এ মাহমুদউল্লাহ কোন মাহমুদউল্লাহ!

নিজের মধ্যে নেই মাহমুদউল্লাহ। ছবি: এএফপি
নিজের মধ্যে নেই মাহমুদউল্লাহ। ছবি: এএফপি
>

বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটেই ৩৩০ করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু গত দুই ম্যাচে তিনি যেন পুরোপুরি অন্যরকম। ব্যাটে ধার নেই, নিজের খেলাটাই যেন খেলতে পারছেন না তিনি।

মাহমুদউল্লাহর মধ্যে কেমন একটা শান্ত নিস্তরঙ্গ নদীর ছাপ আছে। টলটলে, নির্বিকার ও ভাবলেশহীন চেহারা নিয়ে ব্যাট করতে পারেন ভীষণ চাপেও। সাধারণত টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানেরা যেমন হয়ে থাকেন আর কি। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ের জায়গা ছয়ে। যেখানে নামতে হয় বোলারের কাছ থেকে যত বেশি সম্ভব রান তুলে নেওয়ার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। শেষ করে আসতে হয় ইনিংস। এবারের ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রথম ম্যাচটি বাদ দিলে গত দুটি ম্যাচে বাংলাদেশের পঞ্চপাণ্ডবের একজন মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে সে ব্যাপারটা অনুপস্থিত।

গত দুটি ম্যাচেই একই অবস্থা। মাহমুদউল্লাহ পাল্টাননি। ছয়ে নেমে খেলেছেন শুরুর দিকে ইনিংস গড়ার মানসিকতা নিয়ে! যেন বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন। অথচ সমর্থকেরা গত দু-এক বছর ধরে এই একই পরিস্থিতিতে সবাই ভিন্ন মাহমুদউল্লাহকে দেখে অভ্যস্ত। দুটি ম্যাচে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যায়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০.২ ওভারে বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ১৫১—এ পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নেমেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। হাতে প্রায় ২০ ওভারের মতো থাকায় তাঁর মতো ব্যাটসম্যানের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি। দ্রুতলয়ে ‘সেট’ হয়ে দুর্দান্ত ফিনিশ করার সুযোগ ছিল।

মাহমুদউল্লাহ সেই সুযোগ ব্যবহার করেছেন এভাবে—যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন বাংলাদেশের ওভারপ্রতি গড় রানরেট ছিল পাঁচের ঘরে। ৪৩তম ওভারে যখন ফিরলেন সেই রানরেট নেমে গড়ে সাড়ে চারের আশপাশে। এরপর আর প্রায় পাঁচ ওভারের মতো টিকেছে বাংলাদেশের ইনিংস। যে সংগ্রহ তিন শ ছাড়িয়ে যেতে পারত তা থেমেছে অকালেই—২৪৪ রানে। শেষটায় এসে রানের চাকা আটকে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ায় মাহমুদউল্লাহর ৪১ বলে ২০ রানের ‘টেস্ট মেজাজ’ ইনিংসের অবদান কম নয়। এক প্রান্ত যেমন ধরে রাখতে পারেননি তেমনি যতক্ষণ ছিলেন রানের চাকার গতিও বাড়েনি। ২০ বলে ১০ থেকে ২৬ বলে ১১ আর সেখান থেকে ৩৩ বলে ১৪—এই যদি হয় ‘ফিনিশার’-এর অবস্থা তাহলে স্লগ ওভারে রানের ফোয়ারা বন্ধ হবেই।

আরেকটি বড় প্রশ্ন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের মতো পাহাড়সমান রান তাড়া করার চাপ ছিল না। শুধু ভালোভাবে শেষ করে আসতে হতো। প্রায় মজ্জাগত হয়ে পড়া কাজটাই করতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। সেটি আরও বেশি করে চোখে পড়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। নিউজিল্যান্ড ম্যাচের মতো প্রায় একই সময়ে (৩০তম ওভার) ব্যাটিংয়ে নামলেও পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। ৩৮৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের ওভারপ্রতি তখন গড়ে দশের ওপরে রান দরকার। মাহমুদউল্লাহ সেই প্রয়োজন মেটানোর শুরুটা করেছেন ২০ বলে ৬ রান করে। আর শেষ করেছেন (পড়ুন হয়েছেন) সেই ৪১ বলেই ২৮ রানে আউট হয়ে। বাংলাদেশের ওভারপ্রতি তখন গড়ে রান দরকার ২৫-এর ওপরে!

এ কোন মাহমুদউল্লাহ! আইসিসির টুর্নামেন্ট পেলেই ‘পয়া’ হয়ে ওঠে যাঁর ব্যাট, তেমনই এক মঞ্চে সেই একই ব্যাটসম্যানকে রান করতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সেটি আবার এমন দুটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে, যেখানে পথ খুঁজে নিতে মাহমুদউল্লাহই দলের সবেধন নীলমণি। দৃষ্টিটা আরেকটু বড় করলে খুব দৃষ্টিকটু আরেকটা প্রশ্নও বেরিয়ে আসে। আচ্ছা, মাহমুদউল্লাহর দলে আসলে ভূমিকাটা ঠিক কী?

ছয়ের ‘ফিনিশার’? সবশেষ দুটি ম্যাচে এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলের পথটাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের তিন ম্যাচে বোলিং যেহেতু করেননি তাই ফিনিশার হিসেবেই ধরে নিতে হচ্ছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জানা গিয়েছিল কাঁধে চোট আছে মাহমুদউল্লাহর। বল না করার সম্ভাবনাই বেশি। ঘটলও ঠিক তাই। তাহলে শুধু এই ব্যাটিং নিয়ে দলে...? খেলোয়াড়টি মাহমুদউল্লাহ বলেই প্রশ্নটি শেষ করা যাচ্ছে না আবার গিলে ফেলাও অসম্ভব। কারণ, কাঁধের চোট ব্যাটিংয়েও অল্পবিস্তর প্রভাব রাখে। সেটি যদি এতটাই প্রকট হবে তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই একই ব্যাটসম্যান ৩৩ বলে ৪৬* করলেন কীভাবে!

অথচ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘বোলার’ মাহমুদউল্লাহর অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল দলের। মোসাদ্দেক হোসেনের মতো তরুণ যখন তাঁর প্রথম ২ ওভারে ২৪ রান দেন তখন সেই প্রয়োজনটা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। সত্যি বলতে, এই দলের প্রয়োজনেই মাহমুদউল্লাহ নিজেকে বারবার পাল্টেছেন কিংবা তাঁকে পাল্টানো হয়েছে।

বাংলাদেশ দলে তাঁর আগমন বোলিং অলরাউন্ডার হয়ে। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলো মিডলঅর্ডারে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে। গত বিশ্বকাপে তার প্রতিদানও দিয়েছিলেন দুর্দান্ত। চারে নেমে তাঁর টানা দুই সেঞ্চুরির কীর্তি ভুলে যাওয়ার নয়। আবার সেই চার নম্বর থেকে তাঁকে ছয়ে নেমে ‘বিগ হিটার’-এর ভূমিকা নিতে হয়েছে সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পরামর্শে। প্রতিদানও দিয়েছেন। গত বছর নিদাহাস ট্রফিতে তাঁর ১৮ বলে অপরাজিত ৪৩ রানেই তো ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে এমন আরও ইনিংস তাঁর আছে।

কিন্তু চলতি বিশ্বকাপের সংস্করণটা ওয়ানডে। যেখানে ‘ফিনিশার’দের বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তোলার পরীক্ষাটা দিতে হয় বেশি সময়ের জন্য, পরিস্থিতি বিচারে ইনিংসও টানতে হয়। কৌশলগত পার্থক্যটা হলো, টি-টোয়েন্টিতে মারমুখী ব্যাটিংটা ওয়ানডের মতো অত বেশি সময়ের জন্য নয়। মাহমুদউল্লাহর মতো মিডলঅর্ডারে পরীক্ষিত স্ট্রোকমেকারের জন্য যা তুলনামূলক সহজ। ওয়ানডেতেও সহজ, সেটি অবশ্যই নিখাদ ‘বিগ হিটার’ যেমন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, আন্দ্রে রাসেল কিংবা ডেভিড মিলারদের জন্য। মাহমুদউল্লাহ কি নিখাদ বিগ হিটার?

পক্ষে-বিপক্ষে এ নিয়ে অনেক মত থাকতে পারে। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ যে মিলার কিংবা ম্যাক্মওয়েল নন সেটি কিন্তু সত্য। তিনি বরং পরীক্ষিত এক ব্যাটসম্যান যাঁকে দলের প্রয়োজনে নানারকম ভূমিকা নিতে হয়। শেষ দুই ম্যাচে তার ছিটেফোঁটা দেখতে না পাওয়ায় মাহমুদউল্লাহকে টপ অর্ডারে তোলা হোক সেই দাবি তোলাও এখন অযৌক্তিক। কারণ তিনে সাকিব আছেন জীবনের সেরা ফর্মে আর চার নম্বর জায়গাটা মুশফিকের জন্য একরকম ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। পাঁচে? মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ‘বিলাসিতা’ কি টিম ম্যানেজমেন্টের শেষ হয়েছে?

ধরে নেওয়া যাক, পাঁচে নামলেন মাহমুদউল্লাহ ; কিন্তু সবশেষ দুটি ইনিংসের চরিত্র থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারলেন না। তাহলে আবারও সেই প্রশ্নটাই উঠবে—দলে মাহমুদউল্লাহর ভূমিকা কী? ওয়ানডেতে ব্যাট করছেন টেস্ট মেজাজে, বোলিংয়ে দলের বিপদেও দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। এসব প্রশ্ন মাটিচাপা দিতে মাহমুদউল্লাহকে অন্তত ব্যাট হাতে আরও একবার নিজেকে বদলাতে হবে। সেই মাহমুদউল্লাহ—যিনি ফিনিশ করার সঙ্গে বলসংখ্যার চেয়ে রানকে এগিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। সমর্থকেরা এই মাহমুদউল্লাহকেই ভালোবাসে, শেষ দুই ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর মোড়কে অচেনা কাউকে নয়।