দেশকে সব দিয়েও কিছু চাওয়ার নেই তাঁর

বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাংলাদেশকে পদক এনে দিয়েছেন রোমান সানা। সংগৃহীত ছবি
বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাংলাদেশকে পদক এনে দিয়েছেন রোমান সানা। সংগৃহীত ছবি
>দুই দিনের মধ্যে বড় দুই কীর্তি গড়েছেন বাংলাদেশের আর্চার রোমান সানা। ইতিহাস গড়ে প্রথম আর্চার হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে জায়গা করে নিয়েছেন। পরশু বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফেবারিট নেসপলিকে হারিয়ে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে প্রথম কোনো পদক।

চোখে চশমা, চেহারায় মায়া খেলা করে। লক্ষ্যভেদের উদ্দেশ্যে তির ছোড়ার জন্য সর্বদা যেন ধ্যানমগ্ন। ধীরস্থির থাকতে পারাও যে খেলার মাঠে অন্যতম বড় অস্ত্র হতে পারে, তা দেখিয়ে দিলেন রোমান সানা। গতকাল রাতে নেদারল্যান্ডসে আর্চারি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জয় করে ছেলেটি এখন বাংলাদেশের মানুষের চোখের মণি। গত পরশু রাত থেকে ২৪ বছর বয়সী ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার রোমানকে দেখতে হচ্ছে মাথা উঁচু করে!

একটু অবাক হতে হলো তবু। আজকের সকালেও প্রতিদিনের সে একই রোমান! পরশু রাতে বিশ্বমঞ্চে অমন কীর্তি গড়ার পরেও কণ্ঠে সেটা টের পাওয়া যায় না। ২৪ বছর বয়সীর নেই কোনো মূল্যায়নের প্রত্যাশা। শোনা গেল না আগে পদকজয়ী কোনো অ্যাথলেটের মতো ‘কিছু নেই, নেই কিছু’ অভিযোগও। মাঠের সেরা রোমান মাঠের বাইরেও এক ব্যতিক্রম ক্রীড়াবিদের উদাহরণ।

মাঠের বাইরে একজন ক্রীড়াবিদ কেমন, তা সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ থাকে না। রোমানের নীরব পথচলার গল্পটাও তাই অনেকেরই অজানা। খুলনার সাদামাটা ছেলেটার জীবনে এখন রং লেগেছে। ২৪ বছরের তরুণের গলায় পদক ওঠায় এখন তো রঙিন পাখা মেলে দেওয়ার সময়। দেশকে পদক এনে দিয়ে ‘এটা-ওটা’ পাওয়ার প্রত্যাশার পারদ চড়ানোর কথা। ওটা থাকলে সোনাও জিততে পারতাম, আড়ালে–আবডালে তোলার কথা সে অভিযোগ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আগের পদকজয়ীদের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গেছে আরকি! কিন্তু রোমান আছেন তাঁর মতোই, ‘বড় একটা লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। সামনে আমার অলিম্পিক লক্ষ্য। এর জন্য শুধু ভালো প্রস্তুতি চাই। ব্রোঞ্জ জয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ আর কিছুই প্রত্যাশা করি না আমি।’

আর্চারি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এত দিন ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ করেছে, এখন কেবল একটু জোরে হাঁটতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জয়। ৭-১ সেটে বড় জয়ের পথে কাকে হারিয়েছে জানেন? ইতালির মাউরো নেসপোলিকে। যিনি লন্ডন অলিম্পিকে দলগতভাবে সোনা জিতেছিলেন। কিন্তু পরশু বাংলাদেশের সেরা আর্চারের বিপক্ষে পাত্তাই পাননি এই ইতালিয়ান। শেষ শটে রোমানের প্রয়োজন ছিল ৮ পয়েন্ট। সেই স্নায়ুর লড়াই জয় করে রোমানের তির ভেদ করল পূর্ণ ১০ পয়েন্ট। শেষ তিরটি ছোড়ার আগে রোমানের মনে হচ্ছিল, ‘ম্যাচটি আমি ফিফটি-ফিফটি ধরে নিয়েছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল নার্ভাস হওয়া যাবে না। প্রথম সেটে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর থেকে মানিয়ে নেই। নিজের মধ্যে বিশ্বাস আনি, ওরা যখন পারে, আমরাও পারি।’

রোমান সানা। ফাইল ছবি
রোমান সানা। ফাইল ছবি

চতুর্থ রাউন্ডে রোমান হারিয়েছেন দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম উজিনকে। কত বড় কীর্তি ভাবা যায়! কাকে হারিয়েছেন, কার বিপক্ষে জিতেছেন? ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন ক্রিকেটপাগল এই জাতিকে এভাবে হয়তো বোঝানো যাবে না কত বড় কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশের ছেলে। ব্যক্তিগত রিকার্ভে ৯২ দেশ থেকে ২০৯ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ তৃতীয় হতে রোমানকে পেছনে ফেলতে হয়েছে ২০৬ জনকে। এতে যদি রোমানের কীর্তি একটু বোঝানো যায়।

বিশ্বমঞ্চে রোমানের ঝলকানি প্রথম হলেও তাঁর আগমনধ্বনি শোনা যাচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। এর আগে এশিয়ান গ্রাঁপ্রিতে সোনা জিতেছিলেন। সেই সাফল্যই প্রথম আলোচনায় নিয়ে আসে তাঁকে। এশিয়া কাপেও খেলেছিলেন ফাইনালে। এবার সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলেন। প্রথমে অলিম্পিক টিকিট, দুই দিনের ব্যবধানে ব্রোঞ্জপদক। চার দিন আগেও যিনি উঠতি একজন প্রতিভা ছিলেন, এখন বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের আশার আলো।

বরাবরের মতো আগামী অলিম্পিকে আর অংশগ্রহণ করার জন্য যাবে না বাংলাদেশ। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে ব্যক্তিগত রিকার্ভ ইভেন্টে দেশের অর্জুন যেদিন তির–ধনুক নিয়ে নামবেন, সেদিন নড়েচড়ে বসতেই হবে আমাদের। অবশ্য বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না রোমান, ‘আমি বাস্তবতা নিয়ে থাকতে চাই। অলিম্পিকে পদক জয় এত সহজ নয়। তবে আমি আমার সেরাটা দিতে পারলে ভালো কিছু হবে। এর জন্য আমাকে খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’

এত দিনে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের বড় মঞ্চের প্রস্তুতি মানেই অমুক দেশে না গেলে তাঁর চলবে না। কিন্তু রোমান অন্য ধাতুতে তৈরি। উন্নতর প্রশিক্ষণের জন্য সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল দেশসেরা আর্চারকে। কিন্তু দেশের বাইরে গেলেই যে ভালো প্রশিক্ষণ নয়, ‘ওখানে আমি অনুশীলন করব না। কারণ, ওখানে আসা অন্যরা আমার সমকক্ষ নয়।’

দেশে রোমানের পথপ্রদর্শক মার্টিন ফ্রেডরিক। প্রায় দেড় বছরের মধ্যে জার্মান এই কোচ দেশের আর্চারদের সামনে সেটে দিয়েছেন অলিম্পিক লক্ষ্য। অলিম্পিকে সরাসরি জায়গা করে নিয়ে আপাতত প্রথম ধাপ পার করেছেন রোমান। নেদারল্যান্ডসে যে সূর্যের দেখা মিলেছে, সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে অনুষ্ঠেয় সে সূর্যের ঝলকানি আরও বেড়ে যাবে, প্রত্যাশা তো এমনই।