বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুর্ভাগা ক্রিকেটার?

বিশ্বকাপের তিনটি ফাইনাল খেলেও জেতেননি একবারও। ফাইল ছবি
বিশ্বকাপের তিনটি ফাইনাল খেলেও জেতেননি একবারও। ফাইল ছবি
>ক্রিকেট বিশ্বকাপ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। চলছে রোমাঞ্চমাখা অপেক্ষা, চলছে স্মৃতিচারণাও। ফিরে দেখা বিশ্বকাপ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনের নতুন ধারাবাহিক। চতুর্থ পর্বে থাকছে সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের স্বাদ পাওয়া ক্রিকেটারের কথা। লিখেছেন সঞ্জয় বসাক

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা খেলোয়াড়দের তালিকা করতে বসলে সবার আগে কি গ্রাহাম গুচের নামটাই আসবে? আসাটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। যে ‘রেকর্ড’ তিনি করে রেখে গেছেন, সেটি যে আর কোনো ক্রিকেটারের নেই!

উপায় থাকলে রেকর্ড থেকে নিজের ও দলের নামটা নিশ্চিতভাবেই সরিয়ে নিতে চাইতেন গুচ। একমাত্র দল হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে তিনটিতেই হারের স্বাদ পেয়েছে ইংল্যান্ড। তিনবারই দলে ছিলেন এ রকম খেলোয়াড় মাত্র একজন—গ্রাহাম গুচ। এর মধ্যে এক বিশ্বকাপে ছিলেন দলের অধিনায়ক, আরেকটিতে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু তবুও বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটিতে চুমু খাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। মজার বিষয় হলো, তিনটি ফাইনাল আবার তিনি হেরেছেন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দশকে!

তিন ফাইনালের প্রথমটি ১৯৭৯ বিশ্বকাপে। ঘরের মাঠে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ, প্রথম আসরে না পারলেও দ্বিতীয় আসরে ফাইনালে উঠে এলো স্বাগতিক ইংল্যান্ড। প্রতিপক্ষ আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সামনে পড়লেও ইংল্যান্ডের আত্মবিশ্বাসী না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। টুর্নামেন্টে আগের ৫ ম্যাচের প্রতিটিতেই জিতেই যে ফাইনালে পা রেখেছিল তারা। শুরুটাও ভালোই করেছিল ইংল্যান্ড, ৯৯ রানের মধ্যেই তুলে নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪ উইকেট। কিন্তু ভিভ রিচার্ডস আর কলিস কিংয়ের পাল্টা আক্রমণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পায় ২৮৬ রানের বড় সংগ্রহ।

ব্যাট হাতেও শুরুটা ভালো হয়েছিল ইংলিশদের। বিনা উইকেটেই তুলে ফেলেছিল ১২৯ রান। অল্প রানের ব্যবধানে দুই ওপেনার ফিরলেও ডেরেক র‍্যান্ডলকে সঙ্গে নিয়ে দলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন গুচ। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৪৮ রান যোগও করে ফেলেছিলেন দুজনে। দলীয় ১৮৩ রানের মাথায় জোয়েল গার্নারের বলে গুচ ফিরে যেতেই ধসে পড়ে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ, মাত্র ১১ রানে শেষ ৮ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ হারে ৯২ রানে। গার্নারের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ২৮ বলে ৩২ রান করেছিলেন গুচ। সব মিলিয়ে ওই টুর্নামেন্টে ৫ ইনিংসে ৫২.৫ গড়ে ২১০ রান করেছিলেন। সর্বোচ্চ স্কোর ছিল সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭১।

আট বছর পর, ১৯৮৭ সালে আরও একবার ফাইনালে উঠল ইংল্যান্ড। উপমহাদেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে ফাইনালে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। দুই দলের সামনেই প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার হাতছানি। কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া পেল ২৫৩ রানের সংগ্রহ। লক্ষ্য তাড়া করার দৌড়ে ভালোমতোই ছিল ইংলিশরা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আত্মঘাতী রিভার্স সুইপ খেলে বিপদ ডেকে আনেন ইংলিশ অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৭ রানে হেরে আরও একবার শিরোপা হাতছাড়া করে ইংল্যান্ড।

ফাইনালে হারলেও ব্যক্তিগতভাবে টুর্নামেন্টটি ছিল গুচের জন্য সফল। ফাইনালে ৩৫ রানসহ পুরো টুর্নামেন্টে ৮ ইনিংসে প্রায় ৫৯ গড়ে করেছিলেন ৪৭১ রান, যার মধ্যে ছিল ৩ টি হাফ সেঞ্চুরি ও ১টি সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হয়েছিলেন।

গুচের দুর্ভাগ্য অব্যাহত থাকল পরের বিশ্বকাপেও। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের পরের আসরেও ফাইনালে উঠে আসে ইংল্যান্ড, প্রতিপক্ষ ইমরান খানের নেতৃত্বে উজ্জীবিত পাকিস্তান। গুচের জন্য আলাদা অনুপ্রেরণা ছিল এই আসরে, দলের অধিনায়ক যে তিনিই ছিলেন।

ফাইনালের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে গ্রুপ পর্বের দেখায় মাত্র ৭৪ রানে অলআউট করেও বৃষ্টির কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। তবে ফাইনালে অধিনায়ক ইমরান খানের ৭২ রানের ইনিংসে ভর করে ইংলিশদের সামনে ২৫০ রানের লক্ষ্য দেয় পাকিস্তান।

আগেও দুবার ফাইনালে উঠে দুবারই রান তাড়া করতে ব্যর্থ হয়েছিল ইংলিশরা। তার ওপর এই আসরেই প্রথম ফ্লাডলাইটের ব্যবহার শুরু হয়। ইংলিশদের ওপর চাপটা তাই বেশিই ছিল। সেই চাপেই কি না, স্কোরবোর্ডে ৬৯ রান জমা হতেই ড্রেসিংরুমে ফেরত যান ৪ ইংলিশ ব্যাটসম্যান। অ্যালান ল্যাম্বকে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন নিল ফেয়ারব্রাদার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যের চেয়ে ২২ রান দূরেই থামতে হয় ইংলিশদের।

আগের দুই ফাইনালের মতো এই ফাইনালেও ব্যাট হাতে ব্যর্থ গুচ। ওপেন করতে নেমে ৬৬ বল খরচায় রান করতে পেরেছিলেন মাত্র ২৯। বিশ্বকাপে এটিই ছিল গুচের শেষ ম্যাচ। মোট চারটি বিশ্বকাপ খেলে ২১ ম্যাচে ৪৪.৮৫ গড়ে ৮৯৭ রান করেছিলেন। ২১ ম্যাচে ফিফটি করেছিলেন ৮টি, তবে তিন অঙ্ক ছুঁতে পেরেছিলেন মাত্র একবারই।

বর্তমানে খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল হারার যন্ত্রণা পেয়েছেন কেবল লাসিথ মালিঙ্গা। এবার কি দুর্ভাগ্যের রেকর্ডে মালিঙ্গাকে সঙ্গী হিসেবে পাবেন গুচ? নাকি তাঁকে একাই বয়ে বেড়াতে হবে এই রেকর্ড!

গুচের দুঃখটা ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় দুঃখ’ও হয়ে আছে। ক্রিকেটের জন্মভূমি নাকি ইংল্যান্ড, সেই তারা এখনো একবারও জেতেনি বিশ্বকাপ! টি-টোয়েন্টির মুকুটও তার সান্ত্বনা হতে পারেনি। কে জানে, হয়তো এবার গুচ আর ইংল্যান্ডের দুঃখ মুছে যাবে হয়তো!

আরও পড়ুন:-