অ্যাডিলেড, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য

উৎপল শুভ্র
উৎপল শুভ্র

দিন ধরে হিসাব করলে আজ থেকে ঠিক সোয়া চার বছর। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সর্বশেষ ম্যাচটার কথা বললে কী মনে পড়ে? এক নম্বরে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি আর বাতাসে চুমু ছড়িয়ে দেওয়া সেই উদ্যাপন। দুই নম্বরে তিন বলে দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার পর রুবেল হোসেনের ভোঁ দৌড়। এই সিরিয়ালেই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ম্যাচের শেষ ছবিটাই কারও চোখে আগে ভেসে উঠতে পারে।

এই দুটি দৃশ্য সবার জন্যই কমন। আমার অবশ্য কখনো কখনো এই দুটিকে ছাপিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরেকটি দৃশ্য। ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড দলের সংবাদ সম্মেলন, সাংবাদিকদের অনন্তকাল অপেক্ষা করিয়ে অবশেষে যেটিতে এসেছেন অধিনায়ক এউইন মরগান ও কোচ পিটার মুরস। যেন সংবাদ সম্মেলনে নয়, আদালতে হাজির দুই আসামি। মঞ্চে চেয়ার-টেবিলের ছদ্মাবরণে ওগুলো আসলে কাঠগড়া! ইংলিশ সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত মরগান আর মুরসের চোখমুখ দেখে একটা সময় একটু মায়াই লাগছিল। সংবাদ সম্মেলনটা হচ্ছিল অ্যাডিলেড ওভালের ইনডোরে। পাশেই প্রায় ছাদ থেকে নেমে আসা নেট, যেটিকে মনে হচ্ছে প্রতীকী। মরগান-মুরস যেন জালে আটকা পড়া মাছ!

মাঝের চার বছরে বারবার গভীর তাৎপর্য নিয়ে হাজির না হলে হয়তো এটি এমন স্পষ্ট মনে থাকত না। সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ভারত ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জিতে যাওয়ার পর অনেকেই বলেছিলেন, এই জয়ের বীজটা বোনা হয়েছিল গায়ানার বারবিসে। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে সেখানেই যে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওয়ানডেতে হারিয়েছিল ভারত। গত চার বছরে অনেকবারই মনে হয়েছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের পরাশক্তি হয়ে ওঠার বীজটা বোনা হয়েছিল অ্যাডিলেড ওভালের ওই সংবাদ সম্মেলনে। পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই হেরে বিশ্বকাপ থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নেওয়া বিব্রত, লজ্জিত ইংল্যান্ড দল এরপর থেকেই লিখতে শুরু করে ওয়ানডে ক্রিকেটের নতুন ব্যাকরণ।

আজ ২০১৯ বিশ্বকাপে আবার ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগে অ্যাডিলেড তো মনে পড়বেই। মনে পড়ছে চট্টগ্রামও। পরপর দুটি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ এবং কোনোটিই আর দশটা জয়ের মতো নয়। অ্যাডিলেডের ওই জয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। চট্টগ্রামের জয় এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে না পারলেও সেটি অনন্য অন্য কারণে। বিশ্বকাপে আর কোনো ম্যাচে এভাবে হারতে হারতে জেতেনি বাংলাদেশ।

ওই ম্যাচের কথা উঠলেই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে এএফপির সাংবাদিক কুলদীপ লালের সঙ্গে কথোপকথনটা মনে পড়ে। দিল্লি নিবাসী কুলদীপ দারুণ এক মানুষ, বাঙালি বিয়ে করেছেন বলেই কি না বাংলাদেশের প্রতি বাড়তি একটা টানও টের পাওয়া যায়। আফসোসের সুরে তিনি আমাকে বলছেন, ‘আহা, এই ম্যাচটা বাংলাদেশের জেতা উচিত ছিল।’ আমি সিরিয়াস মুখ করে বললাম, ‘বাংলাদেশ হেরে গেছে ধরে নিচ্ছ কেন? তুমি কি জানো না ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।’ কুলদীপ রসিকতা করছি বুঝতে পেরে হো হো হাসি দিলেন। আমিও তাতে যোগ দিলাম। আসলে তো রসিকতাই করেছি। ৮ উইকেট পড়ে গেছে, বাংলাদেশের জিততে তখনো ৫৭ রান লাগে। শফিউল ইসলামকে নিয়ে মাহমুদউল্লাহ তা করে ফেলবেন, কীভাবে তা ভাবব! কেউই ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না। বিশ্বকাপ উপলক্ষে পাহাড়তলীতে রাস্তার পাশে বিশাল যে একটা বাঘের মূর্তি বানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সেটির লেজের সঙ্গে কে বা কারা যেন একটা বিড়াল বেঁধে রেখে গিয়েছিল। ক্ষুব্ধ সমর্থক/সমর্থকেরা যে বার্তাটা দিতে চেয়েছিলেন, সেটি তো পরিষ্কারই-তোমরা নামেই বাঘ, আসলে তো বিড়াল।

আগের ম্যাচের হতাশাজনিত ক্ষোভও তাতে যোগ হয়েছিল। মিরপুরে যে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অলআউট হয়ে গেছে বাংলাদেশ। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনার মধ্যে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের মনে বেশি লেগেছে সাবেক ক্রিকেটারদের কথাবার্তা। প্রথম আলোতে লেখা কলামে সেটির কড়া জবাবও দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগে রীতিমতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। যে কারণে আরও মধুর হয়ে উঠেছিল ওই জয়।

‘অনন্য’ কথাটা অ্যাডিলেডের ম্যাচ সম্পর্কেও ব্যবহার করা যায়। সেই ম্যাচের আগে সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান ও কোচ ডেভিড লয়েডের বড় একটা ইন্টারভিউ করেছিলাম। বাংলাদেশকে ফেবারিট ঘোষণা করে দিয়ে যিনি জয়ের রেসিপিও বাতলে দিয়েছেন-স্পিন-স্পিন-স্পিন, স্পিনারদের লেলিয়ে দিলেই ইংল্যান্ড শেষ!

এমন ব্যতিক্রমী কোনো কথা নয়। এটা কে না জানে! অথচ কী আশ্চর্য, অ্যাডিলেডের ওই জয়ে বাংলাদেশের স্পিনাররা কোনো উইকেটও পাননি! তিন পেসারের ৮ উইকেট, বাকি দুটি রানআউট। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এই একটা জয়েই স্পিনারদের কোনো উইকেট নেই।

সর্বশেষ দুটি বিশ্বকাপের সুখস্মৃতি আছে আর আছে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন, যেখানে বাংলাদেশ হারে তো না-ই, উল্টো রূপকথা লেখে। নতুন দিন, নতুন ম্যাচ। জানি, খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর এসবের কোনো মূল্যই নেই। তবে এর আগ পর্যন্ত তো আছে, নাকি?