এই আয়াক্স সাহসী সুন্দর!

মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে আয়াক্স। ছবি : এএফপি
মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে আয়াক্স। ছবি : এএফপি
>ইয়োহান ক্রুইফ আর রাইনাস মিশেলসের ছোঁয়ায় ফুটবলে সত্তরের দশকে রাজত্ব করেছিল আয়াক্স আমস্টারডাম। সেই আয়াক্স আবারও আশার আলো দেখাচ্ছে এই মৌসুমে। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশ্রণে গড়া এই আয়াক্স খেলছে ভয়ডরহীন ফুটবল। বড় দলের ঔজ্জ্বল্যে হারিয়ে যাচ্ছে না, বরং তারুণ্যের দ্যুতিতে তারাই ম্লান করে দিচ্ছে ফেবারিটদের।

নিজেদের মাঠে ১-১ গোলে ড্র করে আসা আয়াক্স যে কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগেও কিছু একটা করে দেখাবে, সবাই মোটামুটি এ ব্যাপারে হালকা-পাতলা নিশ্চিত ছিলেন। আর থাকবেন নাই-বা কেন? যে দল রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ থেকে ৪-১ গোলে জয় নিয়ে আসতে পারে, সে দল জুভেন্টাস স্টেডিয়ামেও যে ভেলকি দেখাবে না, সেটা বলা যায় না। আর সেটাই হয়েছে। জুভেন্টাসের মাঠ থেকে ২-১ গোলের জয় নিয়ে এসে সেমিতে জায়গা করে নিয়েছে এই মৌসুমের ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ আয়াক্স।

ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনা থেকে মহামূল্যবান দুই ‘অ্যাওয়ে গোল’ নিয়ে ফেরত এসেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। দলের ভালো অবস্থা দেখে ইচ্ছে করেই হলুদ কার্ড হজম করেছিলেন সার্জিও রামোস। নিজেদের মাঠে রিয়াল ৪ গোল হজম করবে, তা-ই বা কে ভেবেছিল? কিন্তু সেই ভাবনাকেই সত্যি পরিণত করেছেন আয়াক্সের খেলোয়াড়েরা। হাকিম জিয়েখ, ম্যাথিস ডে লিট, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ডেভিড নেরেস, দুসান তাদিচকে নিয়ে গড়া আয়াক্স দল যেকোনো ফুটবলপ্রেমীকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। শুধু গোল দিয়ে জয় বের করে নেওয়া নয়, সুন্দর ফুটবলের প্রতিচ্ছবি পুরো ম্যাচেই ছড়িয়ে রাখছে ক্রুইফ প্রজন্ম।

ইয়োহান ক্রুইফ ফুটবল মাতিয়ে গিয়েছেন সেই সত্তরের শুরুতে। সত্তরের দশক ছিল ইয়োহান ক্রুইফের দশক। সত্তরের শুরুতে নতুন এক ফুটবল দর্শন নিয়ে মাঠে এসেছিলেন ক্রুইফ, ইয়োহান নিসকেন্স, রুড ক্রলরা। ‘টোটাল ফুটবল’ দিয়ে ফুটবল মাতিয়েছেন ক্রুইফরা। টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপজয়ী আয়াক্সের সমকক্ষ ছিল না সে সময় কেউ। কিন্তু একসঙ্গে ক্রুইফের বার্সা গমন ও কোচ স্টেফান কোভাকসের আয়াক্স ছেড়ে ফ্রান্সে গমন, কাল হয়েছে আয়াক্সের জন্য। সে থেকেই রং হারাতে শুরু করে লাল-সাদারা।

সত্তরের আয়াক্সের সঙ্গে বর্তমান আয়াক্সের তুলনা চলে না। আয়াক্সের জমিদারি ম্লান হয়ে গেছে অনেক আগেই। মাঝে লুই ফন গালের অধীনে চ্যাম্পিয়নস লিগে দুই বছর রাজত্ব করা শুরু করেছিল, তা-ও থেমে গিয়েছিল জুভেন্টাসের কাছে। আর এই শতাব্দীতে গাড়ির চাকা যেন আটকে রয়েছে আয়াক্সের। শেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ের দেখা পেয়েছিল ১৯৯৬ সালে। রাজরক্ত বইলেও তাকে কাজে লাগাতে পারছে কোথায়? তবে নতুন করে জমিদারির ঠাটবাট দেখানোর স্বপ্ন দেখছে ডি লিট, ডি ইয়ং, জিয়েখরা!

আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে ফুটবলে। সে ছোঁয়া বদলে দিয়েছে ফুটবলকে। কয়েক দশক ধরে আত্মস্থ করা ফুটবল স্টাইল বদলে ফেলতে হয়েছে প্রযুক্তির ঝনঝনানিতে। এমনকি বার্সেলোনার মতো দল সরে এসেছে নিজেদের লালন করা ‘টিকিটাকা’ থেকে। কিন্তু আয়াক্স যেন এখানে পুরোই উল্টো। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খেলার ধরন বদলানো দূরে থাক, বরং তাকে আরও আপন করে নিয়েই নতুন করে ফুটবলে রাজত্ব করার ইচ্ছে কোচ এরিক টেন হাগের।

টেন হাগ প্রায় দুই বছর কোচ ছিলেন বায়ার্ন সেকেন্ড টিমের। সে সময় পেপ গার্দিওলাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। আয়াক্সকে ইউরোপা লিগের ফাইনাল খেলানো কোচ পিটার বশচের যাওয়ার পর আয়াক্সের ডাগআউটে ৫ মাসও টিকতে পারেননি পরবর্তী কোচ মার্সেল কাইজার। ভঙ্গুর আয়াক্সের দায়িত্ব দেওয়া হয় হাগের হাতে। এসেই একঝাঁক তরুণ হাতে পান হাগ। গার্দিওলার অধীনে দুই বছর কাটানো হাগের জন্য খুব একটা কঠিন ছিল না। অন্য কোনো পদ্ধতিতে নয়, বরং ফেরত গেলেন সেই রাজত্ব করা সময়ে। ধমনিতে রাজরক্ত বয়ে চলা আয়াক্সের একঝাঁক তরুণকে নিয়ে শুরু করলেন টোটাল ফুটবলের আধুনিক যুগ।

কিংবদন্তি আয়াক্স খেলোয়াড় ড্যানি ব্লিন্ডের ছেলে ডেলে ব্লিন্ডকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ফেরত এনেছে দল। এ ছাড়া আর্জেন্টিনা থেকে নিকোলাস তাগলিয়াফিকো আর সাউদাম্পটন থেকে দুসান তাদিচ। দলকে ঢেলে সাজানো নয়, বরং যেসব খেলোয়াড় অন্য ক্লাবে গিয়ে নিজেদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি, টেন হাগের লক্ষ্য ছিল আয়াক্সে তাঁদের প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। এই দলের গড় বয়স এখন ২৪ বছর ২০২ দিন। বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে তরুণ দল লাল-সাদারা।

লাল-সাদাদের বয়স হতে পারে অন্যদের তুলনায় খুব কম। কিন্তু খেলার ধরন কিংবা মানসিকতায় কোনোভাবেই এই আয়াক্স দল পিছিয়ে নেই অন্যদের তুলনায়। বর্তমানে বেশির ভাগ দলই নিজেদের জয়ের জন্য সুন্দর খেলাকে বিসর্জন দেয়। হাগ সে পথে হাঁটেননি, বরং ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্যকে আঁকড়ে ধরেছেন। আয়াক্সের সর্বেসর্বা ইয়োহান ক্রুইফের মতাদর্শ ছিল, ‘আমি কখনো টাকার বস্তাকে গোল দিতে দেখিনি।’ টাকার বস্তার পেছনে তাই ছোটেনি আয়াক্স। নেদারল্যান্ডসের সেরা সব প্রতিভা উঠে আসে যাদের হাত ধরে, তারা সে সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে। হল্যান্ডের সেরা প্রতিভাদের নিয়ে ফুটবল বিশ্বকে সুন্দর এক ফুটবল উপহার দিতে চেয়েছেন হ্যাগ।

আয়াক্সের লক্ষ্য শুধু জয় নয়, লক্ষ্য সৌন্দর্য। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন লোপ পাচ্ছে খেলার সৌন্দর্য, অথচ সেটিকেই আঁকড়ে ধরেছে আয়াক্স। ফুটবলে সাফল্য বর্তমানে জিম্মি অর্থের কাছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে সুযোগ পাওয়া মাত্র দুটি দল বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার পেছনে উঠেপড়ে লাগেনি। সে দুটি দলের একটি আয়াক্স। তাদের রন্ধ্রে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি কখনোই ছিল না। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতাই তাদের আশা। এই দলের কথাটাই ভাবুন, দলের সবচেয়ে ‘দামি’ তারকা ডেলে ব্লিন্ডের দাম মাত্র ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড। আট দলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ফুটবল উপহার দিতে পেরেছে আয়াক্সই। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে শুধু বিধ্বস্তই করেনি, বরং উপহার দিয়েছে সুন্দর ফুটবল।

জুভেন্টাসের ম্যাচের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। বর্তমান ফুটবলে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দল হিসেবে ধরা হয় ‘ওল্ড লেডি’দের। রক্ষণ থেকে আক্রমণ, সব মিলিয়ে জুভেন্টাসের সমকক্ষ কোনো দল নেই। সঙ্গে যোগ করুন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হার না-মানা মানসিকতা। অথচ সে দলকে কী অনায়াসে আটকে দিল তরুণ আয়াক্স। একটিবার দেখেও মনে হবে না, তরুণদের নিয়ে গড়া দল এটি। বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা, কোনো দিক দিয়েই জুভেন্টাসের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব নয় আয়াক্সের। অথচ রোনালদোর একটি হেড বাদে পুরো ম্যাচ কবজা করে রেখেছিল আয়াক্স। শেষমেশ ২-১ গোলের জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছে তারা।

ইয়োহান ক্রুইফের মন্ত্র ছিল সুন্দর ফুটবল। আর সুন্দর ফুটবল মানেই আক্রমণাত্মক ফুটবল। হাগ সে পদ্ধতিতেই এগিয়েছেন। আয়াক্স দলকে সাজিয়েছেন টিকিটাকা ও টোটাল ফুটবলকে সমন্বয় করে। ৪-৩-৩ ছকে প্রতিটি খেলোয়াড় যেভাবে একসঙ্গে ওপরে ওঠেন, ঠিক সেভাবেই নেমে আসেন। মাঠে নিজ নিজ জায়গা দখল করার সময় পজিশন ঠিক রেখে নিজ জায়গা থেকে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে যেমন দলের মূল পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন হয় না, তেমনি একেকজনের পাস দেওয়ার অপশন হয়ে যায় তিনটি করে। তাদের পাসিং ফুটবল খেলার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

তবে সুন্দর ফুটবল দেখার সৌভাগ্য সামনের মৌসুমেই শেষ হতে চলেছে। আয়াক্সের মতো দল বর্তমান বিশ্বে ‘ফিডার ক্লাব’ হিসেবেই পরিচিত। সামনের মৌসুম থেকে মাঝমাঠে সামলানো ডি ইয়ং খেলবেন বার্সার হয়ে। উইং সামলানো ডেভিড নেরেসের দিকে নজর পড়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও লিভারপুলের মতো ক্লাবের। তাগলিয়াফিকো হয়তো চলে যাবেন অ্যাটলেটিকোতে। তাদিচ, ডি লিটরাও রয়েছেন অন্যান্য দলের রাডারে। এ রকম তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশ্রণ দেখার শেষ সুযোগ হয়তো এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগেই।

তত দিন নির্ভীক আয়াক্সের ফুটবলীয় সুধা পান করতে থাকুন!