সাংবাদিকেরা যে 'বিপদে' পড়েছেন বিশ্বকাপে

বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের সময় পার্থক্যের কারণে হিমশিম খেতে হবে সাংবাদিকদের। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের সময় পার্থক্যের কারণে হিমশিম খেতে হবে সাংবাদিকদের। ছবি: প্রথম আলো

শনিবার বিকেল পাঁচটায় বাংলাদেশ দলের অনুশীলন শেষ হতেই হঠাৎ মনে হলো, আজ আর কিছুই করার নেই! অথচ দিন শেষ হতে তখনো প্রায় ৫ ঘণ্টা বাকি। কার্ডিফে ‘রাত’ সাড়ে ৯টায়ও দিনের আলো ফুরোয় না। কিন্তু তাকে কী আসে-যায় ঢাকার নিউজরুমের!

সময় ঘড়ি যে কত বিচিত্র, দূর ভূগোলে এলে খুব ভালোভাবে অনুভূত হয়। সাংবাদিকদের কাছে তো সেটা আরও বেশি, তাঁদের যে মেনে চলতে হয় তখন দুটো ঘড়ি। একটা নিজ দেশের, আরেকটা বর্তমান অবস্থানের। দুটির ভারসাম্য রক্ষা না করতে পারলেই বিপদ! কাল যেমন মাশরাফিদের অনুশীলন শুরুর আগেই লিখতে বসে গেলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা। লেখার ফাঁকে সংবাদ সম্মেলন আর অনুশীলন শেষ হওয়ার আগেই শেষ ডেডলাইন! যেন তেড়েফুঁড়ে উইকেটে গিয়ে থিতু হওয়ার আগেই ইনিংস শেষ!

সোফিয়া গার্ডেনস থেকে বেরিয়ে কার্ডিফের বিকেলটা লাগে অদ্ভুত মায়াময়। সোনালি রোদ্দুরে সাজানো-গোছানো, ছিমছাম, নীরব শহরটা কী আশ্চর্য সুন্দর! কার্ডিফে পরিচয় হওয়া বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালক সাঈদকে ফোন দিতেই জানালেন, বিকেলটা আরও উপভোগ্য লাগবে যদি যাওয়া হয় ‘কার্ডিফ বে সি ফ্রন্টে’। সোফিয়া গার্ডেনসের অবস্থান যে সড়কে, ক্যাথেড্রাল রোড থেকে কার্ডিফ সাগরে যেতে লাগে মাত্র ১০ মিনিট। ঢাকায় হলে এক ঘণ্টায় যাওয়া যেত কি না, সন্দেহ!

কার্ডিফ শহরের মতো সাগরটাও ভীষণ শান্ত, হৃদয়ে কেমন শান্তির হাওয়া বয়ে গেল। অবশ্য এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন। হিম বাতাস হাড়ে যে ভীষণ কাঁপন ধরায়। তবে স্থানীয় লোকজনের কাছে এটা কোনো ঠান্ডাই না। এই শীতে শর্টস পরে দিব্যি তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তীব্র শীত অনুভব হয় শুধু উষ্ণ দেশ থেকে যাওয়া অতিথিদের। কার্ডিফ বে ভিউ পয়েন্ট থেকে হার্বার রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে নরওয়েজিয়ান চার্চ আর্ট সেন্টার। চার্চ পেরোতেই থমকে দাঁড়াতে হলো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক আলোকবর্তিকার মূর্তি দেখে। কোনো বাঙালির নয় তো?

আসলেই তা-ই। মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হচ্ছেন শ্রী চিন্ময়, চিন্ময় কুমার ঘোষ, একজন মহাত্মা ও হিন্দুধর্মের সংস্কারক। ১৯৩১ সালের ২৭ আগস্টে তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরা গ্রামে। বহুপ্রজ চিন্ময় ঘোষ একই সঙ্গে লেখক, শিল্পী, কবি ও সংগীতজ্ঞ। ১২ বছরে মা-বাবাকে হারানোর পর চলে যান আশ্রমে। আশ্রমেই কাটে তাঁর ২০ বছর। ১৯৬৪ সালে চিন্ময় পাড়ি জমান নিউইয়র্ক সিটিতে। সেখানে শুরু তাঁর যোগধর্ম চর্চা। নিউইয়র্কের কুইন্স শহরে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মেডিটেশন সেন্টার। শুধু আধ্যাত্মিক গুরুই নন, ছিলেন একজন অ্যাথলেটও। প্রতিযোগিতামূলক দৌড়, সাঁতার ও ভারোত্তোলনে অংশ নিয়েছেন নিয়মিত। নিজে দৌড়বিদ ছিলেন বলেই কিনা, তাঁর ফাউন্ডেশন ‘পিস রান’ থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত আয়োজন করা হয় ম্যারাথন। বিশ্বজুড়ে শান্তি আর সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই এই দৌড় প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য।

সারা জীবন মানবকল্যাণে কাজ করা চিন্ময়ের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, মিখাইল গর্ভাচেভ, ডেসমন্ড টুটুদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। ২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিলেন তিনি। নোবেল না পেলেও ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর মর্ত্যলোক ছেড়ে যাওয়া চিন্ময় ঘোষের প্রাপ্তির তালিকা কম দীর্ঘ নয়। তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধ হয় মানুষের ভালোবাসা। না হলে এই কার্ডিফে তাঁর মূর্তি স্থাপিত হবে কেন? চিন্ময় ঘোষকে সম্মান জানাতে ২০১২ সালের ১১ মার্চ কার্ডিফ শহরের মেয়র ডলমে বয়েন উন্মোচন করেন মূর্তিটা। যেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিশ্ব সম্প্রীতি-শান্তির মূর্তি।’

কার্ডিফ সাগরের পাড়টা এমনিতেই বড় শান্তিময়। জায়গাটার যথার্থতা প্রমাণেই যেন বসানো হয়েছে চিন্ময় ঘোষের মূর্তিটা। কার্ডিফ তাহলে বাংলাদেশের কাছে শুধু ক্রিকেটীয় কারণেই স্মরণীয় নয়, এ শহর বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে এক বাঙালিকেও।