একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার যেভাবে ভেঙে পড়েন

জাতীয় দলে ইমরুল কায়েসের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় দলে ইমরুল কায়েসের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ছবি: প্রথম আলো
>

বিশ্বকাপ দল নিয়ে কত আলোচনা হচ্ছে—কে খেলতে পারেন, কে বাদ পড়তে পারেন। তবে এ আলোচনায় তাঁর নামটা নেই আগে থেকেই। অবশ্য এমন অভিজ্ঞতা ইমরুলের আগে অনেকবারই হয়েছে। বারবার ধাক্কা খেতে খেতে জাতীয় দলের বাইরে থাকা অভিজ্ঞ এ ওপেনার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন

আপনার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ শেষ, এখন কী করবেন? ‘খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি—এ ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই!’ ছুটির কথা মানুষ বলে হাসিমুখে, ইমরুল কায়েস সেটি বললেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আসলে শেষ হয়নি, সুপার লিগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পর্বটা এখনো বাকি। ইমরুলের দল গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স সুপার লিগে উঠতে ব্যর্থ বলে তিনি ছুটিটা একটু আগেভাগে পেয়ে গেছেন। কিন্তু এমন ছুটি কোনো ক্রিকেটারই পেতে চান না।

কদিন আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছিলেন, বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের সঙ্গী হিসেবে তিনি সৌম্য সরকার কিংবা লিটন দাসের খেলার সম্ভাবনা দেখেন। এতেই পরিষ্কার, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ দলে ইমরুলের ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। সম্ভাবনা ক্ষীণ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে সুযোগ পাওয়াও। বিশ্বকাপ কিংবা আয়ারল্যান্ড সফরে যদি না–ই থাকেন, টানা পাঁচ-ছয় মাস খেলার বাইরে থাকতে হবে তাঁকে। ফিরলেও হয়তো জাতীয় দলে নয়, ফিরতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে। চার মাস আগেও যে ব্যাটসম্যানের দুর্দন্ত একটা সিরিজ গেছে, তিন ইনিংসে করেছেন ১৪৪, ৯০ ও ১১৫—মোট ৩৪৯ রান, তাঁর ভবিষ্যৎ কয়েক মাসের মধ্যেই অনিশ্চয়তার মোড়কে ঢাকা।

ইমরুল প্রায়ই নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘দুর্ভাগা’ ক্রিকেটার হিসেবে দাবি করেন! তাঁর এ দাবি উড়িয়ে দেওয়ারও উপায় নেই। গত দুই বছরে দেখুন, কতবার তাঁকে ফেরার লড়াই করতে হয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দুঃস্বপ্নের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা একটু রান পেয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম আর ইমরুল। সেই ইমরুল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পরের ওয়ানডে সিরিজটাই (ত্রিদেশীয়) খেলতে পারলেন না। সুযোগ পেলেন না গত এশিয়া কাপের দলেও। টুর্নামেন্টের মাঝপথে হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার নোটিশে তাঁকে উড়িয়ে নেওয়া হলো। ভ্রমণক্লান্তি আর আবুধাবির তীব্র গরমে দ্রুত মানিয়ে নিয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেললেন অপরাজিত ৭২ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। এশিয়া কাপে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে গত অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে রাখা হলো। তবে জানা যায়, সিরিজের প্রথম ম্যাচে তাঁকে খেলানো নিয়ে ভীষণ সংশয়ে ছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। দলের দু-একজন সিনিয়র ক্রিকেটারের জোর দাবিতে তিনি একাদশে থাকলেন এবং ১৪০ রান করলেন। সিরিজটা এত দুর্দান্ত খেললেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে তাঁকে বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু দুই ম্যাচে ৪ ও ০ রান করার পর আবার কোপ পড়ল ইমরুলের ওপর। ২০১৬ নিউজিল্যান্ড সফরে ভালো করার পরও এবার কিউইদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে তাঁকে নেওয়া হলো না।

এবার নিউজিল্যান্ড সফরে ইমরুলকে বাদ দেওয়া নিয়ে বেশ হইচই হলে একবার শোনা গেল, ১৬ জনের স্কোয়াড করে তাঁকে নেওয়া হবে। পরে নেওয়া হলো না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১ বছর কাটিয়ে দেওয়া আর কোনো ক্রিকেটারের এমন উত্থান-পতন আছে কি না, সন্দেহ! বারবার এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে ইমরুল ভীষণ ক্লান্ত। গত কিছুদিনে তাঁর বেশ কয়েক বার মনে হয়েছে, এভাবে না খেলে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেওয়াই ভালো!

কিন্তু সেটাও যে পারেন না। ইমরুল পারেন না আবেগের কাছে হার মেনে—‘ক্রিকেট খুব ভালোবাসি। এটা রক্তে মিশে গেছে। ক্রিকেট না খেললে হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়া যায়। কিন্তু এখনো বয়স আছে। ক্রিকেটের বাইরে সেভাবে কিছু চিন্তা করতে পারি না। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তাই পারি না। আচ্ছা বলুন, একজন ক্রিকেটার হিসেবে সব সময় আপনার লক্ষ্য থাকবে কী? জাতীয় দলে খেলা। সেখানেই যদি কোনো আশা না থাকে, তবে আর তো কোনো পথ খোলা থাকল না। মাঝেমধ্যে ভীষণ হতাশ হই। পরে অবশ্য মেনে নিই, এটা আমার ভাগ্যে লেখা। হয়তো কারও কারও চোখে আমি মুগ্ধতা ছড়ানো ব্যাটসম্যান নই, ধ্রুপদী ব্যাটসম্যান নই। কিন্তু বাংলাদেশ দলের হয়ে রান তো করেছি। রান করতে গেলে বেসিক অন্তত থাকতে হয়।’

একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার কীভাবে ভেঙে পড়েন, ইমরুলের কথাতেই পরিষ্কার। মানসিকভাবে তিনি এতটাই হতাশ, সেটির প্রভাব পড়েছে তাঁর পারফরম্যান্সেও। ভালো করতে পারেননি সবশেষ দুটি ঘরোয়া লিগে। বারবার ধাক্কা খেতে খেতে তিনি যেন আবার ফিরে আসার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছেন। বিপিএল কিংবা এই প্রিমিয়ার লিগে তিনি যখন ব্যাটিংয়ে নেমেছেন, মাথায় তাঁর একটা প্রশ্ন ঘুরেছে, ‘কোন লক্ষ্যে খেলে যাচ্ছি?’

প্রশ্নটা আসলেই ভয়ংকর। এটা একজন ক্রিকেটারের মধ্যে একবার ঘুরতে থাকলে ভালো করা খুব কঠিন হয়ে যায়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এতটাই পিছিয়ে পড়তে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার ইচ্ছেটা মরে যায়। তবে ইমরুলের আশা, ১১ বছরে এই লড়াইয়ে অনেকবার জিতেছেন। আরেকবার পারবেন। কিন্তু কবে পারবেন, সেটি এ মুহূর্তে অজানা। ২০১১ বিশ্বকাপে খেলেছেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে হুট করে তাঁকে উড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। এবারও ইমরুল যাবেন। তবে ইংল্যান্ডে তাঁকে দলের খেলা দেখতে হবে হয়তো শুধুই একজন দর্শক হয়ে!