বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ - পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে ভয়!

>
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বোলিং পরিসংখ্যান আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বোলিং পরিসংখ্যান আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। ফাইল ছবি

প্রথম ম্যাচে শেষ পর্যন্ত বোলাররাই তৈরি করে দিয়েছেন জয়ের পথ। কিন্তু বাংলাদেশের বোলিংয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। ক্লনটার্ফে সিরিজের প্রথম ম্যাচের বোলিং ধরে রাখতে পারবেন তো মাশরাফিরা? 

সিরিজে নিজেদের প্রথম ম্যাচ। ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডিং করতে এসেছেন বলে মোস্তাফিজুর রহমানকে একদম কাছেই পাওয়া গেল। মুখটা ডাবলিনের আকাশের মতো ভার হয়েই ছিল। ফুঁ দিয়ে এত দিন ঠান্ডা করার কায়দা দেখা গেছে; এখানে উল্টোটা—ফুঁ দিয়ে হাত গরম! দুই হাত চরকির মতো ঘোরাচ্ছেনও। বল আসুক আর না আসুক, শরীরটাকে সব সময় সচল রাখতে হচ্ছে। নিজের ৩ ওভারের প্রথম স্পেলে ২৬ রান দিয়েছেন, এর মধ্যে আরও এক ডজন ওভার হয়ে গেলেও অবশ্য দ্বিতীয় স্পেলের ডাক আসেনি।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে একের পর এক অবিস্মরণীয় যাত্রায় মূল ভূমিকা ছিল পেসারদের, আরও স্পষ্ট করে বললে, মোস্তাফিজের। বাংলাদেশ একসময় চার পেসার নিয়ে খেলার সাহসও দেখিয়েছে নিয়মিত। সেটি তখন পরের বিশ্বকাপের জন্য একটা সুখকর বিনিয়োগ বলেই মনে হচ্ছিল ইংলিশ কন্ডিশনের কথা ভেবে।

কিন্তু বিশ্বকাপ যত ঘনিয়ে আসছে, সেই বিনিয়োগে তহবিল তছরুপের আশঙ্কা! টেস্টে স্পিনারদের সৌজন্যে দারুণ কিছু সাফল্য এলেও ওয়ানডেতে কখনো কখনো সেটিও দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। 

গত এক বছরে বাংলাদেশের সেরা চার বোলারের তিনজনই পেসার, এই তথ্যে শুভংকরের ফাঁকি আছে। শুরুর সেই কাটারের ধার হারিয়ে ফেলেও মোস্তাফিজ এই সময়ে ক্লনটার্ফে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগপর্যন্ত ১৬ ম্যাচে ২৬ উইকেট নিয়েছেন। গড় (২৬.৬৫), ইকোনমি (৪.৮২) দুটোই ভালো। কিন্তু সর্বশেষ দুই ওয়ানডেতে ২০ ওভার দিয়েছেন ১৭৭ রান। নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে ৯৩ রান, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে ৮৪! 

এখানে প্রথম ম্যাচের আগপর্যন্ত ১২ মাসের এই সময়টায় অধিনায়ক মাশরাফি ১৮ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়েছেন। গড় ৩৭.৭৬ কিংবা ইকোনমি রেট ৫.০৬ কোনোটাই আশাপ্রদ নয়। ১১ ম্যাচে ১৫ উইকেট রুবেল হোসেনের। ত্রিশের ওপরে গড় আর ছয়ের কাছাকাছি ইকোনমি। 

সেরা পাঁচের বাকি দুজন স্পিনার। দুজনের ইকোনমি চারের কিছুটা ওপরে, সেটি আাশার কথা। কিন্তু ১৭ ম্যাচে ১৯ উইকেট নেওয়া মেহেদী মিরাজ একেকটা উইকেট নিতে ৩২ রান খরচ করেছেন। ১০ ম্যাচে ১২ উইকেট নেওয়া সাকিবের খরচা ৩৪ রান। 

এই এক বছরে বাংলাদেশ দেশের বাইরেই খেলেছে বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের পর আরব আমিরাতে এশিয়া কাপ। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি সিরিজ খেলে আবার নিউজিল্যান্ড সফর। কিন্তু পেস সহায়ক কন্ডিশন পেয়ে পেসার কিংবা স্পিনারদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া কন্ডিশনে সাকিব-মিরাজরা অন্তত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেননি। নিয়মিত উইকেট তুলে নিতে না-পারার এই ব্যর্থতা আরও একটি পরিসংখ্যানে বোঝা যায়। দুই বছরে ৩২ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে অলআউট করতে পেরেছে মাত্র সাতবার।

বোলারদের এই পরিসংখ্যানের বৃত্তান্ত কি আর কোচ স্টিভ রোডসের ল্যাপটপে নেই? তিনি অবশ্য আলতো পুশে দায়টা ঠেলে দিতে পারেন কোর্টনি ওয়ালশ আর সুনীল যোশির দিকে। অবশ্য টেস্টের একদার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ওয়ালশের নিজেরই ওয়ানডে বোলিং ছিল সাদামাটা। ১ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার অবিস্মরণীয় কীর্তি আছে, কিন্তু ওয়ানডেতে ৫ উইকেট ওই একবারই! ওয়ালশ কি তবে সাদা বোলিংয়ের মন্ত্রটা জানেন না! নাকি ভালো ছাত্র ভালো শিক্ষক নাও হতে পারে তত্ত্বটাই তাঁর বেলায় সত্যি? 

পেস বোলিংটা বিশেষ করে আলোচনায় থাকছে এবারের বিশ্বকাপের কারণে। প্রায় সব দলই পেস-নির্ভর বোলিং আক্রমণ সাজাচ্ছে, তা সে যতই ‘ড্রাই ইংলিশ সামারে’র কথা বলা হোক না কেন। 

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেরা বোলার ছিলেন শেন ওয়ার্ন, এই তথ্যেও যেমন আছে শুভংকরের ফাঁকি। ওই আসরে ৫৪৮ উইকেটের ৪৬১টি নিয়েছিলেন পেসাররা। ৮৭ উইকেট স্পিনারদের। জিওফ অ্যালটের সঙ্গে যৌথ সর্বোচ্চ ২০ উইকেট নিয়েছিলেন ওয়ার্ন, আবার মুত্তিয়া মুরালিধরন ৫ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ওই আসরে কমপক্ষে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন এমন ২২ বোলারের ২০ জনই ছিলেন পেসার।

আয়ারল্যান্ডে আসার পর দলের অনুশীলনে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা সাংবাদিকদের চোখ এড়ায়নি, ওয়ালশ নিজেও যেন হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব তাঁর মধ্যে। সুনীল যোশি অবশ্য বেশ তৎপর। কিন্তু যোশির অতি সক্রিয়তা কিংবা ওয়ালশের আধা-নিষ্ক্রিয়তায় দল কতটা উপকৃত হচ্ছে বলা মুশকিল। অন্তত প্রস্তুতি ম্যাচে দলের বোলিং দেখে ভয়টা বেড়েছে ছাড়া কমেনি। 

প্রথম ম্যাচ চলার সময়েই এই লেখার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার সময়েও বাংলাদেশের বোলিং আশাপ্রদ ছিল না। ৪০ ওভারে ২ উইকেটে ১৯৭ রান তুলে ফেলেছিল। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের বোলাররা, বিশেষ করে মাশরাফি ৩ উইকেট তুলে নিয়ে দারুণভাবে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন দলকে। 

শেষ পর্যন্ত সিরিজের প্রথম ম্যাচে এক মোস্তাফিজ বাদে বাকি চার বোলারই দারুণ বল করেছেন। ছন্দ ফিরে পাওয়াদের ছন্দ ধরে রাখা আর মোস্তাফিজের ছন্দ ফিরে পাওয়ার আশায় থাকবে বাংলাদেশ। ক্রিকেট হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদেরই খেলা; কিন্তু যতই আইসিসি ব্যাটিং–সহায়ক উইকেট বানাক কিংবা ইংলিশ ড্রাই সামারের পূর্বাভাস দিক আবহাওয়া দপ্তর; ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত বোলাররাই জেতাবেন। আরও স্পষ্ট করে বললে পেসাররাই।