তির-ধনুকে রোমানের স্বপ্নযাত্রা: তালতলা থেকে টোকিও অলিম্পিক

টোকিও অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন রোমান সানা। ফাইল ছবি
টোকিও অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন রোমান সানা। ফাইল ছবি
>খুলনা শহর থেকে উঠে এসে টোকিও অলিম্পিকে খেলবেন রোমান সানা। বাংলাদেশের অগ্রসরমাণ আর্চারিতে যা বিরাট এক অনুপ্রেরণা

গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে যখন হল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারকে ফোন করা গেল, তিনি মাঠেই ছিলেন। জানালেন, রোমান সানা অনুশীলনে ব্যস্ত। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক গেমসে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জনই তাঁর এই ভ্রমণের শেষ নয়। আগামীকাল ব্যক্তিগত রিকার্ভে ব্রোঞ্জেরও লড়াই। এই রিকার্ভেই পরশু সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশের সেরা আর্চার তুলে নিয়েছেন আগামী বছর টোকিও অলিম্পিকে খেলার আরাধ্য ছাড়পত্র।

বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াবিদের এই সাফল্যটা অনেক বড়। এর আগে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার ‘কোটা প্লেস’ পেয়েছেন শুধু গলফার সিদ্দিকুর রহমান। তা-ও এভাবে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিযোগিতায় খেলে নয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৬০-এ থাকার কল্যাণে। তাঁর পরেরজন এই রোমান সানা। বাংলাদেশের প্রথম আর্চার যিনি নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকের মতো বিশ্বমঞ্চে হাজির করছেন নিজেকে।

সেটিও হল্যান্ডে চলমান আর্চারি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ চমক দেখিয়ে। বড় বড় খেলোয়াড়কে বিদায় করে। যাঁর মধ্যে আছেন ২০১১ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এই রিকার্ভে সোনা জেতা দক্ষিণ কোরিয়ার কিউ উজিনও (কোয়ার্টার ফাইনালে)। রোমান গড়লেন নতুন ইতিহাস।

এই প্রতিযোগিতায় একে একে জয় তুলেছেন অস্ট্রেলিয়া-হল্যান্ডের খেলোয়াড়ের বিপক্ষে। পরশু যখন খেলছিলেন মাঠে, উত্তেজনা, আবেগ সবই নেমে আসে বাংলাদেশ দলে। খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তারা শিহরিত। কারণ এই জিনিস আগে কখনো রাঙিয়ে দিয়ে যায়নি বাংলাদেশের আর্চারি। এ দেশের আর্চারির দেড় দশকের ছোট্ট ইতিহাসে এখন সেরা সময়টায় এসে পৌঁছেছে। যার পোস্টার বয় রোমান সানা। চশমা পরা আপাতশান্ত ছেলেটা তির-ধনুকের লড়াইয়ে এত তীক্ষ্ণ আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর যে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন। অলিম্পিকের মতো বিশ্বসেরা ক্রীড়ায় যেতে পারা সেটারই বিশাল এক পুরস্কার।

ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের একজন করে আর্চার এই টুর্নামেন্ট থেকে অলিম্পিকের টিকিট নিতে পেরেছেন। বাংলাদেশ থেকেও নিয়েছেন একজন!

রোমানের এই স্বপ্নযাত্রার পেছনে সিটি গ্রুপের অবদান অনেক। এই গ্রুপটিই পাঁচ বছর মেয়াদি আর্থিক চুক্তি করে আর্চারি ফেডারেশনের সঙ্গে, যেখানে তারা আর্চারি ফেডারেশনকে লক্ষ্য দিয়েছে ২০২৪ অলিম্পিক থেকে পদক আনার। আগামী আট বছরে অলিম্পিক থেকে পদক আনা লাল-সবুজের কোনো ক্রীড়াবিদের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু অলিম্পিক পদকের খোঁজে অন্তত মাঠে নামায় সিটি গ্রুপ ও বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন একটা করতালি দাবি করছেই।

বড় ধন্যবাদটা সবার আগে প্রাপ্য রোমান সানার। নিজেকে তৈরি করেছেন গভীর মনোযোগে। অনুশীলনে বলা হতো আজ ৩০০-৩৫০টি তির মারতে হবে। এটা শেষ করেই তিনি উঠতেন। লক্ষ্যপূরণ করতে জানেন। সেটিতে কোনো ছাড় নেই। সুইজারল্যান্ডে উচ্চতর প্রশিক্ষণে গিয়েও রোমান বলতে পারেন, ‘ওখানে আমি অনুশীলন করব না। কারণ, ওখানে আসা অন্যরা আমার সমকক্ষ নয়।’

নিজের ওপর এমন আস্থা যাঁর, সেই ছেলেটির আবিষ্কারক আর্চারি ফেডারেশন। ২০০৮ সালে খুলনায় আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি থেকেই উঠে আসা মুখ এই রোমান। শুরু থেকেই একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল তাঁর চলনবলনে। গতকাল হল্যান্ড থেকে ঢাকায় ফেরা বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ চপলও বলে যান, ‘ওর মধ্যে যে প্রতিভা আছে, সেটা আমরা দেখেই বুঝে নিই।’

২০০৮ সালে খুলনায় যিনি আর্চারি প্রতিভা খুঁজতে আর্চারির ফেডারেশনের তরফে কোচ হিসেবে গিয়েছিলেন, সেই সাবেক আর্চার সাজ্জাদ হোসেনের কথায়, ‘তখন খুলনায় ১০ দিনের একটা ক্যাম্পে আমাদের সার্কুলার দেখে রোমানও আসে। খুলনা শহরে পুরোনো স্টেডিয়ামের পাশেই সোনালি অতীত ক্লাব মাঠে অনুশীলনটা হয়। প্রথম দিনেই দেখি, খুলনা শিশু উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়া রোমান অন্যদের চেয়ে ভালো। আর্চার হওয়ার প্রয়োজনীয় সব গুণ ওর ছিল।’

সে ক্যাম্পে ৪০ জন ছেলেমেয়ে ছিল। সবাইকে ছাপিয়ে কিশোর রোমান নীরবে জানান তাঁর ভেতরের প্রতিশ্রুতি। পরে খুলনা থেকে শুধু তাঁকেই ঢাকায় নিয়ে আসা হলো দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলনের জন্য, যাঁর আন্তর্জাতিক সোনা আছে ৭টি। ব্যাংককে এশিয়া কাপের সোনা জিতেছেন ২০১৪ সালে, যা ছিল এত দিন তাঁর সেরা সাফল্য।

এসব কৃতিত্ব রোমান অবশ্য একা নিতে রাজি নন। ভাগ করে দিতে চান সবাইকে। টোকিও অলিম্পিকে খেলার টিকিট তোলার পরও তাই বলতে পারেন, ‘সবার সহায়তা না পেলে আমি এত দূর আসতে পারতাম না। সবাই আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন।’ কোচ ফ্রেডরিখ, কর্মকর্তা, স্পনসর—সবার প্রতিই তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞতা।

ও, হ্যাঁ, এতক্ষণে বলাই হয়নি। বছর কয়েক আগে ঈদের দিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পায়ের হাড় ভেঙে যায় রোমানের। সেই থেকে পায়ের ওপর বেশি চাপ পড়ে এমন খেলায় তাঁর পক্ষে আর ভালো করা সম্ভব নয়। এরপর আর্চারিটাই হয়ে যায় তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। যেখানে ভালোই মানিয়ে নিয়েছেন। যেখানে তিনি এখন বাংলাদেশে অগ্রসরমাণ আর্চারির সবচেয়ে বড় আশার নাম।

পরিবারটা অসচ্ছল। বাবা আবদুল গফুর সানা একটি মাছের কোম্পানিতে চাকরি করছেন। তিন ভাইবোনের সবার ছোটজন রোমানকে চাকরি দিয়েছে বাংলাদেশ আনসার। সংসারটা চলছে এভাবেই। খুলনা শহরে তালতলার টোটপাড়ার সানা পরিবারের কিশোর ছেলেটি এখন টোকিওতে আগামী অলিম্পিকে খেলবেন। ভাবা যায়!