চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল: কেমন হবে দুই দলের কৌশল?

কার ভাগ্যে জুটবে শিরোপা? লিভারপুল না টটেনহাম? ছবি: টুইটার
কার ভাগ্যে জুটবে শিরোপা? লিভারপুল না টটেনহাম? ছবি: টুইটার
>আজ রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হবে দুই ইংলিশ ক্লাব—টটেনহাম হটস্পার ও লিভারপুল। লিভারপুলের চোখে ষষ্ঠ শিরোপা জেতার স্বপ্ন। ওদিকে টটেনহাম চাইছে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার স্বাদ নিতে। কার ভাগ্যে রয়েছে শিরোপা? তা ভীষণভাবে নির্ভর করবে দুই কোচের কৌশলের ওপর

লিভারপুলের পাঁড় ভক্ত না হলে দেয়ান লভরেনকে পছন্দ করার মতো লোক এই বিশ্বে খুব বেশি পাওয়া যাবে না।

২০১৪ সালে সাউদাম্পটন থেকে লিভারপুলে এসেই লিভারপুল সমর্থকদের মন জিততে পারেননি লভরেন। অত ভালো খেলতেন না, তাঁর কিছু শিশুসুলভ ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে লিভারপুলকে। এমনও হয়েছে টটেনহামের বিপক্ষে এক লিগ ম্যাচে ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেইনের কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে মাঠ থেকে উঠে এসেছিলেন প্রথমার্ধ শেষ হতে না হতেই। ভালো না খেললেও মুখ কখনোই থেমে থাকেনি ক্রোয়েশিয়ান এ সেন্টারব্যাকের। কখনো ইনস্টাগ্রামে রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়ক সার্জিও রামোসের সঙ্গে কথার লড়াই, গালিগালাজ, কখনো নিজেকে প্রকাশ্যে বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে আখ্যা দেওয়া, কখনো লিভারপুলকে অপরাজেয় হিসেবে ঘোষণা দেওয়া—লাগামহীন মুখের জন্য গত কয়েক বছরে লভরেন কম ঠাট্টার পাত্র হননি। লভরেন সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন অনেক নির্ভরযোগ্য সেন্টারব্যাক হিসেবে রূপান্তরিত হলেও তাঁকে নিয়ে ফুটবলপাড়ায় বেশ ভালোই হাসাহাসি হয়। সেই লভরেনই গতকাল ইনস্টাগ্রামে একটা পোস্ট দিলেন।

বছরখানেক আগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হারের পর লভরেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এটাই শেষ নয়। লিভারপুল সামনের বছরেই আবার ফিরে আসবে বিপুল বিক্রমে। তখন যথারীতি লভরেনকে নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয়েছিল। তাঁর আর দশটা কথার মতো এ কথাকেও অনেকে ফাঁকা বুলি হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কাল লভরেন সেই উক্তির একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে ক্যাপশনে জানিয়ে দিলেন, তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে জানেন।

হ্যাঁ। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে লিভারপুল। গত বছরের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে বিপুল বিক্রমে। গতবারের শিরোপাজয়ী রিয়াল মাদ্রিদ মুখ থুবড়ে পড়লেও লিভারপুল অবিচল ছিল নিজেদের লক্ষ্যে। যে কারণে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের এক বছর পর আবারও ফাইনালে উঠে এসেছে লিভারপুল। এবার তাঁদের প্রতিপক্ষ আরেক ইংলিশ ক্লাব—টটেনহাম হটস্পার।

লিভারপুল কোচ ইউর্গেন ক্লপ জানেন, দিনের শেষে শিরোপাজয়ই মুখ্য। দেখানোর মতো স্মারক না থাকলে শিরোপাবুভুক্ষু এ প্রজন্ম উন্নতির মর্যাদা দিতে জানে না। গত কয়েক বছরে লিভারপুল যে আসলেই উন্নতি করেছে, সেটি বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য হলেও এ শিরোপাটা জেতা বড্ড দরকার ক্লপের।

গত কয়েক বছরে লিভারপুলের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। ছবি: এএফপি
গত কয়েক বছরে লিভারপুলের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। ছবি: এএফপি

দেখানোর মতো শিরোপা না থাকলে মানুষ উন্নতির মর্যাদা দিতে জানে না, এ ব্যাপারটা ক্লপের মতোই আরেকজন জানেন। তিনি মরিসিও পচেত্তিনো। ভদ্রলোক টটেনহাম হটস্পারের কোচ। পাঁচ বছর ধরে পাদপ্রদীপের আড়ালে থেকে দলটার উন্নতি করে চলেছেন অবিরাম। কিন্তু ওই একটাই সমস্যা—দেখানোর মতো শিরোপা নেই। শিরোপা নেই দেখে মানুষ বুঝতেও চায় না কোচ হিসেবে পচেত্তিনো কত ভালো, কত প্রজ্ঞাবান। যে টটেনহাম আগে চেলসির সঙ্গে একটা ম্যাচ জিতলে সেটা উদ্‌যাপন করতে ডিভিডি বের করত, সে দলই এখন ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে শীর্ষ দুই ক্লাবের একটি। পাঁচ বছর ধরে ইউরোপের অন্যতম কঞ্জুস মালিকের অধীনে কাজ করে দলকে নিয়ে এসেছেন আজকের পর্যায়ে। টটেনহাম নতুন স্টেডিয়াম বানিয়েছে দেখে গত দুটি দলবদলের বাজারে একটা খেলোয়াড় কিনতে পচেত্তিনো একটি কানাকড়িও পাননি। উল্টো দল থেকে বিদায় নিয়েছেন মুসা দেম্বেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়েরা। তা–ও সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, এই মৌসুমে সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন পচেত্তিনো।

টাকা না ঢেলেও যে দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নিয়ে যাওয়া যায়, দেখিয়েছেন পচেত্তিনো। ছবি: এএফপি
টাকা না ঢেলেও যে দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নিয়ে যাওয়া যায়, দেখিয়েছেন পচেত্তিনো। ছবি: এএফপি

অপেক্ষা শুধু একটি শিরোপার। এই শিরোপা জেতার জন্যই আজ রাতে প্রজন্মের অন্যতম সেরা দুই কোচ—ক্লপ আর পচেত্তিনো অবতীর্ণ হবেন কৌশলের লড়াইয়ে। কোন কোচের কৌশল কেমন হবে? আসুন দেখে নেওয়া যাক!

লিভারপুল
মৌসুমের শেষ দিকে দলের মূল স্ট্রাইকার রবার্তো ফিরমিনোকে চোটের কারণে না পেলেও আজ রাতে ফিরমিনোকে পাচ্ছেন ক্লপ। দলে চোটের তেমন সমস্যা নেই। গোটা স্কোয়াড থেকে নিশ্চিন্তেই একাদশের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করতে পারবেন লিভারপুল কোচ। পুরো মৌসুমেই মোটামুটি ৪-৩-৩ ছকে দলকে খেলানো ক্লপ এ ম্যাচেও ৪-৩-৩ ছককেই বেছে নেবেন হয়তো।

গত ফাইনালে গোলরক্ষক লরিস ক্যারিয়াসের দুই ভুলের চূড়ান্ত মাশুল দেওয়া লিভারপুল গোলপোস্টের নিচে এবার আছেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক অ্যালিসন। লিভারপুলের ফাইনাল খেলায় দুর্দান্ত মৌসুম কাটানো এ তারকার ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রথম রাউন্ডের শেষ ম্যাচে নাপোলির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে অ্যালিসন নিশ্চিত গোল না ঠেকালে আজ হয়তো লিভারপুলের জায়গায় অন্য কোনো দল থাকত ফাইনালে। অ্যালিসনের সামনে থাকবেন চার ডিফেন্ডার—দুজন সেন্টারব্যাক, একজন করে রাইটব্যাক ও লেফটব্যাক।

রক্ষণভাগের মাঝে ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে জল মাতিপের জুটি বাঁধার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাই বলে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে মাতিপের জায়গায় তরুণ ইংলিশ সেন্টারব্যাক জো গোমেজের অন্তর্ভুক্তি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মৌসুমের শুরুতে ফন ডাইকের সঙ্গী হিসেবে গোমেজই খেলতেন। পায়ের চোটে পড়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে গোমেজের জায়গায় এসেছেন মাতিপ। গোমেজের এখন চোটসমস্যা নেই, বার্সেলোনার বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগও খেলেছেন তিনি। রাইটব্যাক ও লেফটব্যাক হিসেবে যথাক্রমে বর্তমানে বিশ্বের দুই সেরা ফুলব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসনের জায়গা পাকা। এ মৌসুমে লিভারপুলের ২৪ গোলে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন এই দুই ফুলব্যাক।

ফন ডাইক ও অ্যালিসন—লিভারপুলের রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় দুই ভরসার নাম। ছবি: এএফপি
ফন ডাইক ও অ্যালিসন—লিভারপুলের রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় দুই ভরসার নাম। ছবি: এএফপি

তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে একজনের কাজ হবে (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) রক্ষণভাগের সামনে থেকে প্রতিপক্ষ আক্রমণ নস্যাৎ করা। বাকি দুজন সময়–সুযোগমতো সামনে আক্রমণ করতে পারবেন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলবেন ব্রাজিলের ফাবিনহো। বার্সেলোনার বিপক্ষে সেমিতে লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়কে পকেটে পুরে রাখা ফাবিনহো দলের কৌশলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাবিনহোকে পেছনে রেখে মাঝেমধ্যে সামনে উঠে যাওয়ার ভূমিকা পালন করবেন দলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন ও সেমিতে বার্সাকে বিপক্ষে দুই গোল করা ডাচ মিডফিল্ডার জর্জিনিও ভাইনাল্ডাম। আক্রমণভাগে যথারীতি মোহাম্মদ সালাহ, সাদিও মানে ও রবার্তো ফিরমিনো।

গত মৌসুমে লিভারপুলের মূল কৌশল ছিল কাউন্টার-প্রেসিং। অর্থাৎ সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময়ে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে তড়িৎগতিতে আক্রমণ করা। গত মৌসুমে দলে কোনো আদর্শ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিল না। ভার্জিল ফন ডাইক ছাড়া লভরেনদের নিয়ে গড়া রক্ষণের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। গোলরক্ষকও ছিলেন এমন একজন, যিনি প্রায়ই ভুল করতেন। ফলে ক্লপ জানতেন, প্রতিপক্ষ আক্রমণ করতে এলে তা ঠেকানোর মতো অবস্থা তাঁর দলের নেই। যে কারণে ক্লপের পরিকল্পনা ছিল, বল নিয়ে নিজেদের মধ্যে পাস না দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপরে থাকা সালাহ-মানে-ফিরমিনোদের দিয়ে দাও, বাকি কাজ তারাই করবে। আর গোল করার জন্য লিভারপুলের এই ত্রয়ী যে কত কার্যকর, সেটা বলার অপেক্ষা থাকে না।

রক্ষণের অবস্থা খারাপ দেখে ক্লপ এমন তিনজনকে মূল একাদশে নামাতেন, যারা আগে দলের রক্ষণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রয়োজনে আক্রমণ করতে পারতেন। তাঁদের খেলার মধ্যে ভুবনভোলানো সেই ব্যাপারটা না থাকলেও ‘নিজের ঘর সামলে তারপর পারলে আক্রমণে ওঠো’ নীতিতে কার্যকরী ছিলেন অনেক। এ তিন মিডফিল্ডারের ভূমিকায় দেখা যেত হেন্ডারসন, ভাইনাল্ডাম ও জেমস মিলনারকে। তিনজনের কেউই দূরতম কল্পনাতেও ফিলিপ কুতিনহো, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বা লুকা মদরিচদের মতো চমৎকার পাস দিয়ে খেলার গতিনিয়ন্ত্রণ করার মতো খেলোয়াড় না।

এবার ক্লপের এই সমস্যা নেই। দলে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন গোলরক্ষক আছেন। ফন ডাইকও গত মৌসুমের চেয়ে এই মৌসুমে আরও বেশি কার্যকরী হয়েছেন, প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের কাতারে। দলে ফাবিনহোর মতো একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারও আছে। ফলে এখন আর পড়িমরি করে কাউন্টার–প্রেস করে আক্রমণ করার জন্য ছুটতে হয় না লিভারপুলকে। আস্তে ধীরে তারা আক্রমণ রচনা করতে পারে। দলের রক্ষণভাগের ওপরে ফাবিনহো থাকায় সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে দুই তরুণ ফুলব্যাক আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও রবার্টসনের। দুজন সমান তালে ওপরে উঠে গিয়ে একের পর এক আক্রমণ রচনা করতে পারেন, প্রতিপক্ষের বক্সের মাঝে ওত পেতে বসে থাকা সালাহ-মানে-ফিরমিনোদের ক্রস দিতে পারেন।

আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও রবার্টসনের ফেলে আসা জায়গা ফাবিনহো আগলে রাখেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। রক্ষণের চিন্তা অতটা করতে হয় না দুই ফুলব্যাকের। আলেক্সান্ডার-আরনল্ড এ মৌসুমে গোলে সহায়তা করেছেন ১২ বার, রবার্টসন ১১ বার। দুজন ফুলব্যাক হিসেবে মাঠে নামলেও কাজে-কর্মে প্রথাগত উইঙ্গারের ভূমিকা পালন করছেন, ফলে কাগজে-কলমে উইঙ্গার হিসেবে মূল একাদশে থাকা সাদিও মানে ও মোহাম্মদ সালাহ মাঠের এক পাশে পড়ে না থেকে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে যেতে পারছেন, আদর্শ স্ট্রাইকারের মতো গোল করতে পারছেন। ফাবিনহো আসার পর লিভারপুলের আক্রমণের কৌশল কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে বুঝছেন তো?

লিভারপুলের খেলার ধরন যা একটু বদলেছে, তার পেছনের কারিগর এই ফাবিনহো। ছবি: এএফপি
লিভারপুলের খেলার ধরন যা একটু বদলেছে, তার পেছনের কারিগর এই ফাবিনহো। ছবি: এএফপি

টটেনহামের বিপক্ষেও মোটামুটি একই কৌশলেই হয়তো খেলবে লিভারপুল। অ্যালিসন-ফন ডাইক-মাতিপ-ফাবিনহোর জমাট রক্ষণের ওপর ভিত্তি করে দুপাশ দিয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করে আক্রমণ করবেন আলেক্সান্ডার আরনল্ড ও রবার্টসন, ফুলব্যাক থেকে হয়ে যাবেন উইঙ্গার। হেন্ডারসন ও ভাইনাল্ডাম রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন। দুপাশে আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও রবার্টসন থাকায় সালাহ ও মানে উইঙ্গার না থেকে ডি-বক্সে ঢুকে স্ট্রাইকারের মতো খেলবেন, আর তাঁদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য ফিরমিনো একটু নেমে এসে মিডফিল্ডের সঙ্গে আক্রমণের যোগসূত্র রচনা করবেন।

লিভারপুলের সম্ভাব্য প্রাথমিক ছক। ছবি: সংগৃহীত
লিভারপুলের সম্ভাব্য প্রাথমিক ছক। ছবি: সংগৃহীত

ফলে আক্রমণ করার সময় লিভারপুলের ছক ৪-৩-৩ থেকে বদলে ২-৫-১-২ হয়ে যাবে। লিভারপুলের কৌশল মোটামুটি সবাই আঁচ করতে পারলেও লিভারপুলকে সেভাবে কেউ হারাতে পারে না শুধু একটাই কারণে, প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। দলের মস্তিষ্কে আক্রমণাত্মক কৌশলটা ক্লপ যেন একদম খোদাই করে গেঁথে দিয়েছেন!

ম্যাচের মধ্যে আক্রমণের সময় ৪-৩-৩ ছক বদলে এমন রূপ নেবে। ছবি: সংগৃহীত
ম্যাচের মধ্যে আক্রমণের সময় ৪-৩-৩ ছক বদলে এমন রূপ নেবে। ছবি: সংগৃহীত

টটেনহাম হটস্পার
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, পাঁচ বছর ধরে কঞ্জুস মালিকের অধীনে কীভাবে স্বল্প বাজেটে দল চালাতে হয়, পচেত্তিনো দেখিয়ে দিয়েছেন। গত দুই দলবদলের বাজারে নতুন কাউকে কেনেননি, টাকা না থাকায়। টাকা না খরচ করার জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টটেনহামের মাঝমাঠ। লিভারপুলের যেমন ফাবিনহো আছেন, টটেনহামের বলতে গেলে কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারই নেই। একজন আছেন এরিক ডায়ার, কিন্তু তাঁর ফর্ম এতটাই খারাপ, পচেত্তিনো তাঁকে মূল একাদশের অংশ হিসেবে ভাবেনই না। ফলে এ ভূমিকা পালন করতে ফরাসি মিডফিল্ডার মুসা সিসোকো বা ইংলিশ মিডফিল্ডার হ্যারি উইঙ্কস বা কেনিয়ার মিডফিল্ডার ভিক্টর ওয়ানিয়ামার ওপর নির্ভর করতে হয়।

তিনজনের মধ্যে প্রথম দুজনকে ঠিক আদর্শ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলা যায় না। বাকি একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেও বল ঠিকঠাক পাস করতে বলা হলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন তিনি, যে বল পাস করতে পারাটা পচেত্তিনোর কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দলে মিডফিল্ডারের এই অভাব কাটানোর জন্য লিভারপুলের মতো গোটা মৌসুমে দলকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে খেলাননি পচেত্তিনো। ৪-২-৩-১, ৪-৩-৩, ৩-৫-২, ৩-৪-৩, ৩-৪-১-২, ৪-৪-২ বিভিন্ন ছকে টটেনহামকে খেলিয়েছেন তিনি। ফলে ফাইনালে দলকে কেমন ছকে খেলান, সেটা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না।

মিডফিল্ডারের অভাব পূরণ করতে আক্রমণের কৌশলই বদলে ফেলেছেন পচেত্তিনো। সাধারণত দেখা যায় দলের মিডফিল্ডাররা আক্রমণভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে আক্রমণ রচনা করেন। কিন্তু যে দলের মিডফিল্ডই সাধারণ মানের, সেখানে আক্রমণ কীভাবে হয়? এই সমস্যা থেকে পচেত্তিনোকে রক্ষা করেছেন তাঁর দুর্দান্ত ডিফেন্ডাররা। মূল একাদশে ইয়ান ভার্তোনে, টোবি অল্ডারভাইরেল্ড, ড্যানি রোজ, ডেভিনসন স্যানচেজ, কিয়েরান ট্রিপিয়েরের মধ্যে যেকোনো চারজনকে খেলান পচেত্তিনো। এদের প্রত্যেকেই বল পায়ে অসাধারণ, মিডফিল্ডারদের মতো পাস দিতে পারেন, নিখুঁত আক্রমণ রচনা করতে পারেন পেছন থেকে। যে কারণে একটা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কম খেলিয়ে অধিকাংশ সময়েই পচেত্তিনো তিনজন সেন্টারব্যাক খেলিয়েছেন—ভার্তোনে, অল্ডারভেইরেল্ড ও স্যানচেজ। এ তিনজন সেন্টারব্যাকের মধ্যে দুজনের (স্যানচেজ/অল্ডারভেইরেল্ড বা স্যানচেজ/ভার্তোনে) কাজ থাকে গোলরক্ষক হুগো লরিসের সামনে থেকে দলের রক্ষণ নিশ্ছিদ্র করা, বাকি একজনের কাজ থাকে (ভার্তোনে বা অল্ডারভেইরেল্ড) ছদ্ম মিডফিল্ডার হয়ে একটু ওপরে উঠে গিয়ে নিখুঁত আক্রমণ রচনা করা।

ভার্তোনে ও অল্ডারভেইরেল্ড-ডিফেন্ডার হলেও পাস দিতে পারেন মিডফিল্ডারদের মতো! ছবি: টুইটার
ভার্তোনে ও অল্ডারভেইরেল্ড-ডিফেন্ডার হলেও পাস দিতে পারেন মিডফিল্ডারদের মতো! ছবি: টুইটার

দুই ফুলব্যাক কিয়েরান ট্রিপিয়ের ও ড্যানি রোজ বল পায়ে লিভারপুলের আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও রবার্টসনের মতো অতটা কার্যকরী না হলেও একদম ফেলনা নন। যেকোনো একজন সেন্টারব্যাক ওপরে উঠে আসার কারণে মূল একাদশে থাকা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের (উইঙ্কস বা সিসোকো) কাজ কমে যায়, নিশ্চিন্তে ওঠানামা করতে পারেন তিনি। দলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন একটু ডান দিক থেকে দলের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে তাঁর ফেলে আসা ফাঁকা জায়গায় আক্রমণ করার দায়িত্ব থাকে ইংলিশ মিডফিল্ডার দেলে আলির।

দলের মূল তারকা স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। কিন্তু এবার চোটে পড়ে বেশ কয়েকটা ম্যাচ খেলেননি তিনি। তাঁর জায়গায় দক্ষিণ কোরিয়ার হিউং মিন সন ও ব্রাজিলের লুকাস মউরাকে খেলানো হচ্ছে নিয়মিত। এ দুজনের কেউই প্রথাগত স্ট্রাইকার নন। পচেত্তিনোর এই ফাটকাটা এমন কাজে লেগেছে, ফলে এখন হ্যারি কেইন চোট থেকে ফিরে এলেও মূল একাদশে জায়গা পাচ্ছেন না!

চোট থেকে ফিরে এসেও একাদশে জায়গা নিশ্চিত নয় কেইনের! ছবি: এএফপি
চোট থেকে ফিরে এসেও একাদশে জায়গা নিশ্চিত নয় কেইনের! ছবি: এএফপি

এর পেছনে কারণ আছে। গোল করার ক্ষমতার কথা হিসাব করলে হ্যারি কেন বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হলেও সন ও লুকাস দলের আক্রমণে একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসেন, যা আবার কেন অতটা ভালো পারেন না। আক্রমণভাগে কোনোভাবেই স্থির থাকেন না সন ও লুকাস। প্রথাগত উইঙ্গার হওয়ার কারণে উইং থেকে স্ট্রাইক, সব দিকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় তাঁদের। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে তটস্থ করে রাখেন, ক্রমাগত ফাঁকা জায়গা বের করার চেষ্টায় থাকেন, যে ফাঁকা জায়গার সুবিধা নিয়ে আক্রমণ করা যায়। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের পা থেকে বল দ্রুত কেড়ে নিয়ে হুট করে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে কেনের চেয়ে লুকাস ও সন অনেক ভালো। যে কারণে মূল একাদশে কেন না থাকলেও কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনাল পেরোতে টটেনহামের একদম কষ্ট হয়নি। উল্টো দেখা গেছে, মূল একাদশে কেইন থাকলেই বরং সনের কার্যকারিতা কমে যায়। যে কারণে আজকের ফাইনালে কেইনকে বসিয়ে রেখে পচেত্তিনো যদি লুকাস ও সনকে খেলান, আশ্চর্য হবেন না যেন!

কেন না খেললেও সন তো খেলবেন! ছবি: এএফপি
কেন না খেললেও সন তো খেলবেন! ছবি: এএফপি

অনুমান করা যায়, আজও ৩-৫-২ ছকেই খেলবে টটেনহাম। তিনজন সেন্টারব্যাক ভার্তোনে-অল্ডারভেইরেল্ড-স্যানচেজ। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডের মধ্যে থাকবেন সিসোকো, দুপাশে আলি ও এরিকসেন। এই তিন মিডফিল্ডারের দুপাশে দুই উইংব্যাক ট্রিপিয়ের ও রোজ। আর সামনে দুই স্ট্রাইকার হিসেবে সন ও লুকাস।

টটেনহামের সম্ভাব্য ছক। ছবি: সংগৃহীত
টটেনহামের সম্ভাব্য ছক। ছবি: সংগৃহীত

আক্রমণের ছক এমন থাকলেও বল প্রতিপক্ষের পায়ে চলে গেলে ৪-৪-২ তে রূপান্তরিত হয়ে যাবে স্পার্স। সে ক্ষেত্রে বাঁ পায়ের খেলোয়াড় হতে রক্ষণভাগের মাঝে স্যানচেজ ও অল্ডারভেইরেল্ডকে রেখে লেফটব্যাক হয়ে যাবেন ভার্তোনে। রাইটব্যাক হিসেবে যথারীতি থাকবেন ট্রিপিয়ের। মধ্যমাঠে আলি ও সিসোকোর দুপাশে থাকবেন ড্যানি রোজ (লেফট মিডফিল্ডার) ও এরিকসেন (রাইট মিডফিল্ডার)। আর একদম সামনে যথারীতি সন ও লুকাস।

টটেনহামের পরিবর্তিত ছক। ছবি: সংগৃহীত
টটেনহামের পরিবর্তিত ছক। ছবি: সংগৃহীত

লিভারপুলের উদ্যমী দুই ফুলব্যাককে ঠেকানোর জন্য এ পরিবর্তিত ৪-৪-২ ছক কাজে লাগবে বেশ। আর ফন ডাইক-ফাবিনহোর রক্ষণকে তটস্থ করার জন্য সন-লুকাসের জুটি অনেক দরকার।

কৌশল যা-ই হোক না কেন, আক্রমণাত্মক ফুটবলের কোনো কমতি হবে না আজ রাতে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যে লড়াইয়ে জিতে ক্লপ বা পচেত্তিনো, দুই কোচের কেউ একজন অবশেষে নিজের দলের উন্নতির স্মারক হিসেবে পাবেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা!