যেসব কারণে হারল আর্জেন্টিনা

আবারও হতাশাই সঙ্গী হলো মেসিদের। ছবি: এএফপি
আবারও হতাশাই সঙ্গী হলো মেসিদের। ছবি: এএফপি
ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় এসে কোপা জিতে দেশের হয়ে নিজের প্রথম শিরোপা জিতবেন লিওনেল মেসি, কত আশাই না করেছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা! টুর্নামেন্টের শুরুতেই সে আশা বড়সড় এক ধাক্কা খেল। কলম্বিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে কোপা অভিযান শুরু করেছে তারা। তাদের হারের পেছনে কারণগুলো কী ছিল?

দেশের হয়ে শিরোপাখরা কাটানোর প্রচেষ্টায় আরেকবার আঘাত পেলেন লিওনেল মেসি। কোপা আমেরিকায় নিজেদের প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলে হেরেছে আর্জেন্টিনা। কলম্বিয়ার হয়ে গোল করেছেন রজার মার্টিনেজ ও দুভান জাপাতা। কিন্তু কাগজে–কলমে যে দলকে টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী দল হিসেবে মনে হয়েছিল, শুরুতেই সেই দলের এমন মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ কী?

শুরু করা যাক কলম্বিয়াকে নিয়ে কিছু কথা বলে। গত কয়েক বছরে যারা মোটামুটি ফুটবল নিয়ে খবর-টবর রাখেন, তাঁরা জানবেন, কলম্বিয়া কিন্তু হেলাফেলা করার মতো কোনো দল নয়। যে দলে রাদামেল ফালকাও (মোনাকো), হামেস রদ্রিগেজ (রিয়াল মাদ্রিদ), ডেভিনসন সানচেজ (টটেনহাম), দুভান জাপাতা (সাম্পদোরিয়া), লুইস মুরিয়েল (ফিওরেন্টিনা), সান্তিয়াগো আরিয়াস (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ), ডেভিড অসপিনা (নাপোলি), ইয়েরি মিনা (এভারটন), উইলমার ব্যারিওস (জেনিত), জেফারসন লেরমা (বোর্নমাথ), হুয়ান কুয়াদ্রাদোর (জুভেন্টাস) মতো ইউরোপীয় লিগের বিভিন্ন শক্তিশালী দলে খেলা খেলোয়াড়েরা থাকেন, সে দলকে আর যা-ই হোক না কেন, হেলাফেলা করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায়, দলে ইউরোপীয় বড় বড় দলে থাকা খেলোয়াড়েরা থাকলেও তাঁদের মধ্যে রসায়নটা ঠিক জমে ওঠে না, ফলে ভুগতে হয় জাতীয় দলকে। আর্জেন্টিনাই যার জ্বলন্ত উদাহরণ। কলম্বিয়ার এই সমস্যা দুই বছর আগে থাকলেও এখন আর নেই। আর সেটা মেসিদের এক গুরুর কারণেই নেই। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মেসি-আগুয়েরোদের যে কোচ দীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই হোসে পেকারম্যান গড়েছেন কলম্বিয়ার এই দলকে। সাত বছর ধরে তিল তিল করে এই কলম্বিয়া দলটাকে গড়ে দায়িত্ব ছেড়েছেন সদ্য। আর্জেন্টিনার খেলা যাঁরা নিয়মিত অনুসরণ করেন, তাঁদের অনেকের মতেই গত দেড় দশকে আর্জেন্টিনার সেরা দল ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপের দলটা। সে দলের কোচ এই পেকারম্যানই ছিলেন। মেসি, আগুয়েরো, মাচেরানো, ডি মারিয়া, মিলিতো, হিগুয়েইনদের তারকা হওয়ার শুরুটা এই কোচই করে দিয়েছিলেন। কলম্বিয়ার বর্তমান কোচ কার্লোস কুইরোজ পেকারম্যানের বানানো দলটাকেই সুগঠিত করেছেন আরও। কুইরোজের সাবেক দল, যেমন: পর্তুগাল, রিয়াল মাদ্রিদ, ইরানের খেলা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, রক্ষণভাগের দৃঢ়তার ওপর কেমন গুরুত্ব দেন এই কোচ। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ইরান ম্যাচটার কথা মনে আছে? যে ম্যাচে মেসির একদম শেষ মুহূর্তের গোলে ম্যাচ জিতল আর্জেন্টিনা? সে ম্যাচে ইরানের কোচ ছিলেন কুইরোজ। সেদিনও পুরো ম্যাচ মেসিদের বিরক্ত করেছিল ইরানের রক্ষণভাগের দৃঢ়তা।


এই ম্যাচেও সে জিনিসই দেখা গেছে। নিজেদের শারীরিক শক্তি ও উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্দান্তভাবে রক্ষণ করে গেছে কলম্বিয়া। মেসি, আগুয়েরো, ডি মারিয়ারা সানচেজ, ব্যারিওস, মিনাদের সামনে একদম কাঠের পুতুল হয়ে ছিলেন যেন। নিজেদের ঘর সামলে কলম্বিয়া যখনইই আক্রমণে গেছে, সে জবাবটাও জানা ছিল না আর্জেন্টিনার। ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত খেলে এই মৌসুমেই পর্তুগিজ চ্যাম্পিয়ন এফসি পোর্তোতে নাম লেখানো রেনজো সারাভিয়া যেন এই ম্যাচে খেলতে ভুলে গেলেন। কিছুদিন আগেই ব্রাজিলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে নেইমারকে পুরো ম্যাচ বোতলবন্দী করে রাখা সারাভিয়ার দিক দিয়েই দুটি গোল করেছে কলম্বিয়ার। মাঝমাঠ থেকে হামেস রদ্রিগেজের উড়ন্ত পাস আক্রমণভাগের বাঁ দিকে পেয়ে সারাভিয়াকে পরাস্ত করে ডান পায়ের দূরপাল্লার শটে ম্যাচের ৭১ মিনিটে গোল করেছেন রজার মার্টিনেজ। ৮৬ মিনিটে দ্বিতীয় গোলেও সারাভিয়ার ব্যর্থতাই চোখে পড়েছে। ডান দিক থেকে জেফারসন ফারফানের মাপা ক্রস খুঁজে পেয়েছিল আর্জেন্টিনার দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে থাকা কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার দুভান জাপাতাকে। ম্যাচ শেষ ওখানেই। আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের মধ্যে বাকি তিনজনের চেয়ে এক সারাভিয়াই যা একটু আনকোরা। কার্লোস কুইরোজও সেই সারাভিয়াকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন, বোঝা গেছে। কলম্বিয়ার অধিকাংশ আক্রমণ সারাভিয়ার দিক থেকেই এসেছে। সারাভিয়াও কুলিয়ে উঠতে পারেননি।

কৌশলী খেলার পুরস্কার পেয়েছে কলম্বিয়া। ছবি:এএফপি
কৌশলী খেলার পুরস্কার পেয়েছে কলম্বিয়া। ছবি:এএফপি

প্রথমার্ধেও জঘন্য খেলেছে আর্জেন্টিনা। ঠিক কোন স্টাইলে খেলবে, পাস করে, না প্রেস করে, তা লং বলে, সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না তারা। বল মাঝমাঠ পেরিয়ে মেসি, আগুয়েরোদের কাছে গেছে কদাচিৎ। আর যখনই গেছে, তখনই গোলবারের সামনে নির্বিষ হয়ে ছিলেন ক্লাবের হয়ে একের পর এক দুর্দান্ত মৌসুম কাটানো মেসি-আগুয়েরো-মারিয়ারা। মারিয়া এতটাই জঘন্য খেলছিলেন, প্রথমার্ধে শেষ হওয়ার পরপরই তাঁকে উঠিয়ে উদিনেসের রদ্রিগো ডি পলকে নামান কোচ লিওনেল স্কালোনি। তিনি নেমেই বাঁ প্রান্ত থেকে যা একটু ভীতির সঞ্চার করেছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে। মেসি–পারেদেসের কিছু আক্রমণ দিকনির্দেশনাহীন হওয়ার কারণে কলম্বিয়ার গোলরক্ষক ডেভিড ওসপিনার থামাতে বিন্দুমাত্রও কষ্ট হয়নি।

আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা মনে হয়েছে মিডফিল্ডকে। কাগজে-কলমে লিয়ান্দ্রো পারেদেস আর জিওভানি ল চেলসোকে গড়া মিডফিল্ড যেকোনো দলই চাইবে। কিন্তু ওই যে রসায়ন থাকতে হবে তো! দুর্ধর্ষভাবে প্রতি–আক্রমণে যাওয়ার পাশাপাশি এই কলম্বিয়া দলের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের শারীরিক সামর্থ্য। মিনা, উরিবে, তেসিয়ো, ওসপিনা, সানচেজ, লেরমা, মার্টিনেজ, ব্যারিওস—সবাই মোটামুটি ষন্ডামার্কা, ব্যারিওস ছাড়া সবার উচ্চতাই ছয় ফুটের ওপর। তুলনামূলক খর্বকায় আর্জেন্টিনার তিনজনের মিডফিল্ড শক্তিতে পেরে ওঠেনি। তার ওপর কুইরোজ দলকে সাজিয়েছিলেন ৪-৫-১ ছকে, অর্থাৎ মিডফিল্ডে পাঁচজন থাকবেনই। আদর্শ প্রতি-আক্রমণভিত্তিক সিস্টেম। আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডে খেলোয়াড়ের সংখ্যা প্রথম থেকেই তাই দুজন কম ছিল। যাঁদের মধ্যে ল চেলসো আর পারেদেস সব সময়েই আক্রমণ করতে বেশি পছন্দ করেন, রক্ষণকাজ ভুলে গিয়ে। ফলে, রক্ষণভাগকে সহায়তা করার জন্য আনকোরা গিদো রদ্রিগেজ ছাড়া কেউই ছিলেন না। তিনি একা পেরে ওঠেননি। এমনকি দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর জায়গায় নামা আরেক ‘গিদো’—পিজ্জারোও কলম্বিয়ার মিডফিল্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেননি। জাপাতা, মার্টিনেজরা অনায়াসে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ড ভেদ করে আক্রমণে চলে যেতে পেরেছেন। তাও আর্জেন্টিনা হয়তো পেরে উঠত, যদি আক্রমণভাগের অন্তত একজন খেলোয়াড় নিচে নেমে মিডফিল্ডকে সহায়তা করতে পারতেন। ওপরে মেসি-আগুয়েরো যেহেতু আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যকার রসায়নটা ফিরে পাচ্ছিলেন, সেহেতু এ দায়িত্বটা লেফট উইঙ্গার আনহেল ডি মারিয়ার নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সারা জীবন তিনি যেমন খেলেন, এ ম্যাচেও তেমনই খেলেছেন, আদর্শ উইঙ্গারের মতো ওপরে থাকতে চেয়েছেন, নিচে নামতে চাননি। আর এই সুবিধাটা কলম্বিয়া পুরোপুরি নিয়েছে। পরে ডি মারিয়াকে নামিয়ে রদ্রিগো ডি পলকে নামানো হয়। এমন না যে তিনি আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডকে খুব সহায়তা করেছেন, কিন্তু আক্রমণভাগে অন্তত ডি মারিয়ার চেয়ে ভালোভাবে সহযোগিতা করতে পেরেছেন। ডি মারিয়ার জায়গায় ওয়াটফোর্ডের রবার্তো পেরেইরা খেললে হয়তো এই সমস্যার সমাধান একটু হলেও হতো। নিচে নেমে মিডফিল্ডে খেলতে পারেন এই উইঙ্গার। কিন্তু চোটে পড়ে কোচকে সে কৌশলগত সুবিধাটুকু দিতে পারেননি পেরেইরা।

এই ছকেই খেলেছে আর্জেন্টিনা। ছবি: সংগৃহীত
এই ছকেই খেলেছে আর্জেন্টিনা। ছবি: সংগৃহীত

যেহেতু কলম্বিয়ার মিডফিল্ডে পাঁচজন ছিল, আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি ৪-৩-৩ ছকে দলকে না খেলিয়ে ৪-২-৩-১ বা ৪-৫-১ ছকে দলকে সাজালে পরাজয় হয়তো এড়ানো যেত। অর্থাৎ একজন উইঙ্গার কম খেলিয়ে একজন মিডফিল্ডার বাড়তি খেলালে হয়তো শক্তিশালী কলম্বিয়াকে আরেকটু ভালোভাবে আটকাতে পারত আর্জেন্টিনা। সেটা হয়নি। মেসি-আগুয়েরোর রসায়ন জমার ঠিক পরপরই দ্বিতীয়ার্ধে সার্জিও আগুয়েরোকে উঠিয়ে নেওয়াটাও তেমন সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়নি। আগুয়েরোর জায়গায় মাতিয়াস সুয়ারেজ নেমে তেমন কিছুই করতে পারেননি। উল্টো একটা অতিরিক্ত মিডফিল্ডারের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা আর্জেন্টিনা দল শেষমেশ কলম্বিয়াকে আর আটকাতে না পেরে শেষ ২০ মিনিটের মধ্যে দুই গোল খেয়ে বসে।

ম্যাচের আগের দিন নিজের মূল একাদশ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। সেটা মাথায় রেখে নিজের কৌশল ঠিক করার এন্তার সময় পেয়েছেন কুইরোজ। এবং সে কৌশলে সফলও হলেন দুর্দান্তভাবে। গ্রুপ পর্বে মেসিদের বাকি দুই ম্যাচ প্যারাগুয়ে আর কাতারের সঙ্গে। বাকি দুই ম্যাচের মধ্যে একটাও হেরে গেলে পরের রাউন্ডে উঠতে ভাগ্যের দিকে তাকানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না মেসিদের। (ছবি - Argentina 2)

আর্জেন্টিনা একাদশ: ফ্রাঙ্কো আরমানি, রেনজো সারাভিয়া, জার্মান পেজ্জেলা, নিকোলাস ওটামেন্ডি, নিকোলাস তাগলিয়াফিকো, লিয়ান্দ্রো পারেদেস, গিদো রদ্রিগেজ (গিদো পিজ্জারো), জিওভানি ল চেলসো, আনহেল ডি মারিয়া (রদ্রিগো ডি পল), লিওনেল মেসি, সার্জিও আগুয়েরো (মাতিয়াস সুয়ারেজ)।