যে কারণে অলৌকিক স্বপ্নটা ছোঁয়া গেল না...

তামিম ইকবাল আরেকটু আক্রমণাত্মক হতে পারতেন। ছবি: প্রথম আলো
তামিম ইকবাল আরেকটু আক্রমণাত্মক হতে পারতেন। ছবি: প্রথম আলো
>

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্লেষক থেকে সাবেকদের।

ম্যাচ জিততে না পারলেও হৃদয় জিতেছে বাংলাদেশ—কথাটা এ দেশের ক্রিকেটভক্তদের কাছে পুরোনো। ২০১২ এশিয়া কাপ থেকে অনেকবারই এ প্রশংসায় ভাসতে হয়েছে। কালও ফিরে এল কথাটা। অস্ট্রেলিয়ার ৩৮২ রানের পাহাড়ে উঠতে গিয়ে থামতে হয়েছে অল্প একটু পথ বাকি থাকতে। সেই পথটুকু সংখ্যায় মাত্র ৪৮ রান। এমন লড়াই দেখে হৃদয় না সঁপে পারেননি পাকিস্তানের সংবাদকর্মী আজমল জামি। তাঁর টুইট, ‘শুধু লড়াকু মানসিকতাটুকু দিয়ে বাংলাদেশ আবারও অসংখ্য হৃদয় জিতে নিল।’

প্রতিপক্ষ চার শ ছুঁইছুঁই রান করলে স্বাভাবিকভাবেই বোলারদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা কাল ম্যাচ শেষে হারের কারণ ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আমরা ৪০-৫০ রান বেশি দিয়েছি শেষের দিকে। না হলে ব্যাটসম্যানরা ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে খেলতে পারত, রান তাড়ার ধরনটাও ভিন্ন হতো।’ সহজ কথায়, লক্ষ্যটা সাড়ে তিন শর মধ্যে থাকলে ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপটা একটু কম থাকত। কিন্তু কাল বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং দেখে কি মনে হয়েছে, জেতার জন্য ব্যাটসম্যানরা ভীষণ চাপ নিয়ে ফেলেছেন?

হ্যাঁ, চাপ তো থাকবেই। তা আড়াই শ-তিন শ রান তাড়া করতে গেলেও থাকে। তবে লক্ষ্য যখন চার শ ছুঁইছুঁই, তখন তাড়া করায় আলাদা কিছু থাকতে হয়। তামিম ইকবাল ব্যাটসম্যান বলেই বোধ হয় খামতিটা ধরতে পারলেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘আমাদের এ রকম বড় রান তাড়া করার অভিজ্ঞতা বেশি নেই। সবাই কিছু না কিছু ভুল করেছি বলেই পারিনি।’ আসলে ভুল তো সেরা দলেরও হয়। আর এই রান তাড়া করতে নামলে বেশির ভাগ সময়ই হবে না। বাংলাদেশের মতো দল কুড়িবার তাড়া করতে নামলে হয়তো একবার হবে। কাল কিন্তু সেই একবার হওয়ানো, মানে ‘অলৌকিক’ কিছু ঘটানোর সুযোগটা ভালোই ছিল।

হারের ব্যবধান দেখে বাজে বোলিং-ফিল্ডিং, ক্যাচ ছাড়ার খামতিগুলো চোখে বিঁধবেই। এসব না হলে ম্যাচটা বাংলাদেশ জিততেও পারত। তবে এসব ঘটে যাওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নেমে জয়ের সম্ভাবনা ছিল। তা হয়নি তামিমের সেই ‘কিছু না কিছু ভুল’ আর একটি খামতির জন্য। খামতির কথায় পরে আসছি। আগে দু-একটি ভুল নিয়ে কথা বলা যায়। বাংলাদেশ গোটা ৫০ ওভার খেলে ৮ উইকেটে ৩৩৩ রান তুলেছে—ওয়ানডেতে দলের সর্বোচ্চ সংগ্রহ—১১৬টি বলে ‘ডট’ দিয়ে! অর্থাৎ বাকি ১৮৪ বল থেকে এ রান তুলেছেন ব্যাটসম্যানেরা। এবার হারের ব্যবধানটা দেখে নিশ্চয়ই কষ্ট বাড়ছে? আরেকটু স্ট্রাইক রোটেট করতে পারলে কিন্তু হয়ে যেত!

পাল্টা যুক্তি আসতে পারে, অস্ট্রেলিয়া তো তাদের ইনিংসে ১১১ বল ‘ডট’ দিয়েও ওই রানপাহাড় গড়েছে। অমন পাহাড় টপকাতে চাই চার-ছক্কার পসরা, স্ট্রাইক রোটেট করা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে? সত্যিই তা–ই। চার-ছক্কাই চাই। চার মারায় অস্ট্রেলিয়ার (৩৪) চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ (৩০)। পার্থক্যটা আসলে বিগ হিটিংয়ে। ১০টি ছক্কা মেরেছে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা সাকল্যে মেরেছেন ৪টি ছক্কা। দুই দলের মধ্যে এই যে ছয়টি ছক্কার ব্যবধান সেটি আসলে সামর্থ্যের। খামতিটাও ঠিক এখানেই। বাংলাদেশ দলে স্বীকৃত ‘বিগ হিটার’ নেই। আর বিগ হিটার ছাড়া এমন রান–পাহাড়ে উঠতে গেলে যত বেশি সম্ভব স্ট্রাইক রোটেট করার বিকল্প কী?

মাহমুদউল্লাহ যখন হাত খোলা শুরু করলেন ম্যাচ তখন অনেকটাই নাগালের বাইরে। ছবি: প্রথম আলো
মাহমুদউল্লাহ যখন হাত খোলা শুরু করলেন ম্যাচ তখন অনেকটাই নাগালের বাইরে। ছবি: প্রথম আলো

এবার ব্যাটিংয়ের ধরনে তাকানো যাক। তার আগে একটা প্রশ্ন—কে বেশি আক্রমণাত্মক, তামিম না সৌম্য? সাম্প্রতিক সময়ে সৌম্যকে মনে হলেও বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞ সমর্থকমাত্রই তামিমের স্ট্রোক প্লের সামর্থ্য সম্বন্ধে জানেন। এমন রান তাড়ার শুরুতে অভিজ্ঞতার সঙ্গে দরকার পড়ে বোলারদের ‘সেট’ হতে না দেওয়ার কৌশল। সৌম্য থাকলে পরের কাজটুকু হয়তো হয়ে যেত। সেটি না ঘটায় দায়িত্বটা নিতে হতো তামিমকেই। কিন্তু বাংলাদেশের এ ওপেনার নিজে ‘সেট’ হতে বেশি সময় নিতে গিয়ে বোলারদের চড়ে বসার সময় করে দিয়েছেন।

দলের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে শুধু তামিমের স্ট্রাইকরেটই এক শর নিচে। আর চার শ ছুঁইছুঁই সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইকরেট ৮৩.৭৮ হলে তা বেশি করে চোখে লাগাই স্বাভাবিক। পাওয়ার প্লের মধ্যেও বোলারদের ওপর খুব একটা চড়াও হতে দেখা যায়নি তামিমকে। অন্তত ডাউন দ্য উইকেট গিয়ে বোলারের লাইন-লেংথ এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টাটা করতে পারতেন সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্যতম সেরা এ ওপেনার।

খেলার ধরনের কথা উঠলে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের প্রসঙ্গ চলে আসে। তাঁর ১০ বলে ৩২ রানের ‘ক্যামিও’তে বোলারদের লাইন-লেংথ এলোমেলো হয়েছে, তাতে রান বের করতে আসল সুবিধাটা হয়েছে অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানদের। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যটা ছিল পরিষ্কার—৪০ ওভার শেষে গড়ে সাড়ে ছয়ের ওপরে রানরেট থাকায় ওখান থেকে উড়াল দিতে চেয়েছে দল। সেটা ম্যাক্সওয়েলের চেয়ে ভালো আর কে পারে! সে জন্য স্টিভ স্মিথের মতো ব্যাটসম্যানকেও নামতে হয়েছে ছয়ে।

কিন্তু বাংলাদেশ দলে কাল কোনো ব্যাটসম্যানই শুরু থেকে বোলারদের ওপর চড়াও হননি। সেট হওয়ার পর যা একটু চড়াও হতে দেখা গেছে মাহমুদউল্লাহকে। ততক্ষণে ৫৪ বলে দরকার ১৩৩। তা দেখে ক্রিকেট রসিকমাত্রই বলতে পারেন, এই তো ম্যাচ পালালে বল বাড়ে! আসলে ব্যাটিংটা বেশ ভালোই করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রানের ঘাটতিটুকু দেখলে শুধু আফসোসই বাড়বে, ইশ্‌! শুরুতে যদি একটু মেরে খেলা যেত, কিংবা কোনো একজন ব্যাটসম্যান যদি ম্যাক্সওয়েলের মতো একটা ‘ক্যামিও’ উপহার দিতে পারতেন, তাহলে হয়তো হয়ে যেত। কী হতো?

অলৌকিক কিছু ঘটানোর যে স্বপ্ন কাল দেখা হয়েছিল, তা ছুঁয়ে দেখা যেত। এবার হলো না বটে। তবে কালকের ব্যাটিংটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে, সামনে এসব হওয়ার দিন আসছে! অর্থাৎ শুধু হৃদয় জিতে সন্তুষ্ট থাকা নয়, সঙ্গে ম্যাচও।