মুশফিকুর রহিম

নাম

মোহাম্মদ মুশফিকুর রহিম

জন্ম

জুন ০৯, ১৯৮৭, বগুড়া

ধরন

উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান

অভিষেক

বনাম জিম্বাবুয়ে, আগস্ট ৬, ২০০৬

বিশ্বের প্রতিটি ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন থাকে লর্ডসের মাঠে জীবনে অন্তত একবার খেলার। মুশফিকুর রহিমের সেই স্বপ্ন দানা বাঁধার আগেই পূরণ হওয়ার সুযোগ চলে এল। যখন তিনি ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সিরিজে ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি। বয়স তখন মাত্র ১৬, চোখেমুখে কৈশোরের চপলতা তখনো উঁকি দেয়। তবে মূল একাদশে সুযোগ পাওয়াটা একেবারে সহজ কথা নয়, দলে যে তখনো আছেন খালেদ মাসুদ পাইলট! প্রয়োজন ছিল নিজেকে প্রমাণ করার।

সেই সুযোগটা নিলেন একদম মোক্ষম সময়ে, এসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৬৩ ও ১১৫ রানের দুই ইনিংস খেললেন। ফলাফল এল সঙ্গে সঙ্গেই, লর্ডসে অভিষেক হয়ে গেল মুশফিকুর রহিমের।

পরের গল্পটা সবার জানা। দলের পঞ্চপাণ্ডবের একজন তিনি, সবচেয়ে পরিশ্রমীও বটে। বাংলাদেশ দলের কঠিন এক সময়ে আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর, ব্যাটিং টেকনিক পোক্ত হলেও ধারাবাহিকতা তেমন ছিল না। সেই মুশফিক এখন দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানদের একজন। মুশফিক হয়ে উঠেছেন একজন সত্যিকারের যোদ্ধা, একজন আদর্শ ব্যাটসম্যান। বর্তমান প্রজন্মের জন্য দারুণ এক উদাহরণ, যিনি খুব ভালো করে জানেন নিজের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা।

লর্ডসে অভিষেক হওয়া সেই ‘বাচ্চা’ ছেলেটা ইতিমধ্যেই খেলে ফেলেছেন ৬৬ টেস্ট, ২০৫ ওয়ানডে এবং ৭৭ টি-টোয়েন্টি। প্রতিটি ফরম্যাটেই নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেছেন, সীমিত ওভারের ক্রিকেট কিংবা লঙ্গার ভার্সন। দলকে বিজয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন যেমন, পরাজয়ের গ্লানিতেও ডুবতে হয়েছে বহুবার। কখনো উড়েছেন অতিমানবীয় সব ইনিংস দিয়ে, আবার কখনো ডুবেছেন ব্যর্থতার অমানিশায়। কখনো প্রশ্ন উঠেছে তাঁর উইকেটকিপিং নিয়েও।

২০০৪ ও ২০০৬ সালে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে, অধিনায়ক হয়েই গিয়েছিলেন ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের পরের মাসেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সিরিজ খেলেছেন, তবে সাফল্য পাননি। গোড়ালির ইনজুরিতে কিছু সময়ের জন্য বাইরে চলে যেতে হয়েছিল। ফিরেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে। এরপর দলে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে বেশি দিন দেরি হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮০ রানের এক ইনিংস দিয়েই দলে জায়গাটা স্থায়ী করে ফেলেন মুশফিক।

২০০৭ বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন দলের মূল উইকেটরক্ষক হিসেবেই, আর ভারতের বিপক্ষে সেই স্বপ্নিল ম্যাচে সাকিব-তামিমের পাশাপাশি অর্ধশতক করেছিলেন, জয়সূচক রানটাও এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই। তবে অধারাবাহিকতার কারণে দল থেকে বাদও পড়েন মুশফিক, তাঁর বদলে দলে সুযোগ পান ধীমান ঘোষ।

তবে বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএলে ধীমান চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের এক নম্বর উইকেটরক্ষক হয়ে যান মুশফিক। এরপর হয়ে ওঠেন দলের মূল ব্যাটসম্যানদের একজন। ২০০৯ সাল থেকে তাঁর ফর্মে দেখা যায় উষার আলো। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটুর জন্য মিস করে ফেলেন নিজের প্রথম সেঞ্চুরি। তবে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি মুশফিককে, ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষেই করে বসেন নিজের প্রথম টেস্ট শতক। তাতে দল না জিতলেও তিনি আবার আলোচনায়।

পরের বছর বিস্মৃতির জিম্বাবুয়ে সফর শেষে ছাঁটাই হন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, স্থলাভিষিক্ত হন মুশফিকুর রহিম। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর ২০১২ সালে শুরু হয় ছয় দলে সাজানো বিপিএল। বিসিবির সিদ্ধান্তে ‘দুরন্ত রাজশাহী’র আইকন প্লেয়ার নির্বাচিত হন। সেই মৌসুমে মুশফিক করেন ১১ ম্যাচে ২৩৪ রান।

২০১২ এশিয়া কাপে মুশফিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তিন ম্যাচের দুটোতেই জিতে পৌঁছায় ফাইনালে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফাইনালে মাত্র ২ রানের পার্থক্যেই আটকে গেল বাংলাদেশ, টুর্নামেন্ট জিতে গেল পাকিস্তান। দুর্ভাগ্যের বুঝি সেটাই ছিল শুরু, এরপর যে টানা আরও পাঁচটি ফাইনাল হেরেছে বাংলাদেশ!

২০১৩ সালের মার্চে গল স্টেডিয়ামে মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে দুর্দান্ত এক জুটি গড়লেন মুশফিক। আশরাফুল শেষ অবধি ১৯০ রানে থামলেও বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম দ্বিশতক তুলে নিতে ভুল করেননি মুশফিক।

২০১৪ সালের শুরুর দিকে ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের ক্যারিয়ারের সেরা সময় শুরু। অধিনায়ক হিসেবে বাজে একটা সময় কাটালেও ব্যাট হাতে রীতিমতো স্বপ্নিল এক অধ্যায় রচনা করছিলেন। ২০১৪ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ইনজুরি নিয়েও করলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শতক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করলেন নিজের তৃতীয় টেস্ট শতক। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়েও; না উঠেই উপায় কী, ২০১৪ সালে যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ!

মুশফিকুর রহিম ওয়ানডে অধিনায়কত্ব মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছে হারালেও টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে গিয়েছিল। ওয়ানডে অধিনায়কত্ব হারানোর পরের সিরিজেই পাঁচ ওয়ানডেতে মুশফিক করেন ২১৩ রান, সিরিজ-সেরা খেতাবও পান। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দারুণ এক বিশ্বকাপ কাটান ব্যাট হাতে, ছয় ম্যাচে করেন ২৯৮ রান। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ১৪১ রানের জুটিই বাংলাদেশকে শেষ ষোলোর পথে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল, বললে অত্যুক্তি হয় না।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ শেষ হলেও ফর্মটা তিনি টেনে নেন পাকিস্তান সিরিজেও। তিন ম্যাচে ২২০ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশের স্বাদ দেন। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও দারুণ অবদান রেখেছিলেন মুশফিক।

উইকেটের সামনে বরাবরই দারুণ স্বচ্ছন্দ মুশফিকুর রহিম উইকেটের পেছনে কিছুটা অধারাবাহিকই। আবার এও সত্যি, যে মুশফিক সহজ স্ট্যাম্পিং মিস করেন হরহামেশাই, সেই মুশফিকই মাশরাফির বলে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে সুপারম্যানের মতো ক্যাচও নেন চোখের পলকে। ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমে রহস্যের বেড়াজাল না থাকলেও কিপার মুশফিকের রহস্য তাই উদ্‌ঘাটন করা দুরূহ বিষয়ই বটে!

ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানটা দারুণ, তবে হতে পারত আরও ভালো। একই কথা প্রযোজ্য বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়েও। দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান বটে, তবে সেটা অনায়াসেই হতে পারত ঢের বেশি। আর এবার ২০১৯ বিশ্বকাপে মুশফিক তাই দলের সঙ্গে সওয়ার হয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মিশনে, বিশ্বকাপটাকে পাখির চোখ করে এবার উঠতে চান অনন্য এক উচ্চতায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই তাঁর ব্যাটিং গড় অবিশ্বাস্য। অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না, অধিনায়ক মুশফিকের শেষের অধ্যায়টা কীভাবে তাতিয়ে দিয়েছে ব্যাটসম্যান মুশফিককে।

তবে কিপার মুশফিকের এখনো পাল্টা জবাব দেওয়ার ঢের বাকি।

[সব পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্বকাপ শুরুর আগপর্যন্ত]