ব্রাভো সাকিব-লিটন ব্রাভো টাইগারস

টন্টনের আকাশটা পুরোপুরি মেঘমুক্ত না হলেও মোটামুটি ঝকঝকেই ছিল। মাঝেমধ্যে টিভির দর্শকদের জন্য ক্যামেরা সেই মেঘকে ধরছিল। নির্ভেজাল নাকি বিপদের, তা পরখ করানোটাই যেন মূল উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা যে বাংলাদেশের জন্য ভিলেন বৃষ্টি আবার সাজগোজ করে খেলা পণ্ডের বুদ্ধি করছে কি না! তো সেটা আর হয়নি। বাংলাদেশ দল দিনটিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের করে নিয়ে অসাধারণ জয় উপহার দিল। এবারের ২০১৯ বিশ্বকাপ আসরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা খেলে এবং ক্রিকেট-বোধ-বুদ্ধি বজায় রেখে দারুণ একটি দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করল।

সাকিব, লিটন, তামিম ও সৌম্যর ব্যাটিংনির্ভর এই জয় দেখে অভিভূত হওয়ার পাশাপাশি একটা আক্ষেপও মনকে বিষাদগ্রস্ত করছে এই ভেবে যে আগের খেলাটি বৃষ্টির কারণে বাতিল না হলে টাইগাররা সেদিন একই রকমভাবে জয়ী হতো। আর তাহলে সর্বশেষ এই খেলায় দারুণ একটি জয় পেয়েও সামনের খেলাগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো না।

পরবর্তী প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ওয়ার্নার, স্মিথদের মতো নামী খেলোয়াড়দের দলটির মুখোমুখি হতে হবে। তবে আমাদের দলের তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, প্রতিপক্ষটির কাপ জয় নিয়ে ভাবনাটা খুবই জোরদার হয়ে মাথায় গেঁথে আছে। সেটা তাদের একটি বড় চাপ। আর বাংলাদেশের ছেলেরা যেভাবে চাপমুক্ত হয়ে খেলছে, তা দেখে অস্ট্রেলিয়ার নিজেদের নির্ভার ভাবার কোনো উপায় নেই।

বাংলাদেশ দলের এ মুহূর্তে বড় দিক হলো, হারানোর কিছু নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজদের সঙ্গে খেলার যে পারদর্শিতার প্রমাণ দেখিয়েছে, সেটুকু অব্যাহত থাকলেই অস্ট্রেলিয়াকে ধরে ফেলা যাবে। তা ছাড়া ওই দেশের দলটি টাইগারদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে এর আগেও, সেই দৃষ্টান্ত তো আছেই। অতএব ভয়ও পাওয়ার কথা নয়, চাপ নেওয়ার তো নয়ই।

যাহোক, এবার পরশুর খেলার কথা বলি। আমি ঘণ্টাখানেক একটি জরুরি সভার কারণে খেলার শুরুটা দেখতে পাইনি। নিজের এলাকাটি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মেইন রোডে গাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। গাড়ি ছেড়ে ফুটপাতে নেমে দেখি, টিভির দোকানে খেলা দেখার ভিড়। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম খেলার অবস্থা সম্পর্কে। খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘খালি ছয় মারা ব্যাটা গেইলটা শূন্য রানে আউট হইছে।’ পাশের একজন তাকে ধমক দিল, ‘ধেৎ মিয়া। ব্যাটা কও কেন?’ প্রথমজন হেসে বলল, ‘আরে অসুবিধা কী, যে ব্যাট করে সেই তো ব্যাটা।’

একটি রিকশা পেয়ে যাওয়ায় বাসায় গিয়ে খেলা দেখার জন্য উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা প্যাডেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আইজকা আমরা জিতুম না?’ বললাম, ‘জিতার তো চান্স আছে। ওই যে সবচাইতে ডরের ব্যাটসম্যানটা আউট হইছে! বাকিগুলারে কম রানে আউট করতে পারলে জিতা সম্ভব।’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘হ। তয় আমাগো খেলা আইলেই তো বৃষ্টিতে পায়! আইজকা যদি অমন হয় তো সব শ্যাষ। হারুক-জিতুক যা–ই হোক, দোয়া করি বৃষ্টি যেন না আসে।’

এসব কথা বললাম কারণ, খুবই খেটে খাওয়া ব্যস্ত মানুষেরাও বিশ্বকাপ খেলায় দেশের দলটির খেলা সম্বন্ধে, ভাগ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখে। জয় নিয়ে আশাবাদী থাকে।

তো, বাসায় ফিরে বাকি খেলার পুরোটাই দেখেছি। শাই হোপ আর লুইসরা মোটামুটি দুশ্চিন্তাতেই ফেলে দিয়েছিল। পুরো দলটি ধীরে ধীরে ৩২২-এর একটি বড় টার্গেটও বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাটিং পর্যায়ে তামিম-সৌম্যর শুরুটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ছোট মাঠটি ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো থাকায় বোলিং ততটা জমবে না। যদিও আমাদের মোস্তাফিজ, সাকিব, সাইফউদ্দিনরা একে একে ৮টি উইকেট নিয়েছিল কঠিন পিচকে পাত্তা না দিয়ে। উইন্ডিজরা তিনজন পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করলেও হোপ ও লুইস সাবলীল ব্যাটিং দিয়ে ভাবিয়ে তুললেও সবচাইতে আনন্দের ব্যাপার ঘটেছিল মোস্তাফিজের ৯৬–তে হোপকে এবং মারমুখী হেটমায়ারকে ৫০ রানে আউট করায়।

তবে টাইগারদের ব্যাটিংয়ে ‘অসাধারণ’ কথাটির চেয়ে আরও বড় কিছু বলার মতো ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলার যে কাণ্ডটি সাকিব এবং বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে সুযোগ পাওয়া লিটন দাস ঘটিয়ে দিলেন, তা পরবর্তী দলগুলোকে ভাবাচ্ছে তো বটেই, আমাদের পুরো জাতিকে গর্বিত করে ক্রিকেটকে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আমি আশাবাদী যে পরের খেলাগুলোতেও এই অসাধারণত্ব বজায় থাকবে। অভিনন্দন জানাই দলপতি মাশরাফিকে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপ্টেন্সির জন্য। ব্রাভো সাকিব, লিটন। ব্রাভো টাইগারবৃন্দ।