'আমরা চারে নেই, এটাই দুঃখ'

>ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বেশ নির্ভার মনে হচ্ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। নিজে ভালো বোলিং করেছেন, ম্যাচটা জিতে দলও বাঁচিয়ে রেখেছে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আশা। পরশু রাতে টন্টনের টিম হোটেলে বসে তারেক মাহমুদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ অধিনায়ক কথা বলেছেন বাংলাদেশ দলের সেমিফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে।

প্রশ্ন: ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর সেমিফাইনালের ছবি এখন কতটা স্পষ্ট?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: খুব কঠিন সমীকরণ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিতলে ৯ পয়েন্ট নিয়েও যাওয়ার সুযোগ ছিল। এখন ১১ পয়েন্ট পেলেও নিশ্চিত হওয়া যাবে না। সঙ্গে রানরেটের ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে হেরে। এরপর ক্ষতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার ম্যাচটা না হওয়ায়। ওদিকে নিউজিল্যান্ড-ভারতের ম্যাচটা না হওয়ায় ওদের রানরেটে কোনো পার্থক্য হয়নি। এক পয়েন্ট পেয়েছে, রানরেটও একই জায়গায় থেকে গেছে। আমরা ৪০ ওভারে ৩২২ রান করেও রানরেট প্লাসে আনতে পারিনি। আমরা যদি পরের চার ম্যাচের তিনটিতেও জিতি, আর নিউজিল্যান্ড পরের চারটার দুইটা জেতে, নিউজিল্যান্ডের পয়েন্ট ১১ হবে। রানরেটে তো তারা এগিয়েই। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারতের যেসব ম্যাচ বাকি আছে, বলতে পারেন তারা চলেই গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচটা আমরা জিতে গেলাম। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটাও জিতলে এখন আমাদের ৭ পয়েন্ট থাকত। নিউজিল্যান্ডের ৫ পয়েন্ট থাকত। আমরা নিরাপদ জায়গায় থাকতাম। এখনো সম্ভাবনা নেই তা বলব না। নিউজিল্যান্ড হারতেও পারে। আমরাও দেখা গেল সব জিততে পারি। অধিনায়ক হিসেবে তো এটা বলা যাবেই না যে সম্ভাবনা নেই। ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো জায়গায় শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটা বড় দলকে হারিয়েই সেমিফাইনালে যেতে চাইলে বলার কিছু নেই। বড় দল একটাকে তো হারাতেই হবে।

প্রশ্ন: বাকি চার ম্যাচে জেতার আত্মবিশ্বাস আছে আপনার দলের?

মাশরাফি: আত্মবিশ্বাস না থাকার কারণ নেই। হ্যাঁ, একবারে চার ম্যাচের দিকে তাকালে অনেক কঠিন। ম্যাচ ধরে ধরে এগোনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন যেটা সমীকরণ দাঁড়িয়েছে, আপনাকেও জিততে হবে, ওদিকে নিউজিল্যান্ড যেন হারে, সেই প্রার্থনাও করে যেতে হবে।

প্রশ্ন: জয়ের পাশাপাশি রানরেটের ভাবনাটাও নিশ্চয়ই করতে হচ্ছে...

মাশরাফি: হ্যাঁ, আজ (গত সোমবার) যেমন আমরা একটা পর্যায়ে গিয়েছিলাম, যখন ২৫০-২৬০ রান, তখন মাঠে মেসেজ দিয়েছিলাম যত দ্রুত খেলা শেষ করা যায়। রানরেটের জন্যই। তবে ওই রকম পরিস্থিতি আগে তৈরি হতে হবে। এমন পরিস্থিতিও হতে পারে, যখন ম্যাচ কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তখন তো আপনি এটা করতে পারেন না।

প্রশ্ন: সাকিবের মতো খেলোয়াড় দলে থাকা একজন অধিনায়কের জন্য কতটা স্বস্তির?

মাশরাফি: সাকিব সব সময়ই বিশেষ কিছু। খারাপ লাগছে উল্টো ওর জন্য। হয়তোবা নিউজিল্যান্ড ম্যাচে যদি ওকে একটু সাপোর্ট দেওয়া যেত। মুশফিকের ওই রানআউটটা দুর্ভাগ্যজনক ছিল। বা সাকিব নিজেও যদি আরও...। ইংল্যান্ডের এক শটা যদি ওই দিন হতো...এমন যদি-কিন্তু আসছে মনে। তবে এটা ওর একার দায়িত্ব নয়। ও একা বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে তুলতে এখানে আসেনি। সবারই আরেকটু অবদান রাখতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যেমন সবাই ব্যাটিংয়ে অবদান রেখেছে।

প্রশ্ন: দলে প্রতীভার অভাব নেই। বিশ্বকাপের জন্য সবার প্রস্তুতি ভালো। তবু সাকিবের সঙ্গে বাকিদের পার্থক্যটা কোথায়?

মাশরাফি: মানসিকতায়, আর কোথাও নয়। মানসিকভাবে সাকিব অনেক শক্ত। সঙ্গে ও জানে তার কাজ করার মতো দুটি জায়গা আছে। সফল হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আত্মবিশ্বাসী খেলোয়াড়। নিজের ওপর আস্থা আছে। তিন নম্বরে ব্যাটিং দেওয়ার পর থেকে ওর মধ্যে একটা জিনিস দেখছি যে টপ অর্ডারে কেউ রান না করলে সে-ই বেশি চিন্তিত হয়। তিন নিয়ে আমরা বেশি ঝামেলায় ছিলাম। সাকিব যদি তিন ম্যাচে রান না–ও করত, তবু ও দায়িত্ব নিত। সাকিব যখন আইপিএল খেলছিল, তখনই আলোচনা হচ্ছিল সে তিনে খেলবে। ওর প্রস্তুতি ও সেভাবেই করে নিয়েছে। আর একটা জিনিস ওর ভাগ্য। সবকিছুই ওর পক্ষে যাচ্ছে। আশা করি সাকিব এটা দলের জন্য পরের চার ম্যাচেও ধরে রাখবে। প্রস্তুতিতে অন্যদের সঙ্গে ওর অত বেশি পার্থক্য নেই। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের জায়গায় বিরাট পার্থক্য। কেউ যদি দুই দিন আগে আগে আউট হয়ে যায়, সে কিন্তু একটু চিন্তা করে, ঠিক আছে কিছুক্ষণ দেখি। কিন্তু সাকিবের ব্যাটিংয়ের ধরন অন্য রকম। ও শট খেলেই যাবে। ও জানেও যে ওর এটাই ক্রিকেট। এটাই ওর ব্যাটিং। এভাবেই তাকে রান করতে হবে। এটাই শক্ত মানসিকতা।

প্রশ্ন: তামিম ভালো শুরু পেয়েও বড় ইনিংস খেলতে পারছেন না? ভাগ্য সহায় হচ্ছে না, এটাই বলবেন?

মাশরাফি: তামিম ৪৮ রান করেছে কোনো সুযোগ দেওয়া ছাড়া। সাকিব কিন্তু এর মধ্যে দু–একটা এদিক–সেদিক করেছে। তামিম একটাই সুযোগ দিয়েছে। সেটাতেও ওর পা দিয়ে স্টাম্প ঢাকা ছিল, একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, সেটি দিয়েই বল চলে গেছে। এখন কথা হচ্ছে বলটা তো অন্যদিকেও যেতে পারত। থ্রো তামিমের গায়ে লাগতে পারত, পায়েও লাগতে পারত। ভাগ্য ওর সহায় হচ্ছে না। তারপরও তামিমের সবচেয়ে ভালো দিক যেটা, ও ধৈর্য ধরে রাখছে।

প্রশ্ন: প্রথম দু-এক ম্যাচে বোলিং ভালো হয়নি বলে আপনাকে নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দেখা গেল পুরোনো মাশরাফিকে। সমালোচনা হওয়াতেই কি...?

মাশরাফি: আমার স্বাভাবিক বোলিংই তো এটা। আমি সব সময় এই জায়গাতেই বল করি। আসলে খেলোয়াড়দের যখন খারাপ সময় যায়, সেটাকে বলা হয় ‘এক্সকিউজ’। আর যখন ভালো সময় যায়, তখন খারাপটা বললেও বলা হয়, আরে না, ওর খারাপটাও ঠিক আছে। এটা খেলোয়াড়দের মেনে নিতে হয়। প্রথম ম্যাচে আমার বোলিং এদিক-সেদিক হয়েছে। তৃতীয় ম্যাচে মনে হয়েছে আমি ঠিক জায়গায় আছি। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যেটা করলাম, এটাই আমার আমার স্বাভাবিক বোলিং। মানুষের কথায় আমার কিছু বদলানোর সুযোগ নেই।

প্রশ্ন: মোস্তাফিজের বোলিং কেমন ছিল? দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়েছেন তিনি...

মাশরাফি: যে কেউ বলবে মোস্তাফিজ এ ম্যাচের সেরা বোলার। যদি সত্যিই আপনি ক্রিকেট বোঝেন, সাকিবকে যতটুকু কৃতিত্ব দিতে হবে, ততটুকু মোস্তাফিজকেও দিতে হবে। ওই এক ওভারে দুটি উইকেটে, খেলা পুরো বদলে গেছে। নইলে ওরা ৩৮০ রান করত। হেটমায়ার তো অলরেডি ফিফটি করে ফেলছে ২৫ বলে। এরপর রাসেল। হেটমায়ার যদি ওখানে আরেকটু খেলত আর রাসেল এসে ৫-৬টা ছয় মারলেই খেলা শেষ। এভাবেই তো ক্ষতিগুলো হয়। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও এভাবেই তৈরি হয়। এ ম্যাচে গেইম চেঞ্জার যদি বলেন, ব্যাটিংয়ে দুজনের নাম তো আনবেনই। তার আগে মোস্তাফিজের নাম আনা উচিত।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপের আগে থেকেই ৩০০, ৩৫০ রান নিয়ে অনেক কথা। এখন কাজটা খুব সহজ মনে হচ্ছে। এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল?

মাশরাফি: আমি সব সময় বলি, যে রকম দেশ, সে রকম বেশ। এখানে রান হয়, আমাদের রানই করতে হবে। এর বিকল্প নেই। ইংল্যান্ডে ৩৩০-৩৫০ হয়। আমিও শুরুতে সত্যি কথা দ্বিধান্বিত ছিলাম। জীবনে তো এ রকম ধারাবাহিকভাবে এটা করিনি। কিন্তু ম্যাচগুলো দেখেন, সব ম্যাচেই আমরা ৩০০–এর দিকে ছিলাম। বিশ্বাসটা দলের ভেতরেও এসেছে। সবচেয়ে ভালো হয়েছে, প্রথম ম্যাচেই ৩৩০ করে ফেলায়। বাস্তবে কিছু করে ফেলার চেয়ে বড় আত্মবিশ্বাস পৃথিবীতে আর কেউ দিতে পারে না।

প্রশ্ন: এ নিয়ে চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলছেন। মানের দিক দিয়ে কি এবারই সেরা খেলাটা খেলছে বাংলাদেশ?

মাশরাফি: গ্রুপ পদ্ধতি থাকলে কিন্তু আমরা পরের ধাপে চলে যেতাম। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের পর আপনি হিসাব করতে পারতেন আমাদের এই এই ম্যাচ জিততে হবে। আমার মনে হয় এবারই সবচেয়ে কঠিন বিশ্বকাপ খেলছি আমরা। প্রতিটা দলের সঙ্গে খেলতে হচ্ছে। আগে থেকে হিসাব করারও সুযোগ পাচ্ছি না। এখন এসে হিসাব করছি, কিন্তু এর মধ্যে আমরা অনেক পেছনেও পড়ে গেছি। আগেও বলেছি, এমন বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে যেতে হলে ৫০ ভাগ ভাগ্যের সাহায্য লাগবে, যেটা আমরা এখনো পাইনি। আমি ভাগ্যে অনেক বিশ্বাস করি। যেহেতু প্রথম দিকে ভাগ্য কাজ করেনি, কে জানে হয়তো এই দিকে কাজ করতে পারে। দেখা যাক। আল্লাহ ভরসা।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপের মাঝামাঝি সময়ে দশ দলের মধ্যে পাঁচে বাংলাদেশ। শুরুর আগে ভেবেছিলেন এমন সময় এই অবস্থানে থাকবে?

মাশরাফি: এই সময়ে আমি আমাদের দলকে চারেই দেখেছিলাম। আমার বরং খারাপ লাগছে আমরা চারে নেই বলে। আমার দল সেরা চারে নেই, এটাই দুঃখ। নিউজিল্যান্ড ম্যাচে আমরা শেষটা করতে পারিনি। ওই ম্যাচটা যদি একটু পরে হতো। ধরুন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা যদি ঘুরে যেত, দ্বিতীয় ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হতো আর পরেরটা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, আজকের (সোমবার) পর হিসাবটা অন্য রকম হতে পারত। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে হারা আমাদেরই ব্যর্থতা। এটা আমি অজুহাত হিসেবে দেখাতে চাই না। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাচ্ছি যে ভাগ্য এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গ দেয়নি। বৃষ্টির সপ্তাহে আমরা তিন-চার জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। নিউজিল্যান্ড পয়েন্ট পেয়েছে, আমাদের খেলা হয়নি। আগের দিন প্র্যাকটিসে বৃষ্টি, শ্রীলঙ্কার ম্যাচ হলো না। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কা আমাদের ‘শিউর শট’। আপনি যদি আপনার শিউর শট মিস করেন, তাহলে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ওই ম্যাচ জিতলে আমাদের পয়েন্ট ছয় থাকত। তবে সময় এখনো শেষ হয়নি। হাল ছাড়ার কারণ নেই। বিশ্বকাপের মাঝখানে এসে আমার দল পাঁচ নম্বরে, এটাও গর্বের ব্যাপার। তবে কেউ কেউ তো বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েই দিচ্ছেন। বাস্তবতা সে রকম নয়। আমি আগেই বলেছি, প্রত্যাশাটা ওখানে উঠানোর কোনো মানে নেই।