কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাসকিন

>বিশ্বকাপ দলে নেই। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে যে অতিরিক্ত দুজন যাচ্ছেন, সেখানেও তাঁকে বিবেচনা করা হয়নি। তাসকিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। ভেঙে পড়লেন কান্নায়।

২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি তারিখটা যেন ফিরে এল আজ। ফিরে এল সেই কান্নাভেজা বিকেলটা। সে বিকেলে কেঁদেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। আজ কাঁদলেন তাসকিন আহমেদ। দুজনের হৃদয়ে একই ক্ষত, নিজের নামটা নেই স্বপ্নের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ দলে। ২০১১ বিশ্বকাপে যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা হয়েছিল মাশরাফির, আজ সেটিই হলো তাসকিনের।

বিকেলে বিসিবি একাডেমি মাঠে এসেছিলেন ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে। তাসকিনকে ঘিরে ধরলেন সংবাদকর্মীরা। আপনি কি মনে করেন, আপনার প্রতি সুবিচার করা হয়েছে? প্রশ্নটা উত্তর দিতে গিয়ে গলা ধরে এল তাসকিনের। চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ধারা। কোনোভাবে শুধু বলতে পারলেন, ‘না, ঠিক আছে, যেটা ভালো হয় সেটাই করেছে। সবাই তো ভালোই চায় (আমার)। খারাপ চায় না কেউ। সামনে আরও সুযোগ আছে। সুপার লিগের ম্যাচ আছে। সেখানে ভালো করার চেষ্টা করব।’

চোখের জল আটকাতে পারেননি তাসকিন। ছবি: প্রথম আলো
চোখের জল আটকাতে পারেননি তাসকিন। ছবি: প্রথম আলো

দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন বিপিএলে। ২২ উইকেট নিয়ে ছিলেন সেরা দুইয়ে। সেরা বোলার সাকিব ২৩ উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিনের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে এবং টেস্ট, দুই সিরিজেই তাসকিনকে দলে রাখতে দুবার ভাবেননি নির্বাচকেরা। সব এলোমেলো হয়ে গেল নিউজিল্যান্ড সফরের পাঁচ দিন আগে পাওয়া অ্যাঙ্কেলের চোটে। চোট কাটিয়ে ফেরার পর নির্বাচকেরা বলছিলেন, ম্যাচ ফিটনেস নেই তাসকিনের।
ম্যাচ ফিটনেস তাঁর আছে, সেটি প্রমাণ করতে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের হয়ে একটা ম্যাচও খেলেছিলেন । কিন্তু সেটি যে যথেষ্ট ছিল না নির্বাচকদের কাছে। তাসকিনকে বিশ্বকাপ দল তো বটেই, রাখা হয়নি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের অতিরিক্ত তালিকাতেও। প্রসঙ্গটা তুলতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না তাসকিন, কান্নাজড়ানো কণ্ঠে ‘সবাই যেটা ভালো মনে করেছে, সেটাই করেছে’ বলে চলে গেলেন একাডেমি ভবনের ভেতরে।
তাসকিনকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন সাইফউদ্দীন, ‘আপনি সামনে খেলবেন। ভেঙে পইড়েন না। আপনি ফিরে আসবেন।’ সাইফউদ্দীনের কথাতেও প্রবোধ মানে না। সাবেক ক্রিকেটার ফয়সাল হোসেনও সান্ত্বনা দিতে থাকেন তাসকিনকে, ‘কিচ্ছু হয়নি। তুই আবার ফিরবি। আবার বড় টুর্নামেন্ট খেলবি। একজন খেলোয়াড়কে এভাবে ভেঙে পড়তে হয় না।’

কাঁদছেন তাসকিন। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন একাডেমি কোচ ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স ও জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাইফউদ্দীন। ছবি: প্রথম আলো
কাঁদছেন তাসকিন। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন একাডেমি কোচ ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স ও জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাইফউদ্দীন। ছবি: প্রথম আলো

ধাক্কাটা সামলে তাসকিন চোখে মুছে উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে পা বাড়ান জিমনেশিয়ামের দিকে। বলেন, ‘সুপার লিগ ভালোভাবে খেলব।’ পরক্ষণে আবার আবেগ স্পর্শ করে বসে তাঁকে, ‘মাশরাফি ভাইয়ের স্ক্রিপ্টই কি আমি অনুসরণ করছি? ভাইয়ের যা হলো, আমারও তা-ই !’
তাসকিন ভুল বলেননি। ক্রিকেট কখনো কখনো বড় নিষ্ঠুর হয়। সেই নিষ্ঠুরতার রূপ মাশরাফির চেয়ে বেশি দেখেছেন খুব কম ক্রিকেটারই। ক্যারিয়ারে এত চোট, এত ধাক্কা; স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ হেঁটেছে তাঁর দুই হাত ধরে! কিন্তু এটাও তো সত্য, যাতনা-বেদনা, আফসোস-হাহাকারের বিপরীতে থাকে প্রাপ্তির আনন্দ। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে মাশরাফি যে যন্ত্রণা পেয়েছেন, সেটির বিপরীতে অনেক কিছুই পেয়েছেন। হয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক। যিনি খেলতে পারেননি দেশের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপ, তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খেলেছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, খেলেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল।
বারবার ধাক্কা খাওয়ার পর মাশরাফি যতটা পথ হেঁটেছেন, তাসকিন ততটা পারবেন কি না, সময় বলে দেবে। কিন্তু মিনহাজুল আবেদীন অন্তত চাইলে এড়াতে পারতেন এই তাসকিন-ট্র্যাজেডি। নির্বাচকদের বিবেচনায় না থেকেও শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর চেয়ে ভালো আছে কার! ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ব্লেজার পরে আজ দল ঘোষণা করতে এসেছিলেন প্রধান নির্বাচক। ২০ বছর আগে এই ব্লেজারটাই গায়ে চাপাতে কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি তাঁকে।

তাসকিন চোট পাওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতেই প্রধান নির্বাচক বলেছিলেন, ‘ওর তো বিশ্বকাপ শেষ!’ যাঁর নামের পাশে অনেক আগেই পড়ে গেছে ‘ক্রস’ চিহ্ন, তিনি যত চেষ্টাই করুন, সবই বৃথা !