ওয়ালশ জানতেনই না রেকর্ডটা ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে

ডাবলিনের ক্লনটার্ফ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ। আজ ২০ বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপের আগে সেই ক্লনটার্ফেই ক্যারিবীয়দের মুখোমুখি মাশরাফির দল। ছবি: টুইটার
ডাবলিনের ক্লনটার্ফ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ। আজ ২০ বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপের আগে সেই ক্লনটার্ফেই ক্যারিবীয়দের মুখোমুখি মাশরাফির দল। ছবি: টুইটার
>

আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ আজ। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

চেহারার মধ্যে ভারিক্কি খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই ছিল, ভেতরের মানুষটা যদিও একেবারেই অন্য রকম। আমুদে। কিন্তু বাইরে কাঠিন্যের খোলস। দারুণ সুইংয়ে ব্যাটসম্যানদের ঘায়েল করার পর তির্যক চোখে যখন তাকাতেন, কপালে বেশ কটা ভাঁজ পড়ত। এখন তো চালশের চশমা চোখে। কোর্টনি ওয়ালশের মধ্যে একটা মাস্টারমশাইয়ের ভাব এসেছে। সেই চশমা নাকের ডগায় ঠেলে, কপালে গোটা কয় বলিরেখা স্পষ্ট করে ওয়ালশ বললেন, ‘তাই নাকি, কী বলো!’

এবারের বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য একদিক দিয়ে বৃত্তপূরণ। প্রথম বিশ্বকাপ খেলার ২০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আবার সেই ইংল্যান্ড! এবং ক্লনটার্ফও! আজ যে মাঠে বাংলাদেশ খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ দুয়ারে রেখে এই মাঠে আসার পর দলের অন্তত দুজন স্মৃতিকাতর হতেই পারেন। তারিখটা ২১ মে হলে আরও ভালো হতো!

সেদিন বাংলাদেশ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে ক্যারিবীয়দের মুখোমুখি হয়েছিল, এই মাঠেই। সেই ম্যাচের দুজন খেলোয়াড় এখানেই আছেন। সেবার ভিন্ন ড্রেসিংরুম, এবার সতীর্থ। মিনহাজুল আবেদীন বাংলাদেশ দলের প্রধান নির্বাচক, ওয়ালশ বোলিং কোচ।


বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ ছিল বলে সে ম্যাচের প্রায় সব স্মৃতিই মিনহাজুলের মনে আছে। ওই বিশ্বকাপটা প্রতিটা মুহূর্তই শখের ডাকটিকিটের মতো জমিয়ে রাখবেন স্মৃতির অ্যালবামে। কিন্তু ওয়ালশের জন্য তো তা নয়।

ম্যাচটা ওয়ালশ মনে রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু আসল যে তথ্যটা মনে রাখা উচিত ছিল, সেটাই বেমালুম ভুলে বসেছেন। বিশ্বকাপে সেরা বোলিং ফিগারটা বাংলাদেশের বিপক্ষে জানার পর বিস্মিতই হলেন। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘হুম হুম, মনে পড়ছে। খুব ঠান্ডা ছিল, খুব ঠান্ডা!’ নিজে থেকেই জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, কোন মাঠে খেলাটা হয়েছিল বলো তো!’ এই ক্লনটার্ফে!

ক্রিকেট কত কিছুই না মিলিয়ে দেয়! সেই প্রথমের পর আজ ৩৫তমবার ক্যারিবীয়দের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে যে দলের বিপক্ষে প্রথম জয় পাওয়ার পর থেকে চিত্রটা বদলে গেছে।

কিন্তু তখন তো আর তা ছিল না। রাজত্ব হারালেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঠাঁটবাট ছিল। ওয়ালশ, লারা, অ্যামব্রোস নামগুলো শুনলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যেই শিহরণ খেলে যেত।

এতটাই যে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির কীর্তির পর বিশ্বকাপেও প্রথম ফিফটির কীর্তি গড়া মেহরাব হোসেন পরে বলেছিলেন, ওয়ালশ তাঁকে বল করতে রানআপ থেকে ছুটে আসছেন, তা তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না! তা হতেও পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই ফিফটির পর হেলমেট খুলে মেহরাবের উচ্ছ্বাসের ঢেউ তোলা উদ্‌যাপন এখনো হয়তো অনেকেরই মনে আছে।

মেহরাবের ১২৯ বলে ৬৪ রানের সেই ইনিংসের সৌজন্যে বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ১৪০ রানও তুলে ফেলেছিল। সে সময়কার বাংলাদেশ আর কন্ডিশন বিবেচনায় চোখ কচলে তাকানোর মতোই স্কোর। কিন্তু এরপর ৪২ রান যোগ করতেই বাংলাদেশ ১৮২ রানে অলআউট। ওয়ালশের কারণেই এই ধস। তাঁর ৪ উইকেটের ৩টিই যে এ সময়।

ওয়ালশ এত বিস্তারিত মনে রাখেননি। এমনকি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষেই সেরা বোলিং কীর্তির কথাটা মনে না রাখার ব্যাখ্যা দিলেন ‘আমি পরিসংখ্যান ততটা মনে রাখি না’ বলে। ওয়ানডের হলে হয়তো আরও নয়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ উইকেটেই জিতেছিল। তবু সে ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াসাংবাদিকেরা বেশ কাব্যগাথা করেছিলেন। বিশ্বকাপের মতো আসরে মেহরাবের ফিফটির বড় ভূমিকা ছিল তাতে। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে ফিফটি করেছিলেন মাত্র ৯ জন। ফিফটি সংখ্যা ১৬। একটি মাত্র সেঞ্চুরি। এখন বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে একটি হলেও ফিফটি করেছেন এমন খেলোয়াড়ের ৪৯, ফিফটি ৩৩৩। ১৬ জন করেছেন সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরিসংখ্যার ফিফটি পূর্ণ হয়েছে সাব্বিরের ডানেডিনের ইনিংসটি দিয়ে।

আরও একটা কারণে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ বাহবা পেয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৮৩-র লক্ষ্য ছুঁতে ৪৭ ওভার পর্যন্ত খেলাতে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশ। সে সময় এসবই যে ছিল অনেক বড় পাওয়া। মিনহাজুলের ওই ম্যাচের তাই সবই মনে আছে। আরও বেশি করে মনে আছে এ কারণে, আলোচনার ঝড় তুলে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিলেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল এই ক্লনটার্ফেই।

‘কন্ডিশন তো তখন আমাদের জন্য একেবারেই অচেনা ছিল। তার ওপর হাড়–কাঁপানো ঠান্ডা। খুব কষ্ট হয়েছিল খেলতে। এ রকমই আবহাওয়া ছিল’—মিনহাজুল বলছিলেন। সেই ম্যাচে ব্যাট করতে নামার সময় মানসিকভাবে চাপে ছিলেন কি না, এমন প্রশ্নটা অবশ্য এড়িয়ে গেলেন। ৫ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, তথ্যটা আমলেই নিলেন না, ‘এর পরের ম্যাচেই তো ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলাম।’ হুম, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ। পরের ম্যাচে আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফিফটি। পরপর দুই ফিফটিও তো তখন প্রায় অভাবিত ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তবে ক্লনটার্ফের ম্যাচটা মিনহাজুল মনে রাখবেন বোলার হিসেবে, ‘আমি বেশ ভালো বোলিং করেছিলাম মনে পড়ছে (৭ ওভারে ২৮ রান)। একটা উইকেটও কিন্তু নিয়েছিলাম।’ 

‘একটা উইকেট’ বলার সময় বেশ গর্বের সুর খেলে গেল তাঁর কণ্ঠে। তাঁর মতো পার্টটাইমারের জন্য তখন একটা উইকেট পাওয়াও বিশাল আনন্দের ছিল। তবে এই গর্ব ‘সেই বাংলাদেশ’ প্রেক্ষাপটের জন্য নয়।
উইকেটটা যে ছিল ব্রায়ান লারার!