পর ভাবা হয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ‘ভবিষ্যৎ’ হিসেবে। ভিনিসিয়ুসকে ১৭ বছর বয়সেই কিনে ফেলেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। বয়স ১৮ পূর্ণ হওয়া মাত্রই তাঁকে উড়িয়ে আনা হয়েছে মাদ্রিদে। পেশাদার ফুটবলের শুরুতেই তো ঠিকানা বদলে গেল!

ব্রাজিলের ফুটবলে বহুদিন ধরেই এমন হয়ে আসছে। বয়স কুড়ির আশপাশে থাকতেই উঠতি প্রতিভারা ছাড়ছেন দেশের লিগ। এতে ক্রমে দুর্বল হচ্ছে ঘরোয়া লিগের কাঠামো। দেশের ঘরোয়া লিগের খেলার মান তো নামছেই। এতে মূল প্রভাবটা পড়ছে বিশ্বকাপে। ব্রাজিল সবশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ১৭ বছর আগে। মাঝে ভূরি ভূরি তারকা খেলোয়াড় এসেছে, চলেও গেছে, কিন্তু বিশ্বকাপ শিরোপা আসেনি।

হিসেব কষলে দেখা যাবে, এই সময়ে ব্রাজিলে যত তারকা ফুটবলারের আবির্ভাব ঘটেছে, বেশির ভাগই ঘরোয়া লিগ ছেড়েছেন বয়স কুড়ি বছরের আশপাশে থাকতে। রবিনহো, লুকাস মউরা থেকে শুরু করে হাল সময়ে বার্সার ম্যালকম পর্যন্ত এ চর্চার অংশ। আর ভিনিসিয়ুসের পর আঠারো বছরের আশপাশে থাকতে দেশ ছাড়ার সর্বশেষ উদাহরণ তো রদ্রিগো। ব্রাজিলের নভোরিজোনতিনো ক্লাব থেকে ১৮ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডকে উড়িয়ে এনে ‘কাস্তিয়া’য় (বি দল) গড়ে তুলছে রিয়াল। ঠিক এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের আসল সৌরভ।

ওই অনুষ্ঠানে আরও একটি বিষয়ে বলেছেন তিতে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিলের ফুটবলে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন জার্মানির কাছে ৭-১-এ হারা সেই ম্যাচকে। তিতে মনে করেন, ওই পরাজয় ব্রাজিলের খেলোয়াড়ের মধ্যে একটা ‘আবেগীয় ভারসাম্যহীনতা’ তৈরি করেছিল।