এ এক অদ্ভুত রহস্য

ওয়াগা সীমান্তের দুই পারে যতই উত্তেজনা থাক, দুই দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রচারণা যতই বারুদের গন্ধ ছড়াক, সবকিছু আসলে অকারণে! শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটি তো সবারই জানা। বিশ্বকাপে এটিই সম্ভবত একমাত্র ম্যাচ, যেটির ফল আগেই বলে দেওয়া যায়। কী, অবাক হয়ে গেলেন? কেন, আপনিও কি জানেন না, আজ ওল্ড ট্রাফোর্ডে শেষ পর্যন্ত ভারতই জিতবে!

অস্ট্রেলিয়া–আফগানিস্তান ম্যাচেরও যেখানে এভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা বিপজ্জনক, ভারত–পাকিস্তান নিয়ে কীভাবে তা করছি? সঙ্গে এই আগুনে খেলায় আবার আপনাকেও নিয়ে নিচ্ছি। না ভাই, এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়। আগেই ভারতকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেওয়ার কারণ একটাই—এটি বিশ্বকাপ এবং বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ভারত হারে না।

ক্রিকেটের অপার রহস্যের একটি বলতে হবে এটিকে। শুধু ক্রিকেটই–বা বলছি কেন, সীমানাটা আরও ছড়িয়ে দিয়ে সব খেলাকে এই আলোচনার পতাকাতলে নিয়ে এলেও অব্যাখ্যানীয় রহস্য হিসেবে এটি সম্ভবত এক নম্বরেই থাকবে। বিশ্বকাপের আগে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে কখনো ভারত জিতবে, কখনো পাকিস্তান। বিশ্বকাপের পরেও তা–ই। অন্য টুর্নামেন্টেও জয়–পরাজয় পক্ষ বদলাবে, কিন্তু বিশ্বকাপে বারবার পুনরাবৃত্তি হবে সেই একই গল্পের। পাকিস্তানের সামনে রীতিমতো অজেয় রূপে দেখা দেবে ভারত।

সেই ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে শুরু, সর্বশেষ ২০১৫ বিশ্বকাপ—বিশ্বকাপে ছয়বার মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। ফলাফল ভারত ৬–পাকিস্তান ০। গত বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী মুখোমুখি হওয়ার আগের দিন মিসবাহ–উল–হকের সংবাদ সম্মেলনটার কথা মনে পড়ছে। তখন পর্যন্ত রেকর্ডটি ৫–০ এবং বারবারই সেটি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। একই প্রসঙ্গে কথা বলতে আর কত ভালো লাগে! তার ওপর এমন একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ। একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পাকিস্তানের অধিনায়ক বললেন, ‘এটা তো আমাদের অজানা কিছু নয়। তবে অতীতে কোনো দিন পাকিস্তান জেতেনি বলে এবারও জিতবে না, এমন কোনো কথা আছে নাকি?’

অবশ্যই এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু পরদিন অ্যাডিলেডে সেই ভারতই জিতল। বিরাট কোহলি সেঞ্চুরি করলেন। ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের মতো এদিনও লড়াই যা করার তা করলেন মিসবাহ একাই। ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটি হয়েছিল চণ্ডীগড়ে। সেই ম্যাচের আগে রীতিমতো যুদ্ধের আবহ। যেটি তৈরি করায় যথারীতি ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর বড় ভূমিকা। পরিহাসই বলতে হবে, দুই অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনে তাদেরই কোনো প্রবেশাধিকার নেই। বিশ্বকাপের বাণিজ্যিক নীতিমালা লঙ্ঘন করায় স্বভাববিরোধী কড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের সব টিভি চ্যানেলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মহেন্দ্র সিং ধোনি আর শহীদ আফ্রিদির সংবাদ সম্মেলনে ঢুকে তাই মনে হলো, এটি কি মোহালিতে হচ্ছে নাকি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে? দু–একটি টিভি ক্যামেরা শুধু বাইরের, বাকি সব তো বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের।

সেই সেমিফাইনাল শুধুই একটা ক্রিকেট ম্যাচের বদলে হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট কূটনীতিরও বাহন। সীমান্তের ওপার থেকে উড়ে এসেছিলেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। তাঁকে বরণ করে নিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকেও তাই থাকতে হয়েছিল স্টেডিয়ামে। দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির কারণে ম্যাচ শুরুর তিন ঘণ্টারও বেশি আগে নিরাপত্তার কেমন ঘেরাটোপ টপকে প্রেসবক্সে ঢুকতে হয়েছিল, সেই ভোগান্তি এখনো মনে পড়ে।

বিশ্বকাপে আরেকটি ভারত–পাকিস্তান এমন কত স্মৃতিকেই না ফিরিয়ে আনছে মনে! বিশ বছর আগে ইংল্যান্ডে সর্বশেষ বিশ্বকাপেও দুই দলের ম্যাচটা হয়েছিল এই ওল্ড ট্রাফোর্ডেই। ইংল্যান্ডে ম্যাচ শেষে দর্শকদের মাঠে নেমে যাওয়ার রীতি তখনো একেবারে নিষিদ্ধ তালিকায় চলে যায়নি। খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠ তাই দর্শকে দর্শকারণ্য। সেখানে শুধু জয়ে উল্লসিত ভারতীয় সমর্থকই নয়, ছিলেন পরাজয়ে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানিরাও। দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে লেগেও গিয়েছিল। মাঠে ভারতীয়রা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া থেকেই যেটির সূত্রপাত। যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ম্যাচটা খেলা হয়েছিল, তাতে যা মোটেই অবিশ্বাস্য কিছু বলে মনে হয়নি। মাঠের রূপক যুদ্ধের কিছুদিন আগেই কার্গিল সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে সত্যিকার যুদ্ধ হয়ে গেছে। ম্যাচের আবহসংগীত হিসেবেও ব্যাট–বলের আওয়াজের চেয়ে গোলাবারুদের শব্দই বেশি শোনা যাচ্ছিল।

সেবার ওল্ড ট্রাফোর্ডের ওই ম্যাচ দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন ইমরান খান। আজকের ম্যাচে থাকছেন না। থাকবেন বলে কোনো গুঞ্জনও ওঠেনি। ইমরান তখন সাবেক ক্রিকেটার, এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। যাঁর মনোজগতে ক্রিকেট খুব সামান্যই রেখাপাত করে। তবে ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ এই দুই দেশের জন্য এমনই জীবন–মরণ ব্যাপার যে, ইসলামাবাদে বসেও ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের একটা চোখ বা একটা কান অবশ্যই ওল্ড ট্রাফোর্ডে থাকবে।

ইমরানের কীর্তিধন্য ওই ১৯৯২ বিশ্বকাপেই প্রথম ভারত–পাকিস্তান। সিডনির সেই ম্যাচে অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইমরানকে ম্লান করে দিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ শচীন টেন্ডুলকার (অপরাজিত ৫৪ ও ১/৩৭)। বিশ্বকাপের পরের চারটি ভারত–পাকিস্তান দ্বৈরথেও যিনি নিয়মিত এবং পাকিস্তানকে ভুগিয়েছেনও বিস্তর। ২০১১ সেমিফাইনালে বেশ কটি জীবন পেয়েও থেমে িগয়েছিলেন সেঞ্চুরি থেকে ১৫ রান আগে, সেঞ্চুরি হলেও ব্যাটিং মাহাত্ম্যে আট বছর আগে সেঞ্চুরিয়নে ৯৮ রানের সঙ্গে যেটির তুলনাই চলত না। সেই দুবারও তিনি ম্যাচসেরা।

পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতেই লেখার জন্য বরাদ্দ জায়গা শেষ। কোহলি–আমির যুগের কাহিনি তো আপনারা জানেনই, তাই না? বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে এ দেশের মানুষও কেমন দুই ভাগ হয়ে যেত, সেটিও এখন পুরোনো গল্প। বাংলাদেশের কাছে এখন এটি শুধুই আরেকটি ক্রিকেট ম্যাচ! কৌতূহল বলতে একটাই—বিশ্বকাপে ভারত–পাকিস্তান কি আজ আবারও সেই একই গল্প লিখবে, নাকি তাতে যোগ হবে নতুন কোনো অধ্যায়!