জুভেন্টাসের 'চ্যাম্পিয়নস লিগ প্রকল্পে' ধাক্কা

এবার আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হচ্ছে না রোনালদোর। ছবি : এএফপি
এবার আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হচ্ছে না রোনালদোর। ছবি : এএফপি
>

টানা সাতবার ঘরোয়া লিগ জিতে সিরি ‘আ’ বিষয়টাকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছে জুভেন্টাস। আট নম্বর লিগ শিরোপাও আসছে আর কিছুদিন পর। এবার জুভেন্টাসের লক্ষ্য ছিল যে কোনো মূল্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপা জেতা। গতকাল আয়াক্সের কাছে হেরে সেই ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় প্রকল্প’ ধাক্কা খেল।

ঘরোয়া লিগ থেকে জুভেন্টাসের আর কিছুই পাওয়ার নেই। টানা সাতবার লিগ জিতেছে তারা, আট নম্বর শিরোপাও আসছে শিগগিরই। বিশ দলের লিগটাকে একদম ‘মনোপোলি’ বানিয়ে ফেলা জুভেন্টাস ও এর সমর্থকদের এখন আর সিরি ‘আ’ জয় আন্দোলিত করে না। আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না। নিজেদের ইতিহাসকে অন্যমাত্রা দিতে তাদের দরকার চ্যাম্পিয়নস লিগের আরেকটি শিরোপা। ১৯৯৫-৯৬ সালের পর পাঁচবার ফাইনালে গিয়েও যে ইউরোপ-সেরা হওয়া হয়নি জুভেন্টাসের।

ইতালিতে এই মুহূর্তে জুভেন্টাসের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।কে নেবে জুভেন্টাসের কাছ থেকে ইতালির মুকুট? এসি মিলান? এক কালের প্রবল পরাক্রমশালী মিলানের লাল-কালো দলটা এখন নিজেদের ঠিকভাবে গুছিয়েই উঠতে পারছে না। নিয়মিত মালিকানা বদল করা মিলান এখনো খুঁজে ফিরছে নিজেদের জন্য আদর্শ কৌশল, আদর্শ খেলোয়াড়। যে আদর্শ কৌশল ও খেলোয়াড় গত মৌসুমে খুঁজে পেয়েছিল নাপোলি। আরেকটু হলে জুভেন্টাসকে সরিয়ে তারাই সিরি ‘আ’ এর নতুন রাজা হতো, কিন্তু জুভেন্টাসের চ্যাম্পিয়ন মানসিকতা ও অভিজ্ঞতার কাছে মার খেয়ে গেছে। নাপোলির সেই আদর্শ কোচ মরিজিও সারি এখন চেলসির কান্ডারি। নতুন কোচ কার্লো আনচেলত্তির অধীনে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করেছে তারা। ওদিকে মিলানের আরেক দল ইন্টার কাগজে-কলমে শক্তিশালী দল গড়লেও দলের সবচেয়ে বড় তারকা মাউরো ইকার্দি ও কোচের মধ্যকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদের খেসারত দিচ্ছে। লুসিয়ানো স্পালেত্তিকে ইতালির অন্যতম ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কোচ বলে মনে করা হলেও ইন্টারে এসে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ব্যবস্থাপনা পরিষদের খামখেয়ালিপনার মাশুল দিচ্ছে ফিওরেন্টিনা ও রোমা।

প্রতিপক্ষের এসব সমস্যার ষোলো আনা ফসল ঘরে তুলছে জুভেন্টাস। টানা অষ্টমবারের মতো লিগ জিততে যাওয়া তারই প্রমাণ। ইতালিতে খেলা তরুণ প্রতিভারা এখন বুঝে গিয়েছে, কোনোভাবে ভালো খেললে জুভেন্টাসে যেতে পারলে ঘরোয়া লিগের শিরোপা নিশ্চিত। ফেদেরিকো বার্নার্দেসকি, পাওলো দিবালা, মাত্তিয়া পেরিন, লিয়ান্দ্রো স্পিনাজোলা, হোয়াও ক্যানসেলো— সবাই এই লোভেই জুভেন্টাসে পাড়ি জমিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে জুভেন্টাসের চাওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু আসলেই কী নেই? আছে। ঘরোয়া লিগ যেমন দু’হাত ভরে জুভেন্টাসকে এনে দিয়েছে একের পর এক শিরোপা, ঠিক একইভাবে বছরের পর বছর জুভেন্টাসের সঙ্গে সৎ ছেলের মতো আচরণ করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় শিরোপা। গত তেইশ বছরে পাঁচবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেও শূন্য হাতে ফিরে আসা তারই প্রমাণ। একেক বছর যাচ্ছে, আর একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য জুভেন্টাসের হাহাকার বাড়ছেই। তুরিনে এখনো কান পাতলে শোনা যায় সমর্থকদের দীর্ঘশ্বাস।

গতবার রিয়াল মাদ্রিদের কাছে কোয়ার্টারে আটকে যাওয়ার পর জুভেন্টাসের কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভেবেছিলেন, ‘ব্যস। আর না। অনেক হয়েছে।’ লিগে প্রতিপক্ষদের বাজে অবস্থা সম্পর্কে তো আগেই বললাম, ব্যাপারটা জুভেন্টাসের কর্তাদের মাথাতে আগেই ছিল। জুভেন্টাসের স্কোয়াড যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রজ্ঞাবান একজন কোচও আছেন, যিনি জুভেন্টাসকে নতুন এক পরিচয় দিয়েছেন। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মন্ত্র শিখিয়েছেন।

বাকি ছিল শুধুমাত্র একটা ‘এক্স-ফ্যাক্টর’। দলের শক্তি, আদর্শ কাঠামো ও কুশলী কোচ দিয়ে আবার লিগ জেতা গেলেও, ‘এক্স-ফ্যাক্টর’টা না থাকলে চ্যাম্পিয়নস লিগে বারবার খালি হাতেই ফেরত আসতে হবে জুভেন্টাসকে। এটা বুঝেছিলেন জুভেন্টাসের মালিকপক্ষ। এই মৌসুমে তাই সেই ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ এর সন্ধানে উঠেপড়ে লেগে গেল জুভেন্টাস।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রূপ ধরে ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ পা রাখল জুভেন্টাস স্টেডিয়ামে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা রিয়াল মাদ্রিদে প্রাপ্য সম্মান না পেতে পেতে অভিমানী হয়ে উঠেছিলেন। এমন এক জায়গায় যেতে চাচ্ছিলেন যেখানে তাঁকে মাথার মুকুট করে রাখা হয়। এমন এক জায়গায় যেতে চাচ্ছিলেন যেখানে তাঁকে শিরোমণি করে রাখা হয়।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যেতে সময় লাগেনি। রোনালদোর মাঝে জুভেন্টাস পেল তাদের সেই ‘এক্স-ফ্যাক্টর’, জুভেন্টাসের মাঝে রোনালদো পেলেন পরিবারের বন্ধন, পর্বতসম সম্মান।

রোনালদোকে কেন্দ্র করে জুভেন্টাস গড়ে তুলল তাদের ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ প্রকল্প’। চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা এবার সাদাকালো জার্সি গায়ে ইউরোপসেরা হওয়ার উৎসব করবেন তুরিনে, নতুন সেই আশায় বুক বাঁধল জুভ সমর্থকেরা।

নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় করে ৩৩ বছর বয়সী রোনালদোকে দলে আনল জুভেন্টাস। ট্রান্সফার ফি, বেতন-বোনাস সহ ‘মিশন রোনালদো’র পেছনে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড লগ্নি করার সিদ্ধান্ত নিল তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করার জন্য নতুন এই প্রকল্পে তরুণ কোনো খেলোয়াড় নয়, বরং আনতে হবে পরীক্ষিত সৈনিক। এই লক্ষ্যে এক মৌসুম আগেই এসি মিলানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া সেন্টারব্যাক লিওনার্দো বোনুচ্চিকে দলে টানা হলো আবার। পরীক্ষিত যোদ্ধার তকমা লাগিয়ে দলে এলেন মার্টিন ক্যাসেরেসও। ফলে কপাল পুড়ল মাত্তিয়া কালদারা, ড্যানিয়েলে রুগানির মতো তরুণদের। পরীক্ষিত সৈনিকদের জায়গা করে দিতে জুভেন্টাসে জায়গা হলো না কালদারার। মূল দলে এখনো তেমন ডাক পান না রুগানি। বারবার চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থ জিয়ানলুইজি বুফন, কাওয়াদো আসামোয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, ক্লদিও মার্কিসিও, স্টেফান লিখস্টাইনারদের ছাঁটাই করতে একটুও বুক কাঁপল না জুভেন্টাসের।

কারণ এই জুভেন্টাস নতুন জুভেন্টাস। আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জুভেন্টাস। রোনালদোর কাঁধে বন্দুক রেখে চ্যাম্পিয়নস লিগ লক্ষ্যভেদ করার আশায় টইটুম্বুর করতে থাকা জুভেন্টাস।

কিন্তু আয়াক্স চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, একজনের ওপর ভর করে কখনই চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো শিরোপা জেতা যায় না। সে একজনের নাম যদি রোনালদো হয়, তাও। এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট রাউন্ডে জুভেন্টাস গোল করেছে পাঁচটা, পাঁচটাই এসেছে রোনালদোর কাছ থেকে। রোনালদোর কাঁধে বন্দুক রেখে লক্ষ্যভেদ করতে চাইলেও জুভেন্টাস বুঝতে পারেনি, লক্ষ্য পর্যন্ত যাওয়ার মতো শক্তিশালী ও গতিশীল বুলেট জুভেন্টাসের কাছে নেই। ওদিকে ভয়ডরহীন ‘টিম-গেম’ এর চূড়ান্ত পসরা সাজিয়ে আয়াক্স দেখিয়ে দিল, দিন শেষে ফুটবলটা দলীয় খেলাই।