মোস্তাফিজ কি খারাপ বোলিং করছেন, নাকি...?

মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

৪৩ ইনিংসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫০-এর বেশি রান দিয়েছেন ১২ বার। ১০ বারই গত দুই বছরে। ক্যারিয়ারে ১৬ বার চার কিংবা এর নিচে ইকোনমি রেট ছিল। এর ১০ বারই ২০১৮ সাল কিংবা এর পর থেকে। দুটি পরিসংখ্যানই মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে। এ বছরের শুরুতেই আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে যে জায়গা করে নিলেন, কেবল নামের কারণে তো অবশ্যই নয়। ২০১৮ সালে মোস্তাফিজ ধারাবাহিক ছিলেন বলেই তো!

মোস্তাফিজকে নিয়ে আসলে দুটি ছবিই সত্যি। যেদিন খারাপ করছেন, একেবারেই খারাপ করছেন। আর যেদিন ভালো করছেন, চোখেই পড়ছে না তেমন করে। ক্যারিয়ারের শুরুতে জাদুকরী সব স্পেল করে নিজেই প্রত্যাশার পারদটা উঁচুতে বেঁধেছেন। না হলে ২০১৮ সাল থেকে গত এক বছরের কিছুটা বেশি সময়ে ওয়ানডেতে তাঁর বোলিং যে কোনো বোলারের কাছেই পরম প্রার্থনীয়। ২২ ম্যাচে ৩৫ উইকেট। গড় (২৫.২৮) ও ইকোনমি (৪.৭৩) দুটিই ওয়ানডে বোলিংয়ের জন্য আদর্শ। এই হিসাব গত দুই ম্যাচে দেওয়া ১৭৭ রান যোগ করার পরও।

সাকিব আল হাসান আগের দিনই বলেছেন, কেবল নিরেট রান দেওয়ার বিচারে মোস্তাফিজের বোলিং দেখলে হবে না। কেন হবে না সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘শুধু তো ওর রান দেওয়াটা দেখলে হবে না, ও কোথায় বোলিং করছে, সেটাও দেখতে হবে। বাকিরা তো ও রকম সময়ে (ডেথ ওভারে) এত বেশি বল করে না। এটা কিন্তু বুঝতে হবে। ওই রকম সময়ে, শেষ ১০ ওভারে ওর জন্য ৪ ওভার রাখা হয়। ওই ৪ ওভারে সাধারণ হিসাবে ধরা হয় কেউ যদি ৩৫ রানের কম দেয়, তাহলেই সে ভালো বোলার। এর আগে ৪ ওভারে ও যদি ৩০ রানও দেয়, শেষের ৩৫ যোগ করলে এমনিতেই তো ৬৫ রান হয়ে গেল। প্রতিটা খেলোয়াড়েরই দলে একেকটা ভূমিকা নির্দিষ্ট করা আছে। ফলে শুধু স্কোরবোর্ড দেখে একেকজন খেলোয়াড়ের মান যাচাই করলে সেটা ভুল হবে।’

পরিসংখ্যান যে গর্দভ—চিরকালীন আপ্তবাক্যটাই বলতে চাইলেন সাকিব। কিন্তু এও তো সত্যি, ক্রিকেট আখেরে পরিসংখ্যান আর রেকর্ডের খেলা।

পরিসংখ্যানই বলে দেবে, ২০১৮ সাল থেকে মোস্তাফিজের বোলিংয়ের ধরনটা আসলে কেমন ছিল। বছর শুরুর ত্রিদেশীয় সিরিজে ৫ ম্যাচে ৭ উইকেট নিলেও তাঁর বোলিংয়ে হাঁসফাঁস করেছে ব্যাটসম্যানরা। ওই সিরিজে ইকোনমি ছিল সোয়া তিনেরও কম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট, ইকোনমি ছয়ের নিচেই। এশিয়া কাপে আবার গড় (১৮.৫০) ও ইকোনমি (৪.৪০) দুটিতেই ‘ফিজীয় থেরাপি’। এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে ফাইনালে তোলার অন্যতম নায়ক। টুর্নামেন্টের যৌথ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এর পর জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও হোম সিরিজে দারুণ বোলিং করেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কথা হচ্ছে কেন? কথা হচ্ছে আগের সেই কাটারের জাদু প্রায় মোস্তাফিজের হাত থেকে বেরোচ্ছেই না। কোনো পেসারের আত্মবিশ্বাসের পরিমাপক যে ইয়র্কার, সেটিও দিতে দ্বিধায় ভুগছেন বোঝা যায়। এই সময়েই কখনো কখনো তাঁর স্ট্রাইক রেট (উইকেট পেতে গড়ে কতটা বল) কখনো ৫৪, কখনো ৪০; বেশির ভাগ সময় ত্রিশের আশপাশে। গড় স্ট্রাইক রেট ৩২, একেকটা উইকেট পেতে মোস্তাফিজকে আসলে ৫ ওভারের বেশি বল করতে হয়েছে। এই মোস্তাফিজই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ৩ ম্যাচে ১৩ উইকেটের রেকর্ড দিয়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, মোস্তাফিজের ডট বলগুলো কমে আসছে, যে ডট বলের জন্য আইপিএলেই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। ডেথ ওভারে তাঁকে বোলিং আক্রমণে আনলেই বড় পর্দায় লেখা উঠত: আনলিশ দ্য ফিজ!

মোস্তাফিজ আর তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা অভিমান করতেই পারেন এই ভেবে, ছেলেটা এক দিন একটু খারাপ করলেই হয়! সত্যি বলতে, তাঁর স্বজন সমাবেশে এমন একটা আলোচনা আছে বলেই শোনা যায়। কিন্তু এই বাস্তবতাও বুঝতে হবে, এই যে এক ম্যাচে ভালো করতে না-পারলেই কথা ওঠা, সেটি বোলারের নাম মোস্তাফিজ বলেই। আর সেই ‘কথা ওঠা’ তাঁর সামর্থ্যকে সংশয়বিদ্ধ করতে নয়; বরং তাঁর সামর্থ্য আরও অনেক বেশি—এই সত্যিটা সবার জানা বলেই। বিশ্বকাপে তিনি অন্যতম ভরসা বলেই।

মোস্তাফিজ নিয়ে আসলে সেরা কথাটা বলেছেন স্টিভ রোডস। কাল বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশ কোচ বলেছেন, মোস্তাফিজের ব্যাপারে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, ‘আমি ওকে নিয়ে চিন্তিত নই। সে ওয়ানডেতে খুবই দুর্দান্ত বোলার। খুব বেশি দিন হয়নি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ পাঁচে ছিল। বাংলাদেশের খুব বেশি খেলোয়াড় নেই যারা র‍্যাঙ্কিংয়ের সেরা পাঁচে থাকতে পেরেছে। হ্যাঁ, আরেকটু ধারাবাহিক হতে হবে।’