অঙ্কের হিসাব কষে সৌম্য কখনো রুদ্র, কখনো শান্ত

সৌম্য সরকার। ছবি: প্রথম আলো
সৌম্য সরকার। ছবি: প্রথম আলো
>লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিলেন সৌম্য সরকার।

ওপেনাররা একটু ছন্দ মানতে পছন্দ করেন। ব্যাটিংয়ের একটা ধারা থাকে। ছন্দে খেলা প্রতিটি ইনিংসের সঙ্গে আরেকটির গতির বেশ সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। রোববার যেমন রূপগঞ্জের বিপক্ষে সৌম্য সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ৭১ বলে। সেদিন ইনিংসটা বড় করতে না পারার দুঃখ ছিল সৌম্যর। ম্যাচ শেষে তা নিজেই বলেছিলেন। দুঃখ ঘোচাতে অবশ্য মোটেও দেরি করেননি। ঠিক তার পরের ম্যাচেই তুলে নিলেন ডাবল সেঞ্চুরি (২০৮*)। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিশতক তুলে নেওয়ার পথে সৌম্য সেঞ্চুরি করেছেন ৭৮ বলে।

আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি পাওয়ার পর সৌম্য ফর্মে ফিরেছেন রব উঠলে অনেকে বলেছেন, এক ম্যাচ রান পাওয়া নিয়ে এত শোরগোলের কী আছে! টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি এর মধ্যে একটি ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর সেই ‘অনেক’ সংখ্যাটা নিশ্চয়ই অনেক কমবে। সৌম্য যে সত্যিই নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করছেন, আজ শেখ জামালের বিপক্ষে ম্যাচটা হতে পারে তার প্রমাণ। ৯ উইকেটে ৩১৭ রান করেছিল শেখ জামাল। সৌম্য ওপেন করে ম্যাচটা জিতিয়েছেন শেষ পর্যন্ত থেকে। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে আউট হয়েছিলেন ২৫তম ওভারে। ঠিক পরের ম্যাচেই তিনশোর্ধ্ব রান তাড়া করতে নেমে ‘অপরাজিত’ সৌম্যকে দেখতে পাওয়া তো তাঁর পাল্টে যাওয়ার নমুনাই।

নমুনা রয়েছে আজ তাঁর ইনিংসের পরতে পরতে। ওপেনিং সঙ্গী থেকে শুরু করা যায়। জহুরুল ইসলামের সঙ্গে সৌম্যর সময়টা বেশ ভালোই কাটছে। আগের ম্যাচে দুজন ওপেন করে গড়েছেন ১৬৯ রানের জুটি। সেদিন ধুমধাড়াক্কা খেলে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ফিরলেও জহুরুল আউট হয়েছিলেন তাঁর আউট হওয়ার ৭ ওভার পরে। সৌম্য আজ অন্তত জহুরুলের আগে আউট না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করে মাঠে নেমেছিলেন যেন। আজ দুজনে ৩১২ রানের জুটি গড়ার পর জহুরুল ফিরেছেন ৪৬তম ওভারে। সৌম্য ইতিহাস লিখতে কাজে লাগিয়েছেন ইনিংসের পুরো সময়টাই।

আন্তর্জাতিক ওয়ানডের মতো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগও লিস্ট ‘এ’ আওতাভুক্ত। স্বীকৃত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড এখন সৌম্যর। স্ট্রোক খেলতে ভালোবাসেন এমন ‘হ্যান্ড-আই কম্বিনেশন’ নির্ভর ব্যাটসম্যানেরা সাধারণত ইনিংসের শুরুতে স্বাভাবিক খেলার চেষ্টা করে থাকেন। তাতে চাপটা কাটিয়ে উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় কম লাগে। সৌম্য আজ উল্টোটা করেছেন, প্রথম ফিফটি তুলে নিয়েছেন ৫২ বলে। প্রথম ফিফটি এসেছে ৪ চার ও ৪ ছক্কার মিশেলে। এরপর থেকেই তাঁর ইনিংস গড়া হয়েছে অঙ্কের হিসাব কষে।

ফিফটি তুলে নিয়ে উইকেটে সেট হওয়ার পর হাত খুলেছেন সৌম্য। সেঞ্চুরির দেখা পেতে খেলেছেন মাত্র ২৬ বল। এই ৫০ রানেও চার–ছক্কার সংখ্যা আগের ৫০ রানের সমান—৪টি চার ৪টি ছক্কা! সৌম্যর এই ১০০ রানে রুদ্ররূপ থাকলেও চার–ছক্কার হিসাবে কোথায় যেন একটা ছন্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেন মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, এই রান পর্যন্ত এর বেশি মারব না! আর কোনো আক্রমণাত্মক ওপেনার সেট হয়ে গেলে যা হয় আরকি—‘নার্ভাস নাইন্টিজ’-এ পৌঁছে আত্মবিশ্বাস থাকতে থাকতে যত দ্রুত সম্ভব হেস্তন্যস্ত করার চেষ্টা থাকে। ৯০ রানে পৌঁছে ২৫তম ওভারে সৌম্য তাই ১০০ ছুঁয়েছেন তাইজুলকে টানা দুই বলে চার-ছক্কা মেরে। এখানে বলে রাখা ভালো আগের ম্যাচে সৌম্য সেঞ্চুরি পেয়েছেন ২৩তম ওভারে। ওই যে ফর্মে থাকলে পাকা ব্যাটসম্যানদের ইনিংসে একটা ছন্দ থাকে, প্রায় একই পথে না হলেও অন্তত কাছাকাছি সুর-তাল-লয়।

সৌম্যের পরের ১০০ রানের ইনিংসটি আরও মজার। ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ১৪৯তম বলে। অর্থাৎ পরের ১০০ রান করতে সৌম্য খেলেছেন ৭১ বল। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিটা কিন্তু ৭১ বলেই করা। প্রথম ১৭৮ বল করে পরের ১৭১ বলে—ঘরোয়া ক্রিকেটের হালচাল দেখে তাঁর এই রান উৎসবকে নাক উঁচু ভক্তরা ফর্মে ফেরা হিসাবে না–ও মানতে পারেন। কিন্তু সৌম্য ছন্দে নেই—এমন কথার সঙ্গে পরিসংখ্যান অন্তত একমত নয়।

সৌম্য সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর ১৫০ বলে ১৫৪ রান দরকার ছিল আবাহনীর। হাতে ১০ উইকেট। ওই অবস্থায় সৌম্য যেহেতু সেট তাই ঝড় তুলে আউট হলেও বলের চেয়ে রানসংখ্যা কমে আসত। তাতে আবাহনীর অন্তত অসুবিধা হতো না। সম্ভবত এই লক্ষ্যেই সৌম্য ১০০ থেকে ১৫০ রানে পৌঁছেছেন মাত্র ২৬ বলে আর এর মধ্যে কোনো ৪ নেই, শুধু ৭টি ছক্কা।

১৫০ পেয়ে যাওয়ার পর এই সৌম্যই আবার বেশ খোলসবন্দী। দুই শ-র দেখা পেতেই যে ব্যাট করছিলেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আর তাই পরের ৫০ রান করলেন ৪৫ বলে। কিছুটা সাবধানী? তা তো বটেই। এই ৫০ রানে যে কোনো ছক্কা নেই, আছে মাটি কামড়ানো ৬টি ৪। দ্বিশতক পেয়ে যাওয়ার পর এই ব্যাটসম্যানই আবার খোলস ভাঙলেন—১৮ বলে দরকার ৫ রান। সৌম্য সরকার ম্যাচটা শেষ করলেন ছক্কা মেরে!

শেখ জামালের বিপক্ষে আবাহনী ১৭ বল হাতে রেখে ম্যাচটা জিতেছে ৯ উইকেটে। কিন্তু জয়-পরাজয় ছাপিয়ে এই ম্যাচ ভাস্বর থাকবে সৌম্যর ইতিহাস গড়ায়, বিশ্বকাপের আগে তাঁর পাল্টে যাওয়ার বার্তা দেওয়ার ম্যাচ তো এটাই!