জয় দিয়ে শুরু হোক আমাদের বিশ্বকাপ

‘তাহলে কি এই চাঁদ দেখিয়াছি দূর অস্ট্রেলিয়ায়? 

সিডনি কিম্বা মেলবোর্নের আকাশে? চ্যানেল নাইন-এর ক্যামেরায় ধরা কোনো দিন-রাত্রির ক্রিকেট সিরিজে?’
(দোল পূর্ণিমার চাঁদ: ধাবমান হরিণের দ্যুতি: ১৯৯২)

আজকের প্রজন্মের ক্রিকেট-ভক্তদের জানার জন্য কিছু তথ্য দেওয়া দরকার বলে মনে করছি। ফলের বাজারে টুকরিতে সাজানো আম দেখে কারও যদি মনে হয় যে ওই আমগুলো, ওই লিচুগুলো ফলের দোকানের ওই ঝুড়িতেই ফলেছে, তবে তো বিপদ ভারি। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে, না বাছা, ওই সব ফল গাছে ফলে। ফলের মহাজন এগুলো বিক্রি করার জন্য অনেক দূরের কোনো গ্রামের আমবাগান, লিচুবাগান বা কাঁঠালবাগান থেকে কম দামে কিনে এনে বেশি দামে বেচবে বলে দোকানের ঝুড়িতে পুরেছে। ঝুড়ি ওই সব ফলের জন্মস্থান নয়।
ক্রিকেট-সম্পর্কিত আলোচনায় ফলের দোকানের প্রসঙ্গটির প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? বলছি সেই কথা।

আমার লেখা ২০০ পৃষ্ঠার ক্রিকেট সমগ্র বইটি যদি আমার কবিতার বইয়ের মতো বিক্রি হতো, তাহলে না বললেও চলত। ভালো বিক্রি হয়নি বলেই মনে করছি ক্রিকেটের বিবর্তনের ইতিহাসটা কারও কারও আমার চেয়েও ভালো জানা আছে হয়তো, কিন্তু অধিকাংশ ক্রিকেট পাগলকে প্রশ্ন করে বুঝেছি, তারা ক্রিকেট দেখে, ক্রিকেট নিয়ে ‘লম্ফঝম্প’ (কথাটা ফুটবল খেলা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বলা) করে, কিন্তু ক্রিকেটের জন্ম ও বিবর্তনের ইতিহাস খুব একটা জানে না। জানার প্রয়োজনও বোধ করে না।

আজ ওডিআই বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যে বিভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন দল (আইপিএল/বিপিএল) তাদের নিজস্ব পছন্দমতো বানানো রঙিন জার্সি পরে মাঠ মাতাচ্ছে, এর শুরুটা যিনি করেছিলেন, আমি আজ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব।

এই মানুষটি হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার ধনকুবের, মিডিয়া টাইকুন, কেরি প্যাকার। তিনিই জনপ্রিয়তা হারাতে বসা ক্রিকেট খেলায় নবজীবন, নব উত্তেজনা দান করে ক্রিকেট ভক্তদের টেনে আনেন ক্রিকেটের মাঠে, দর্শক গ্যালারিতে। ক্রিকেট-ভক্তদের বসিয়ে দেন টিভি সেটের সামনে।

মানুষ উত্তেজনা খুব পছন্দ করে। কেরি প্যাকার ক্রিকেটের মধ্যে সেই উত্তেজনাকে মিশিয়ে দিয়ে তৈরি করলেন ‘কেরি প্যাকার বিশ্ব ক্রিকেট সিরিজ’। তিনি চালু করলেন ফ্লাড লাইটের আলোয় নৈশ ক্রিকেট। লাল বলের বদলে তিনি চালু করলেন সহজে দেখা যায় এমন মাখন-সাদা বল। সাদা পোশাকের বদলে তিনি খেলোয়াড়দের গায়ে পরালেন রঙিন জার্সি। শুধু ক্রিকেটারদের গায়েই নয়, অফিশিয়াল ও আম্পায়ারদের গায়েও।

আর সরাসরি খেলা প্রচারের জন্য তাঁর নিজের টিভি চ্যানেল, চ্যানেল নাইন তো ছিলই। সেটি ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট তখন শুরু হয়ে গেছে। আইসিসি কেরি প্যাকারকে হটানোর জন্য কেরি প্যাকারের বিশ্ব সিরিজে অংশগ্রহণকারী ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিল। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না।

তখন আইসিসি কেরি প্যাকারের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাল কেরি প্যাকারের ক্রিকেট ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে। বিশ্বকাপে যুক্ত হলো রঙিন জার্সি। ৬০ ওভারের বিশ্বকাপ কমিয়ে আনা হলো ৫০ ওভারে। শুরু হলো ফ্লাড লাইটে রাতকে দিন বানিয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ধারণাটি অবশ্য ইংল্যান্ড থেকে পাওয়া। ইসিবির বিপণন ব্যবস্থাপক স্টুয়ার্ট রবার্টসনের মস্তিষ্কপ্রসূত এই খেলা ২০০১ থেকে শুরু। আইসিসি ক্রিকেট খেলার এই ফরম্যাটটিকেও দখলে নিয়ে নেয়। শুরু হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ পাকিস্তানকে হারিয়ে জয় করে ভারত।
মোটামুটি এই হলো ক্রিকেট বিবর্তনের ইতিহাস।

এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জার্সি অনেকের মতো আমারও পছন্দ হয়নি। বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রিকেট-বিশ্বে টেনে আনার চিন্তাটাও ছিল কেরি প্যাকারের। একপর্যায়ে আইসিসিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার অংশগ্রহণ অনুমোদন করে।

লেখাটি যখন আমি লিখছি, তখন পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২১ ওভারে ১০৪ রান করে অলআউট হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন উইকেট হারিয়ে সেই রান তুলে নিয়েছে ১৪ ওভারে। তার মানে ১০০ ওভারের বিশ্বকাপের খেলা শেষ হলো মাত্র ২১ + ১৪ = ৩৫ ওভারে। ওয়ার্মআপ ম্যাচেও পাকিস্তান বিশ্বকাপে নবাগত আফগানিস্তানের মতো অনভিজ্ঞ একটা দলের কাছে হেরেছে।
ভাবা যায়? তবে কি পাকিস্তানই এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুর্বল দল? এখন পর্যন্ত তো সে রকমই মনে হচ্ছে।

এবারের বিশ্বকাপে আমাদের শুভসূচনা হবে আজ ২ জুন। এই খেলাটি হবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১০৪ রান হারা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে।
ওই হারু পার্টির সঙ্গে আমাদের হারার কোনো কারণ দেখি না।