নিজের আয়নায় তামিম

ছবি: শামসুল হক
ছবি: শামসুল হক
>তামিম ইকবাল বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। বিজ্ঞাপনে তামিম বলেন, ‘আমি জিতলে জিতে যায় মা’। বাংলাদেশের মানুষ জানে, তামিম ভালো খেললে ভালো খেলে বাংলাদেশ। আমাদের অসংখ্য জয় এসেছে বাঁহাতি এই ওপেনারের হাত ধরে। দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি—এ সব পরিসংখ্যান তো ক্রিকেটার তামিমের ছবিটা তুলে ধরে ভক্তদের কাছে। কিন্তু ব্যক্তি তামিম কেমন? কেমন তাঁর চিন্তাভাবনা, জীবনদর্শন? অন্তরঙ্গ আলাপে সেগুলোই তুলে এনেছেন তারেক মাহমুদ

বাবার ছেলে

তারেক মাহমুদ: বাবার কথা দিয়েই শুরু করুন। আপনার শৈশব মানেই তো আপনার বাবা ইকবাল খান!

তামিম ইকবাল: ছোটবেলার কথা বলতে গেলেই আমার আব্বার কথা মনে পড়ে যায়। আমি যে জীবনটা তখন কাটাতাম, সেটা আপনারা দেখলে হয়তো বলতেন, ওটা কোনো আদর্শ জীবন ছিল না। কিন্তু আমি এখন নিজেই বাবা, আমি বুঝতে পারি কেন বাবা আমার জন্য এসব করতেন। একদিক দিয়ে বলতে পারেন, এটা তো খুব ভালো কথা না। আবার বাবা হিসেবে চিন্তা করলে দেখবেন, ছেলের চাহিদা পূরণ না করে থাকা যায় না। এরকম ছোট ছোট জিনিসই বেশি মনে পড়ে। একটা কোক কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে আব্বা আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে...আমরা কখনো খুব হাইফাই খেলনার দোকানে যেতাম না। পাইকারি বিক্রির কিছু দোকান ছিল, ওখানে যেতাম। ওসব দোকানে গিয়ে বাচ্চারা কখনো একটা জিনিস নিয়ে ফেরে না। অনেক কিছু কিনতে চায়। আমার জন্যও কেনার কোনো সীমা ছিল না। বলতেন, যা ইচ্ছা কেনো।

বাবা ইকবাল খানের সঙ্গে ছোট্ট তামিম
বাবা ইকবাল খানের সঙ্গে ছোট্ট তামিম

তারেক: আপনার ছোটবেলার প্রসঙ্গে বাবাই কেন আগে আসেন?

তামিম: এটা বলে বোঝাতে পারব না যেআমি তাঁর কতটা কাছের ছিলাম। আমার মা এখনো মাশা আল্লাহ ভালো আছেন। তবু আমার জন্য আব্বাই ছিলেন আমার মা, বাবা, ভাই, বোন—সব। আব্বার ইন্তেকালের পর আমার প্রথম মনে হয়েছিল, আমি এখন কী করব! বাঁচব কী করে! আমার বয়স তখন ১০-১২ বছর হবে। আল্লাহর কী ইচ্ছা দেখেন, আব্বা মারা যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে শুধু আমিই ছিলাম। না আমার মা ছিলেন, না ভাই ছিলেন, না আমার বোন। ভাইয়া যশোরে খেলতে গিয়েছিলেন। আম্মা আর বোন গিয়েছিল নানির বাড়িতে। আমি শুধু আব্বার সঙ্গে ছিলাম। ধরুন, কখনো আব্বা-আম্মার ঝগড়া হলো, আম্মা রাগ করে ঢাকায় চলে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কী হয়? বাচ্চারাও মায়ের সঙ্গে যায়। কিন্তু আমি কখনো যেতাম না। উল্টো ঝগড়া করে আব্বার সঙ্গে থেকে যেতাম। সেবারও আমাকে আম্মা যেতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি যাইনি। তাছাড়া ওই সময় বিভাগীয় অনূর্ধ্ব–১৩ একটা খেলাও ছিল মনে হয়। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন আব্বাই। তাঁরও সবচেয়ে প্রিয় ছিলাম আমি। হয়তোবা সে কারণেই আব্বার শেষ সময়ে আল্লাহ আমাকে তাঁর পাশে রেখেছিলেন।

তারেক: বাবা ছাড়া আর কার কথা বলবেন, আপনার জীবনে যাঁর গুরুত্ব বেশি?

তামিম: ভাইয়া—নাফিস ইকবাল। দেখুন, মায়ের সঙ্গে সব সন্তানই খুব ঘনিষ্ঠ থাকে। আমার মা আমার জন্য কী করেছেন, সেটা আমি এখন বুঝতে পারি যখন দেখি আয়েশা (তামিমের স্ত্রী) আমার ছেলেকে কীভাবে সামলায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মায়ের সঙ্গে আমি অতটুকু ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। আব্বার সঙ্গেই অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম, বেশি কাছে ছিলাম তাঁর। এটা আগে বুঝতাম না, এখন বুঝতে পারি। একজন মা তার সন্তানের জন্য কত কিছু করেন! এতে ওই সন্তানের জীবনটা ৩৬০ ডিগ্রি বদলে যায়। আমার ছেলেকেআমিপ্রচণ্ড আদর করি, কিন্তু যদি বলেন ওকে পাঁচ ঘণ্টা রাখতে হবে, পারব না। সিঙ্গাপুরে আমার স্ত্রী একটা বেকিং ক্লাস করতে হোটেল থেকে তিন ঘণ্টার জন্য বের হয়েছিল। ওটাই প্রথম ঘটনা যখন আমার ছেলে আমার সঙ্গে তিন ঘণ্টা একা ছিল। আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওকে খাওয়ানো, বাথরুমে আনা-নেওয়া—সব করতে হয়েছে। দূরে থাকলে ছেলেকে আমি মিস করি, এটা সত্য; কিন্তু একজন মা যা পারে, আমি তার ৫ শতাংশও করতে পারব না। বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে মায়ের কাছ থেকে পরে একটু দূরে সরে গেলেও একদম ছোটবেলায় নিশ্চয়ই আমার মা–ও আমাকে এভাবেই বড় করেছেন। এসব দেখে আম্মার প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যায় আমার।

সেই শৈশব, এই শৈশব

তারেক: ক্রিকেটার হওয়ার পর তো ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়েই আছেন। ছোটবেলায় আপনি কী খেলতে পছন্দ করতেন?কী ধরনের খেলনার প্রতি আকর্ষণ ছিল?

তামিম: একেক সময় একেকটা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটা বদলেছে। প্রথমে সব আগ্রহ ছিল গাড়ি নিয়ে। খেলনা হিসেবে গাড়ি আমার খুব পছন্দ ছিল। বিশেষত রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি। কল্পনা করতাম, আমার একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি থাকবে, যেটা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে যাবে। অথবা আমার রিমোটে টিভির মতো একটা মনিটর থাকবে, যেটা দেখে দেখে আমি গাড়ি চালাতে পারব।হোম অ্যালন ছবিটা দেখে এসব জিনিস মাথায় আসত। রিমোট কন্ট্রোল স্পিডবোট, রিমোট কন্ট্রোল প্লেন—এসব নিয়েও ভাবতাম। এসব খেলনা এখনো আছে। রিমোট কন্ট্রোল প্লেন তো এখন সত্যিকারের প্লেনের মতো টেক–অফ করে, ল্যান্ড করে, আকাশে ওড়ে। ওই সময় এসব জিনিস বাংলাদেশে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর এল বিভিন্ন ধরনের খেলনা বন্দুক। ছোট ছোট বুলেটের একটা বন্দুক ছিল আমার খুব প্রিয়।

তবে যখন ক্রিকেটটা ধরা শুরু করলাম, সে সময় তো ব্যাট-বল নিয়ে সব ভাবনা। সৌরভ গাঙ্গুলীর স্টিকার লাগানো ব্যাট যদি পাই...।

তারেক: এখন নিজেই আপনি বাবা। আপনার ছেলে কি আপনার বাবার মতো বাবা পেয়েছে?

তামিম: বলতে পারেন, অনেকটাই। আমার ছেলে যা–ই বলে, তার যেকোনো আবদার, সেটা রাত ১২টার সময় ওর গাড়ি চালানোই হোক বা সকাল ৭টায় ছাগল দেখতে যাওয়াই হোক—সবই পূরণ করার চেষ্টা করি আমি। আমার মা যেমন বাবাকে আটকাতে চাইতেন, এখন আমার স্ত্রী ঠিক একইভাবে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করে, ‘রাত ১২টার সময় ও কেন গাড়ি চালাবে? ওটা তো ঘুমানোর সময়।’ কিন্তু আমার ছেলে  যেভাবে আমাকেবলে, ওটা আমি সহ্য করতে পারি না। ঠিক একইভাবে আব্বাও আমার সব চাহিদা পূরণ করে দিতেন।

তারেক: ছেলে কি টুকটাক ক্রিকেট খেলে?

তামিম: মজার ব্যাপার হলো, ক্রিকেট নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিন বছর হয়ে গেছে। এই সেদিন মনে হয় প্রথমবার বোলিং করেছে (হাসি)। আমার ছোটবেলার মতো তারও পছন্দ গাড়ির খেলনা। ছোট ছোট গাড়ি খুব পছন্দ। মিনিয়েন একটা খেলনা আছে। গানগায় আর নাচে। খুবই সস্তা ছোট খেলনা। আমার ধারণা, আমি, ওর নানা, আম্মা আর আমার ভাই মিলে ওকে এই একই খেলনা ৫০০টি কিনে দিয়েছি। সস্তা বলে এটা নষ্ট হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু প্রতিবার যখন ও নতুনভাবেএটা পায়, ঠিক একই রকম খুশি হয়। আমার যেটা ভালো লাগে, ও কখনো একসঙ্গে একটার বেশি খেলনা কেনে না। দেশের বাইরে ওকে অনেক ভালো ভালো খেলনার দোকানে নিয়ে গিয়েছি আমি, সেখানে অনেক খেলনা দিয়ে খেলে। আসার সময় চাইলে একসঙ্গে ১০টা গাড়িও কিনতে পারত। কিন্তু ও কোনো দিন একটার বেশি আনবে না। হয় একটা গাড়ি, নয়তো জীবজন্তুর একটা সেট।

স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে
স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে



প্রেম, বিয়ে, অতঃপর...

তারেক: আপনার স্ত্রী আয়েশা, যিনি আপনার প্রেমিকা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা মনে আছে?

তামিম: আয়েশাকে প্রথম দেখায় আমার এক বন্ধু। তখন ও–লেভেল পড়ি। স্কুলপড়ুয়া টিনএজদের মতোই আমি বন্ধুদের একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্কুলে কোনো সুন্দর মেয়ে আসছে নাকি?’ তখন খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু আমাকে বলল, ‘দোস্ত, আমার একটা পছন্দ হইছে। তোকে দেখাই চল।’ ও-ই আমাকে নিয়ে গিয়ে প্রথম আয়েশাকে দেখায়। ওখান থেকেই গল্পের শুরু।

তারেক: প্রথম দেখা থেকে বিয়ে—অনেক কঠিন ছিল পথটা?

তামিম: অনেক অনেক কঠিন ছিল। আমি তাকে পছন্দ করতাম ঠিকই, তবে আমার একটা ইগো ছিল সবসময়। তাইআমার ওই বন্ধুকে আমি বললাম, এরপর যদি মুখের ওপর না করে দেয়, তাহলে তো বেইজ্জতির ব্যাপার! সেজন্য সরাসরি না বলে আমার এক মেয়ে বন্ধুকে দিয়ে তার কাছে প্রস্তাব পাঠাই। সেটা সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তো জেদি। তার পেছনে লেগেই রইলাম। এভাবে চার-পাঁচ মাস পর আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া আয়েশার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।

তারেক: প্রেম মানেই তো বাধা। আপনাকে ঠেকাতে নাকি আয়েশার জন্য একজন বডিগার্ডও রেখেছিল তাঁর পরিবার?

তামিম: আমাদের সম্পর্কটা ছিল খুব কঠিন। মানে সম্পর্ক রক্ষা করাটা কঠিন ছিল। বেশিরভাগ সময় সম্পর্কটা অনেক বেশি দূর থেকে রক্ষা করতে হতো। ওদের পরিবার আমার ওপর খুশি ছিল না। কথা বলার সুযোগও তাই খুব একটা পেতামনা। ওর সঙ্গে একজন বডিগার্ড থাকত, সেটাও আমাকে পাহারা দিতে। আমি তবু সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। স্কুলে বা কোনো একটা কোচিংয়ে গিয়ে যদি ৫ মিনিট দেখা করে আসতে পারি।  শুরুতে আমরাএকই স্কুলে পড়লেও সম্পর্ক হওয়ার পর মাত্র তিন-চার মাস পর্যন্ত স্কুলে দেখা করতে পেরেছিআমরা। যখনই বিষয়টা জানাজানি হলো, আয়েশার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরে তো মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে সেখানখার স্কুলে পড়ানো হলো তাকে। ঘটনাটা ঘটল আমার কারণেই। এখন মনে হয়, হয়তো এটাই ঠিক ছিল। ক্লাস এইটের মেয়ে প্রেম-ভালোবাসা করবে, এটা কে পছন্দ করবে! কোনো পরিবারই পছন্দ করবে না। কিন্তু তাতে আমার অবস্থা আরও খারাপ হলো। ওই সময়ে ১ মিনিটের ফোনখরচ ছিল ২৫ টাকা। আর আমি তো তখন টাকাপয়সাও তেমন উপার্জন করতাম না। সেজন্যই ঢাকা টু মালয়েশিয়া প্রেমের সম্পর্ক রক্ষা করা ছিল খুবই কঠিন।

তারেক: তবু তো রক্ষা করলেন। বাল্যপ্রেমিকাকে বিয়ে করেই এখন আপনি সংসারী...

তামিম: একটা কথা আমি সবসময় বলি, আমার প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত ছিল। নইলে যেদিন আয়েশাকে বিদেশে পাঠানো হলো, যেদিন তার ফ্লাইট, সেই দিনেই আমি কীভাবে জাতীয় দলে ডাক পাই! বিশ্বাস করুন, আমি যদি আর ছয় মাস পরও জাতীয় দলে ঢুকতাম, আমার পক্ষে অত দূরের সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হতো না। বিমানভাড়ার কথা ভুলে যান, ফোনে কথা বলার জন্য মিনিটে ২৫ টাকা করে কে দেবে! জানেন, টাকার জন্য ওই সময় আমি চুরিও করেছি।

তারেক: চুরি! আপনি! খুলে বলবেন একটু?

তামিম: এসব তো অনেকে জানে না (হাসি)। একবার আমি আমার বোনের মোবাইল ফোন চুরি করে বিক্রি করেছি, ওই টাকা দিয়ে আয়েশাকে গিফট কিনে দেওয়ার জন্য। এখনো মনে আছে, সিমেন্সের সেট ছিল ওটা। সেটটা আমি ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে ৩ হাজার টাকায় আয়েশার জন্য একটা পারফিউম কিনি। ৪ হাজার টাকার মোবাইলের কার্ড কিনেছিলাম। দেশে কথা বলার জন্যই। দেশেও তো তখন ৭-৮ টাকা করে মিনিট ছিল। ফোন চুরির কথা হয়তো এই সাক্ষাৎকার পড়েই অনেকে জানবে। তবে আমার বিশ্বাস, আমি আমার বোনকে ওই ফোনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এরপর যথেষ্টই দিয়েছি। তবে খালি মোবাইল না, আরও অনেক কিছুই চুরি করেছি জীবনে। বাইরে গিয়ে ডাকাতি তো করতে পারতাম না। তার চেয়ে বাসায় চুরি করাই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ।

ঘরে থাকলে ছেলে আরহামকে িনয়েই কাটে সময়
ঘরে থাকলে ছেলে আরহামকে িনয়েই কাটে সময়

লাভ ইন মালয়েশিয়া

তারেক: দূরত্বে কি এল–গেল! আপনি তো ঠিকই মালয়েশিয়া গিয়ে আয়েশার সঙ্গে দেখা করতেন। সেই গল্প বলুন...

তামিম: এখনো মনে আছে, আমি প্রথম বেশি অঙ্কের যে টাকাটা রোজগার করি, মানে একসঙ্গে বেশি টাকা যেটা হাতে পাই, সেটা ছিল আড়াই লাখ টাকা। তার আগে ওরিয়েন্টের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলে ক্যাশ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। তারও আগে ওল্ড ডিওএইচএসের সঙ্গে দেড় লাখ টাকার চুক্তি থাকলেও ক্যাশ টাকা হাতে পাইনি। একটা গাড়ি কিনেছিলাম, তারা টাকাটা ওখানে দিয়ে দিয়েছিল। এসব কারণে আমার হাতে ক্যাশ টাকা থাকত না। আমি যখন জাতীয় দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে খেলতে যাই, আমার ব্যাংকঅ্যাকাউন্টে মাত্র ১৫০০ টাকা ছিল। স্ট্যান্ডার্ড চার্টাডের অ্যাকাউন্ট, এখনো সেই অ্যাকাউন্টই আমি চালাই। আমি আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল পরিবার থেকে এলেও আমার কাপড়-চোপড় কেনা থেকে সব খরচ দিত আমার ভাইয়া। যা হোক, জিম্বাবুয়ে থেকে খেলে এসে আমি ওই আড়াই লাখ টাকা হাতে পাই। বন্দুক, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির পর ব্যাট-বল হয়ে আমার তখন ল্যাপটপের প্রতি প্রবল আগ্রহ। ল্যাপটপ দিয়ে কী করব জানি না, কিন্তু ওই জিনিস আমার একটা লাগবে। আইসিসি ট্রফি জেতার পর আকরাম চাচা একটা ল্যাপটপ পেয়েছিলেন। কেউ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে। ওই সময় থেকেই মনের মধ্যে ছিল, একটা ল্যাপটপ আমি কিনব। যেদিন ওই আড়াই লাখ টাকা অ্যাকাউন্টে ঢোকে, সেদিনই এইচপির একটা ল্যাপটপ কিনে ফেলি। খুব সম্ভবত ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। আমার কী কপাল, পরে আমি ওই এইচপিরই ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর হই। বাকি যে টাকা ছিল, সেটা দিয়ে কিনলাম মালয়েশিয়া যাওয়ার বিমান টিকিট আর ডলার। আমার এক বন্ধুকেও সঙ্গে নিয়ে নিলাম। ভাবলাম, একা একা প্রথম যাচ্ছি। কিছু চিনি-টিনি না। কী জানি কী হয়! ওই বন্ধু আগে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। সেজন্য নিজের খরচে ওকে নিলাম ‘এক্সপার্ট’ হিসেবে। আমাদের ছিল ইকোনমি ক্লাসের টিকিট। কিন্তু কী কারণে যেন সেদিন বিমানে ওঠার আগে ওরা সেই টিকিট ছিঁড়ে ফেলে আমাদের বিজনেস ক্লাসের টিকিট দিয়ে দিল। এমন নয় যে আমাকে চিনে তারা এটা করেছে। তখনোআমি বিখ্যাত হইনি, চিনবে কী করে! ইকোনমি ক্লাসে সম্ভবত ওভার বুকড ছিল, সে কারণেই তারা আমাদের বিজনেস ক্লাসের টিকিট দিয়ে থাকবেন। মালয়েশিয়া গিয়ে আয়েশার সঙ্গে দেখা হতো স্কুল শেষ হওয়ার পর ও যখন বাসায় যেত, তার মাঝের ১৫-২০ মিনিট। চিন্তা করেন, এত টাকা খরচ করে গিয়ে ১৫-২০ মিনিট! সেজন্যই বলি, আমাদের সম্পর্ক ছিল ভীষণ ব্যয়বহুল। আমার শাশুড়িকে এখন বলি, ‘আপনি যদি আমাদের ব্যাপারটা আগে মেনে নিতেন, তাহলে আপনার মেয়ের জীবনটা আরেকটু ভালো হতো। আমার ব্যাংক–ব্যালান্স তখন আরেকটু ভালো থাকত। ওই বয়সে অতগুলো টাকা নষ্ট করতে হতো না।’

অপ্রিয় থেকে সবচেয়ে প্রিয়

তারেক: এই যে তাঁরা আপনাকে এত অপছন্দ করতেন, কিন্তু শেষ অব্দি মেয়ে তো বিয়ে দিলেন। ম্যানেজ করলেন কীভাবে?

তামিম: বন্ধুবান্ধবরা বলত, ‘জাতীয় দলে খেল। দেখবি মেনে নেবে।’ জাতীয় দলে আসার পর অবস্থা আরও খারাপ হলো। এবার ওরা বলল, ‘একটু ভালো খেল, সবাই চিনুক। তাহলে মেনে নেবে।’ ভালোও খেললাম, নামও হলো, পরিস্থিতি তবু বদলায় না। কোনোভাবেই তাঁরা রাজি না। জানি না প্রেম-বিয়ের ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের নিয়ে কী কারণে যে মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা থাকে! এটামনে হয় আমাদের সমাজেরই নিয়ম। একটা মেয়ে যদি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ছেলেটার সঙ্গেও সম্পর্কে জড়ায়, ওই মেয়ের বাবা-মায়ের কাছে ওই ছেলেটাই হলো সবচেয়ে খারাপ। ওদের পরিবারেও এটাই নিয়ম ছিল। কিন্তু এটাও তো বুঝতে হবে হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয়। সব পেশাতেই ভালো-খারাপ মানুষ থাকে। যা হোক, পরিস্থিতি বদলানোর ক্ষেত্রে কিছু মিডিয়ার অবদান আছে। তাদের ধন্যবাদ দেব। কিছু মিডিয়ায় আমাদের ব্যাপারটা এসে গিয়েছিল। আয়েশার পরিবার সেটা দেখেছে, যাঁরা ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতেন, তাঁরাও দেখেছেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের হাতে আর কোনো রাস্তাই ছিল না আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া ছাড়া। আর আমি কোনো রাস্তা থাকতেও দিতাম না। যদি শুনতাম অমুক জায়গা থেকে প্রস্তাব গেছে, কোনোভাবে ছেলে পক্ষকে আমি আমার খবরটা পৌঁছে দিতাম। এরপর একদিন  খুব সাহস করে গিয়ে দেখা করিআমি। তো একবার যখন মুখোমুখি হলাম, আস্তে আস্তে বরফটা গলতে শুরু করল। ওর বাবা, মা, ভাই—সবাই খুব কড়া ছিলেন। কিন্তু ভাবির সাহায্য সবসময় পেয়েছি।

চোট তাঁর পিছু ছাড়ে না
চোট তাঁর পিছু ছাড়ে না

হঠাৎ সাসপেন্স

তারেক: বরফ গলল। এরপর তো বিয়ে, তাই না?

তামিম: বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর একটা ঝামেলা লেগে গেল। সমস্যা লাগল পা ছুঁয়ে সালাম করা নিয়ে। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অনুযায়ী এটা বাধ্যতামূলক। বড়দের সম্মান জানাতে পা ছুঁয়ে সালাম আপনাকে করতেই হবে। এটা অনেক বড় ব্যাপার সেখানে। কিন্তু আমি কখনো পা ছুঁয়ে সালাম পছন্দ করতাম না। আগেও আমি কাউকে কখনো এভাবে সালাম করিনি। আব্বা-আম্মাকেও না। ওনারাও এটা করতে নিষেধ করতেন। আমার কাছে মনে হতো, আমি যদি মাথা নোয়াই সেটা শুধু আল্লাহর কাছেই নোয়াব। চট্টগ্রামের ছেলে বলে আমিও জানি, এটা কতটা স্পর্শকাতর বিষয়। তো বিয়েতে আমি পা ছুঁয়ে সালাম করব না শুনে ওদের অনেকে বিগড়ে গেল। অগত্যা আমি নিজেই ওনাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। কেন পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাই না, সেটা বোঝাই। এরপর তাঁরা আমার কথা মেনে নিলেন।

তারেক: শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে এখন সম্পর্ক কেমন?

তামিম: অসম্ভব ভালো। সবার সঙ্গেই। আর আমার শাশুড়ির কথা কীবলব, সম্ভবত আমিই ওনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।

কাছের মানুষ মাশরাফি

তারেক: জাতীয় দলে আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফি তো অনেকের জীবনের ফিলসফারও। আপনার জীবনে তাঁর ভূমিকা কী?

তামিম: ২০১৫ বিশ্বকাপের সময়টায় আমার জীবনে মাশরাফি ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তাঁর সঙ্গে সবসময়ই আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু সেটা গভীর হয় ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়। ওই দুঃসময়ে তার কাছে গিয়ে অনেক সময় কেঁদেছিও। নেলসনে ৯৫ রানের ইনিংসের আগের দিন হোটেলে আমি মাশরাফি ভাইকে ধরে কেঁদেছিলাম। তখন পর্যন্ত মাত্র দুটি ম্যাচ হয়েছিল আমাদের। একটায় আমি ২৫ করি, আরেকটায় শূন্য। এতে তো দুনিয়া ভেঙে পড়ার কথা নয়! কিন্তু ওই সময়ে আসলেই দুনিয়া ভেঙে পড়েছিল। যারা আমাদের আপন মানুষ, তারাই আমাদের ব্যাপারে বড় বড় কথা বলছিল। আমার মনে হচ্ছিল পুরো দেশ মিলে একটা মানুষকে আক্রমণ করছে। মানসিকভবে আমি এসব গ্রহণ করতে পারছিলাম না। এটা বলা খুব সহজ, ‘পেপার পড়িস কেন, টিভি দেখিস কেন?’ কিন্তু যার ওপর দিয়ে যায় সেই একমাত্র বোঝে কী যাচ্ছে। তাছাড়া তখনকার আগে এরকম অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। এখন ওরকম পরিস্থিতি হলে হয়তো আরও ভালোভাবে সামলাব। ওই সময় মাশরাফি ভাই আমাকে অনেক মানসিক সাহস দিয়েছেন। একজন ক্রিকেটারের জন্য নিজেকে গুরুত্বপূর্ণভাবাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন ড্রেসিংরুমে থাকব, ব্যাটিংয়ে থাকব তখন আমার মনে হতে হবে যে আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু। খেলায় যখন আমি অনুভব করি প্রতিপক্ষ আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আমাকে নিয়ে ভাবছে, এরকম সময়ে সাধারণত আমি ভালো খেলি। মানুষ হিসেবে আমি এভাবেই গড়ে উঠেছি। শুধু মানুষ আমাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেই এটা হবে না, আমার নিজের মধ্যেও আসতে হবে যে আমিগুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই আমার সেরাটা বেরিয়ে আসে। ২০১৫ সালে আমার সময় খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু যখনই দলে কোনো মিটিং হতো, আলোচনা হতো, মাশরাফি ভাই প্রথমে আমার নামটা বলতেন। বলতেন, তামিম রান করলে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। আমাকে আমার গুরুত্বটা বোঝাতে চাইতেন। আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য উনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পারছিলাম তিনি হয়তো এটা ইচ্ছা করে করছেন। তবে আমার কাছে ভালো লাগত।

তারেক: মাশরাফির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সময় থেকে মিডিয়ার সঙ্গেও আপনার সম্পর্ক ভালো হতে থাকে। দুটোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে?

তামিম: এটা ঠিক, ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি মিডিয়া ঠিকভাবে সামলাতে পারতাম না। একটা সময় ছিল যখন ভাবতাম, মিডিয়া আমার শত্রু। তাদের অনেকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতাম না। মাশরাফি ভাই-ই প্রথম আমাকে বোঝালেন, ‘মিডিয়া তোমার বন্ধু না-ই হতে পারে। তোমারও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার দরকার নেই। তবে তাদের মানুষ ভাবো। তদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ এর আগে আমি মিডিয়াকে পাত্তাই দিতাম না। ঠিকভাবে কথা বলতাম না, ইন্টারভিউ দিতাম না। কারণ ওটাই—আমার কাছে মনে হতো ওরা আমার শত্রু। মাশরাফিই ভাই-ই প্রথম আমাকে বোঝালেন, তাঁরা মানুষ এবং তাঁরা তাঁদের কাজ করছেন। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা তাঁদের নেই। মাশরাফি ভাইয়ের কথা ছিল, সাংবাদিকদের বন্ধু হওয়ার দরকার নেই। আমাকে নিয়ে ভালো লেখার জন্য ওনাদের দুটো জিনিস খাওয়ানোরও দরকার নেই।আমি যে জায়গায় এসেছি আমাকে নিয়ে মিডিয়া ভালো লিখুক, খারাপ লিখুক, এটা আমার অর্জন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মানুষের মতো আচরণ করতে হবে। কেউ একজন হয়তো আমাকে নিয়ে খারাপ লেখে। কিন্তু বুঝতে হবে, এটা তাঁর কাজ। একই মানুষ আমার ব্যাপারে ভালো লিখবে, আবার খারাপও লিখবে।

চোট মানেই সন্দেহ

তারেক: আপনি চোটে পড়লেই সেটার প্রতি একধরনের অবিশ্বাসকাজ করে সবার মধ্যে। এখন এটা অনেক কমে এসেছে। কিন্তু একসময় তা ছিল। কেন?

তামিম: হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা । এরকম একটা সময় গেছে। দেখুন, আমি যদি ক্রিকেটের সঙ্গে প্রতারণা করি, ক্রিকেটও আমার সঙ্গে প্রতারণা করবে। আমি এটা খুব বিশ্বাস করি। আমার চোট নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয় কেন? অন্য দেশে দেখবেন এসব ক্ষেত্রে খুব স্পষ্টভাবে তথ্যগুলো সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এসব জিনিস একটু লুকিয়ে রাখার প্রবণতা কাজ করে বা মানুষ এসব লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। সাকিবের হাতের বিষয়টাই দেখুন। যখন জিনিসটা ফাঁস হয়ে গেল, মিডিয়ায় আসতে লাগল, তখন বিষয়টা জানল সবাই। বা আমার যে হাত ভাঙল, প্রথম তিন-চার দিন বলল, আমরা এখনো দেখছি। আমাকে রুলড আউট করা হলো চার-পাঁচ দিন পর। অথচ রুলড আউট আমি হাতে বল লাগার সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় মেডিকেল টিম যদি একটা পরিষ্কার বার্তা দেয়, তাহলে এগুলো আর হয় না। আর চোট নিয়েও খেলার উদাহরণ অনেক আছে। শুধু আমার নয়, আমার সতীর্থদেরও। তবে আমরা যে চোট নিয়েও খেলি, সেটা মিডিয়ায় আসে না। এটার দরকারও নেই আসার।

তারেক: মানুষের এই অবিশ্বাসে নিশ্চয়ই খারাপ লাগত?

তামিম: খুবই খারাপ লাগত। নিজের দলের কাছেই নিজেকে ছোট লাগত। মনে হতো অন্য খেলোয়াড়েরাও হয়তো এরকম ভাবছে, আমার আসলে চোট নেই। অভিনয় করছি। এখন কীভাবে তাদের বোঝাব যে, আমার সত্যি সত্যি ব্যথা! কিছু মানুষের সঙ্গে হয়তো এরকম হয়েই যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমি চোটের কারণে খুব কমই ম্যাচ মিস করেছি। হিসাব করে দেখলে তিন-চারটা ম্যাচ হবে। চোটে অনেকবারই পড়েছি, না খেলার অবস্থাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমি শেষ পর্যন্তখেলে ফেলেছি।

সাকিব, মাশরাফিসহ জাতীয় দলের সবার কাছের মানুষ তামিম
সাকিব, মাশরাফিসহ জাতীয় দলের সবার কাছের মানুষ তামিম

ক্রিকেট ও টিমম্যান

তারেক: বাংলাদেশ দলে টিম ম্যান হিসেবে আপনার খ্যাতি আছে। ছোট-বড় সবার সঙ্গে সহজ সম্পর্ক। পারিবারিক আবহ থেকেই কি এই গুণটা এসেছে?

তামিম: সম্ভবত এটাও আমি আব্বার কাছ থেকেই পেয়েছি। আব্বার অভ্যাস ছিল সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলা। এটা আমার মধ্যেও আছে। শুধু বাংলাদেশ দলে নয়, এটা আমি ব্যক্তিগত জীবনেও মেনে চলি। মাঝেমধ্যে আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়। পরিবারকেও তো সময় দেওয়ার ব্যাপার আছে। কোথাও ঘুরতে গেলে আমি, আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে যাব—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মধ্যে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ঘোরার মজাটা বেশি। আব্বাও এটা খুব করতেন। আমিও তাঁর কাছ থেকেই এটা পেয়েছি। চট্টগ্রামে আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়েছি, সেখানে শুধু আব্বা, আম্মা, আমি আর আমার ভাই-বোন ছিল—এরকম কখনো ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। কখনোই না। যখনই বাইরে খেতে গেছি, অন্তত ২০-২৫ জন ছিল সঙ্গে। জাতীয় দলের হয়ে বাইরে খেলতে গেলেও আপনি কখনো দেখবেন না আমি একা খেতে যাচ্ছি। তিন-চারজন তো থাকবেই সঙ্গে। ওদের ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক, আমি জোর করে নিয়ে যাই। এমন না যে শুধু খুব কাছের মানুষদের সঙ্গে এটা করি। সবার সঙ্গেই। ১০-১২ বছর ধরে জাতীয় দলে খেলার সুবাদে আমরা অনেক ভালো ভালো জায়গায় গেছি, ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়েছি। কিন্তু আজ যে ছেলেটা জাতীয় দলে এল, সে তো এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। তাদের এই জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করানো, ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়া, ভালো ভালো জিনিস কেনা, ব্যতিক্রমধর্মী কিছু খাওয়ানো—আমি এগুলো খুব উপভোগ করি। আমার কাছে সবসময় মনে হয় ডালভাত পর্যন্তই জীবন না। ডালভাতের পরও জীবন আছে। কোনো না কোনো সময় আমাকেও এটা কেউ শিখিয়েছে, হয়তো আমার বাবাই। বাংলাদেশ দলের অনেকের কাছ থেকেও অনেক কিছু জীবনে শিখেছি। আমি যা শিখেছি, সেটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সবসময়ই ভালো লাগে।

তারেক: তারকা হওয়ার আগে চট্টগ্রামে সময় কাটত কীভাবে?

তামিম: যখন মুশফিক আর সাকিব জাতীয় দলে ঢুকল, আমি তখন জাতীয় দলের ধারেকাছেও নেই। খেলতাম, তবে আমি ছিলাম অসম্ভব এলোমেলো এক ক্রিকেটার। অলসও বলতে পারেন। বাড়তি পরিশ্রম করার তো প্রশ্নই আসত না। একটু দৌড়াব, বাড়তি জিম করব—এসব চিন্তাই আসত না মাথায়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারা, গাড়ি নিয়ে ঘোরা, বিচে যাওয়া...এভাবেই সময় কাটত। তবে এটাও ঠিক, আমার কোনো বাজে অভ্যাস ছিল না। ড্রিঙ্ক করা বা কোনো ধরনের নেশায় আসক্তি, এসব কখনোই ছিল না। আমি যাদের সঙ্গে চলতাম, তাদের কারও কারও মধ্যে হয়তো এগুলো ছিল। কিন্তু তারাও আমাকে এই জিনিসগুলো থেকে দূরে রাখত। তারা জানত আমি বড় ক্রিকেটার হতে চাই। ওই সময় আমার বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলা হয়ে গেছে। সেজন্য তারা আমার ব্যাপারটা বুঝত।

তারেক: এলোমেলো তামিম এরপর এত সিরিয়াস! কীভাবে বদলালেন নিজেকে?

তামিম: একটা ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশ দল চট্টগ্রামে। ক্রিকেটাররা যখন এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অনুশীলন করে, আমি পাশেই চিটাগং ক্লাবের সামনে একটা জায়গায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারি। ওখানে গাড়িতে বসে বসেই আমরা আড্ডা দিতাম। আমাকেও ওই ক্রিকেটারদের সঙ্গে একদিন অনুশীলন করতে হবে, এই চিন্তাও তখন মাথায় নেই। তো ওই সময় একদিন ভাইয়া আমাকে কঠিন বকুনি দিল। বলল, ‘তোমার নিজেকে দেখে লজ্জা পাওয়া উচিত। তোমার বন্ধুবান্ধব জাতীয় দলে খেলছে। আর তুমি কী করছ? তোমার লজ্জা করা উচিত।’ এমন নয় যে ভাইয়ার ওই কথা শুনে আমি ৩৬০ ডিগ্রি বদলে গেছি। তবে কথাটা আমি মনে রেখেছি। ওই বকা খাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আমি জাতীয় দলে খেলি।

তারেক: জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কোনটাকে বলবেন?

তামিম: কঠিন সময় দুবার এসেছে জীবনে। প্রথমবার যখন আব্বা মারা গেলেন। দ্বিতীয়বার, আমি যখন একাডেমিতে সুযোগ পাই। আমার সঙ্গে একাডেমিতে যেরকম আচরণ করা হয়েছিল, সেটা আসলেই খুব খারাপ ছিল। জানি না কেন এটা হয়েছিল। আমি হয়তো কঠোর পরিশ্রম করতাম না, কিন্তু আমার কোনো বাজে অভ্যাস কখনো ছিল না। রাত জেগে ফোনে কথা বলা, লেটনাইট পার্টি—এসব অভ্যাস কোনো সময়ই ছিল না। কিন্তু একাডেমিতে আমার সঙ্গে এই বদনামগুলোও কীভাবে যেন আসে। মানুষ আমাকে একটু অন্যভাবে দেখত। ভাবত আমার মধ্যে সমস্যা আছে, আমি সুশৃঙ্খল নই। যেগুলো ছিল ভুল। আমি কষ্ট করতাম না, এটা আমি মানি। যতটুকু পরিশ্রম করা দরকার, অনুশীলন করা দরকার...আমি সেগুলো করতাম না। একাডেমিতে আসার পর আমি পছন্দ করে কাউকে রুমমেট বানালেও দুদিন পরপর আমার রুমমেট বদলে দেওয়া হতো। আমাকে সিনিয়রদের সঙ্গে রাখা হতো। এই জিনিসগুলোতে খুব কষ্ট পেতাম। অনূর্ধ্ব-১৩ থেকে যদি বলেন, আমি আজ পর্যন্ত কোনো জায়গা থেকে বাদ পড়িনি। জীবনে আমার একটাই কালো দাগ, ওটা হলো একাডেমি। পারফরম্যান্সের জন্য নয়, আমার পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। ওই বছর আমি জাতীয় লিগে প্রচুর রান করি। সম্ভবত তিনটা সেঞ্চুরি ছিল। এরপর একাডেমি দল পাকিস্তান সফরের আগে দেশে জাতীয় দলের সঙ্গে তিনটি ম্যাচ খেলে। তিন ম্যাচেই আমি ভালো খেলি। ওই বয়সে জাতীয় দলের বিপক্ষে সব ম্যাচে রান করি। চ্যাম্পিয়নের মতো ব্যাট করেছিলাম। অথচ পাকিস্তান সফরের একাডেমি দলে আমাকে না নিয়ে উত্তম ভাইকে নেওয়া হলো, যে কিনা ওই তিন ম্যাচে আমার ধারেকাছেও ছিল না। যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা সম্ভবত আমাকে পছন্দ করতেন না। আমি তাঁদের অপছন্দের শিকার ছিলাম। ওই কষ্টটা আমার এখনো আছে, আজীবন থাকবে।

তারেক: একাডেমিতে কী ধরনের আচরণ করা হতো আপনার সঙ্গে?

তামিম: দল যখন অনুশীলন করত, আমরা নেটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ব্যাটিং, বোলিং কিচ্ছু পেতাম না। ওরা সবকিছু পাচ্ছে, আমি কিছু পাচ্ছি না—এটা সহ্য করতে পারতাম না। মেনে নিতে পারতাম না। দল পাকিস্তান চলে যাওয়ার পর বাসায় যখন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তোমার নাম নেই কেন একাডেমি দলে? লজ্জায় আমি মিথ্যা কথা বলতাম। আমি বলতাম, দুটি দল যাবে তো। একটা পাকিস্তানে যাবে, আরেকটা ভারতে। আমি পরেরটাতে যাব। দল চলে যাওয়ার পরও আমাদের পাঁচজনকে প্রতিদিন মাঠে আসতে হতো। পাঁচজন খেলোয়াড়, সাতজন কোচ। ব্যাটিং, বোলিং হতো খুব কম। মাঠে আসতাম আর দৌড়াতাম। যেন আমরা মানুষ না! সব খারাপেরই অবশ্য একটা ভালো দিক থাকে। একদিন আমি ড্রেসিংরুম থেকে মাঠ দিয়ে হেঁটে ইনডোরের দিকে যাচ্ছিলাম। শহীদুল আলম রতন স্যার তখন আমার পাশে। উনি বললেন, ‘তামিম, তোমার যে প্রতিভা, তোমার জায়গায় আমি থাকলে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে বলতাম, ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় দলে খেলব।’ আমি হাসি। একাডেমি দলে সুযোগ পাইনা, জাতীয় দলের কথা তো মাথায়ই আসে না। কিন্তু দেখেন, আমি তার তিন মাসের মধ্যে জাতীয় দলে! ওটার পরপরই হলো প্রিমিয়ার লিগ। সম্ভবত ১০ ম্যাচ খেলে আমি সাতশর ওপরে রান করি। দুইটা না তিনটা সেঞ্চুরি। যে ছেলে একাডেমি দল থেকে বাদ পড়েছে, সে তিন মাসের মধ্যে জাতীয় দলে। ওই যে সময়টা—পাঁচটা খেলোয়াড়, সাতটা কোচ, হয়তোবা ওই সময় আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু ওই সময়ের কষ্টটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।

তারেক: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পর নিশ্চয়ই ২০১৫ সালটাকেই সবচেয়ে বাজে সময় বলবেন...

তামিম: হ্যাঁ, ২০১৪-১৫। তবে সেটা ছিল অন্যরকম। আমার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আমি ভালো খেললাম কি খারাপ খেললাম—এসব নিয়ে বেশি আলোচনা হতো। সবচেয়ে খারাপ ছিল একটু খারাপ খেললে যেভাবে আমাকে আক্রমণ করা হতো। এটা যদি শুধু আমার ওপর থাকত, আমি হয়তো সামলে নিতে পারতাম। কিন্তু বিষয়টা আমার পরিবার পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার স্ত্রীকে রাতে ফোন করে গালাগাল দিয়েছে মানুষ। এই জিনিসটা নিতে পারিনি আমি। আমার কথা হলো, তাদের কী দোষ? তারা তো আর খেলে না, ব্যাটিং করে না। আমি খেলি, আমি ব্যাটিং করি...খারাপ খেললে আমি খারাপ খেলি। আমার পরিবারকেও যখন মানুষ আক্রমণ করল, আমার মাথা ঠিক থাকল না। ওই সময়ে আমি সবচেয়ে ভালো যে কাজটা করেছি, তা হলো ওমরাহ করতে চলে যাওয়া।

তারেক: এরপর থেকে তো প্রায়ই ওমরাহ করতে যান। প্রতিবারই কি এর সঙ্গে বাজে সময় কাটিয়ে ওঠার সম্পর্ক থাকে?

তামিম: দেখুন, তখনো কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্য ভাবিনি এর সঙ্গে ভালো খেলতে চাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে। আমি গিয়েছিলাম মানসিক প্রশান্তির জন্য। সবাই বলে সবচেয়ে শান্তির জায়গা মক্কা-মদিনা। আমি সেই শান্তির খোঁজে গিয়েছিলাম। খেলার সুবাদে আমি অনেক দেশে ঘুরেছি, কিন্তু ওরকম শান্তি কোথাও পাইনি। সব ধর্মের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা ধর্ম পুরোপুরি মানেন না, তাঁদের একটা কথা বলতে চাই। ছুটি কাটাতে তো আপনারা অনেক জায়গায় যান। ওমরাহ বা হজকরার দরকার নেই, ছুটি কাটানোর কথা ভেবেই একবার মদিনায় যান। তাহলে বুঝবেন জায়গাটা আসলে কী। ওখানে যাঁরা গেছেন তাঁরাই শুধু জানেন মক্কা-মদিনায় কী শান্তি আছে। ওখানে যাওয়ার পর ক্রিকেট, ধনসম্পদ, টাকাপয়সার কথা একবারের জন্যও আমার মাথায় আসেনি। আমি শুধু আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছি। যে মানসিক শান্তিটা ওখানে পেয়েছি, আমার জন্য ওটা ছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ক্রিকেট, ব্যক্তিগত জীবন—সবকিছুর জন্যই। আমি খুব সতেজ হয়ে ফিরে আসি সেখান থেকে। আল্লাহও আমার প্রতি অত্যন্ত সহায় ছিলেন। আমি পাকিস্তান সিরিজে খেলি। বাকিটা ইতিহাস।

বাবার পরে ভাই

তারেক: বাবার পরই আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনার ভাই। আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বড় ভাই নাফিস ইকবালের কেমন ভূমিকা?

তামিম: আমার কাছে আব্বার পরই ভাইয়ার স্থান। আম্মুর কাছে অনেক সময় অনেক কিছু চাইতে পারতাম না। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ফোনে কথা বলব, সেই টাকা তো আর আম্মুর কাছে চাওয়া যায় না। মায়ের কাছে কিছু চাওয়াটা আমার কাছে কখনোই স্বস্তিকর কিছু ছিল না। বাবা থাকার সময় থেকেই। যখনই আমার কোনো কিছু লাগত, আব্বার কাছ থেকে নিতাম। আব্বা চলে যাওয়ার পরও আম্মার কাছে চাওয়ায় বাধা থেকে গিয়েছিল। অনেকে বলতে পারেন নাফিস ক্রিকেটার হিসেবে সফল হতে পারেননি। তার যতটুকু প্রতিভা ছিল সে হিসেবে সে জাতীয় দলে খেলতে পারেনি, এটা আমিও মানি। তবে আমার চোখে নাফিস ইকবাল হলেন সবচেয়ে সফল মানুষ। কারণ ক্রিকেট খেলে উনি যে কয় টাকা আয় করেছেন, তার ৯০ শতাংশ আমাদের পেছনে খরচ করেছেন। আমাদের চট্টগ্রামের বাসার প্রতিটি জিনিস তাঁর হাতে গড়া। আমার বেডরুমে যে বেড আছে, টয়লেটে যে ফিটিংস আছে, আমার ঘরে যে এসিটা চলে, যে টেলিভিশনটা আছে এখনো...সব আমার ভাইয়ের দেওয়া। যে কম্বলটা আমি গায়ে দিই, যে সোফায় আমার মেহমান বসে, ওগুলোও আমার ভাইয়ের টাকায় কেনা। চট্টগ্রামের বাসায় আপনি যা-ই দেখবেন, সব ভাইয়ার করা। আব্বা যেরকম করে আমার খেয়াল রাখতেন, আমার ভাইয়াও ঠিক সেভাবেই আমার খেয়াল রেখেছেন। এখনো তিনি তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে আমার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করেন।

তারেক: এই ভাইকেই তো একবার বল মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন...

তামিম:সেটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা ছিল। ইচ্ছে করে তো মারিনি, প্র্যাকটিস করতে গিয়ে লেগে গিয়েছিল। ব্যথা পেয়ে ভাইয়া যখন অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি, আমি রাতের বেলা বাসায় যেতামনা। নিচতলায় দর্শনার্থীদের স্টিলের চেয়ারে ঘুমাতাম। গাড়িতে ঘুমাতাম। মোটকথা হাসপাতালেই থাকতাম। অপরাধবোধ কাজ করত আমার মধ্যে। কারণ ওটা আমার জন্য ঘটেছে। আমি তাঁকে ওখানে ছেড়ে যেতাম না। কিন্তু সুস্থ হয়ে আসার পর এ নিয়ে ভাইয়া একটা কথা বলেননি। আমাকে কখনো বুঝতে দেননি এর পেছনে আমি ছিলাম বা এ নিয়ে তার মন খারাপ হয়েছে। এমনকি আমার ভাবিরও কখনো এটা নিয়ে কোনো কথা ছিল না। সবাই জানে খেলার মধ্যে এটা হতেই পারে। কিন্তু আমি নিজেকে নিজেই ক্ষমা করতে পারছিলাম না।

বন্ধু তুমি শত্রু তুমি

তারেক: সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে এখন আপনার মনোভাব কী?

তামিম: মিডিয়ার সঙ্গে আমার দুটি পর্ব বলতে পারেন। একটা পর্ব ছিল যখন মিডিয়াকে শত্রু ভাবতাম। মনে হতো, তাঁদের সঙ্গে থাকা যাবে না। তাঁরা আমার বন্ধু হতে পারে না। আর এখন আমি চিন্তা করি, তাঁরা কী করছেন না করছেন আমি সেইহিসাব করে কারও সঙ্গে মিশব না। আমার কি মিডিয়াতে বন্ধু নেই? অবশ্যই আছে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যেই তো একজন আছে ক্রীড়া সাংবাদিক। এখন আমি যখনই সাংবাদিকদের সঙ্গে মিশি, আমি কিন্তু মন থেকেই মিশি। ক্রিকেটার হিসেবে মিশি না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি সবার সঙ্গে ওভাবে মিশি না। হাতে গোনা ছয়-সাতজন আছেন যাঁদের সঙ্গে আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা। পেশাগত জীবন, ব্যক্তিগত জীবন সব নিয়েই তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। তবে আমি এটা কখনোই ভাবি না যে, অমুকের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, কাজেই সে আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু লিখতে পারবে না। এটা তাঁর পেশা। আবার কেউ যদি আমার সম্পর্কে খুব ভালো লেখে, তাকে আমি বাড়তি খাতিরও করি না। যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো, সে ভালো-খারাপ যা–ই লিখুক, সম্পর্ক ভালোই থাকবে। যাঁরা আমাকে নিয়ে খারাপ লেখেন বা বলেন, আমি তাঁদের সঙ্গেও একই আচরণ করি। আমার খারাপ লাগাটা বুঝতে দিই না। একটা সময় ছিল যখন আমি এটা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম।

তারেক: মানুষ তামিম ইকবালের কোন দিকটা আপনার অপছন্দ?

তামিম: খারাপ তো নিশ্চয়ই অনেক কিছু আছে। ভালো–খারাপ মিলিয়েই মানুষ। আমার মধ্যেও খারাপ অনেক কিছু আছে। প্রথমত ধর্মীয় দিক থেকে আমি যদি আরেকটু সচেতন হই, আমি যদি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারি...। আমি সবসময় তা পারি না। আমার খারাপের মধ্যে এটা অন্যতম। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তাঁর প্রতি আমার আরও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আর একটা জিনিস, আমি মানুষের সঙ্গে অনেক মজা করতে পছন্দ করি। তবে সেটা কখনোই কাউকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। আমি মজা করি তাদের সঙ্গেই, যাদের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ। তবে আমার মজার কারণে কিছু মানুষ কখনো কখনো কষ্টও পেয়ে যেতে পারেন। তাঁদের এটাই বলব, আমি এটা ইচ্ছা করে করি না।

তারেক: তারকা হওয়ার পর জীবনে অনেক পরিবর্তনই আসে। শুরুতে কীভাবে নিয়েছিলেন সেটাকে?

তামিম: তারকাজীবনের শুরুটা খুব রোমাঞ্চকর। খুব উপভোগ্য। একটা রেস্টুরেন্টে আগের দিন বসেছেন, কেউ চেনেনি। পরের দিন গেছেন, সবাই এসে ছবি তুলছে, অটোগ্রাফ নিচ্ছে, কিছু বলার আগেই ২০ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট করে দিচ্ছে, বাসায় গিফট চলে আসছে...এরকম কত কিছু! পুরো রঙিন মনে হতো জীবনটাকে। তবে এই ভালো লাগা ধরে রাখাটা সমান কঠিন। শুরুর দিকে যখন সবাই ছবি তুলতে আসত খুব ভালো লাগত। এরপর একটা সময় এল, এসবে বিরক্ত লাগা শুরু হলো। তখন আবার চিন্তা করতাম, এই মানুষদের কারণেই তো আজ আমি তামিম। এটা আমার ভুলে গেলে তো হবে না। কেউ ছবি তুলতে চেয়েছে, আমি না করেছি...পরে অনেক সময় আমারই খারাপ লেগেছে। তবে ভক্তদেরও বোঝা উচিত আমি সব সময় ভালো মেজাজে না–ও থাকতে পারি। আমার জীবনে আরও অনেক কিছু আছে। সেসব কারণে আমারও মন খারাপ থাকার সময় আসে, বিরক্তি আসে। সেজন্যই বলি, তারকাখ্যাতি ধরে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যত ওপরে উঠতে থাকবেন, আপনার মাথা অত নিচু থাকতে হবে। চটপটি খেতে গিয়ে অনেক সময় গাড়ির গ্লাস তুলে ভেতরে বসে খেয়ে এসেছি যাতে কেউ না দেখে। তাৎক্ষণিকভাবে এগুলো বিরক্ত লাগলেও পরে ওই বিরক্তি লাগার জন্যই খারাপ লাগে। আসলে এই জিনিসটার জন্যই তো একসময় লাফালাফি করেছি, অপেক্ষা করেছি, কষ্ট করেছি। এটাই তো চেয়েছি জীবনে! এখন যখন তা পাচ্ছি, তখন আমার কাছে খারাপ লাগলে তো হবে না।