ক্রিকেটারদের যত কুসংস্কার

ইএসপিএনে অনিল কুম্বলের ঐতিহাসিক স্কোরকার্ড খুঁজে পাওয়া যায় এখনো। ছবি: কোলাজ। সোর্স: ইএসপিএন এবং উইকিমিডিয়া কমনস
ইএসপিএনে অনিল কুম্বলের ঐতিহাসিক স্কোরকার্ড খুঁজে পাওয়া যায় এখনো। ছবি: কোলাজ। সোর্স: ইএসপিএন এবং উইকিমিডিয়া কমনস

ক্রিকেট এমন একটি খেলা যা দেখার সময় দর্শক ও খেলোয়াড় বিভিন্ন ধরনের সংস্কারে ভোগেন। ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের অনেকে মনে করেন, দল খারাপ খেলতে শুরু করলে যদি তিনি খেলা না দেখেন তাহলে দল ভালো খেলবে। আবার অনেকে উত্তেজনায় চাপ সামলাতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাসের বন্যা বইয়ে দেন। তার এই ‘কুফা স্ট্যাটাসে’ যদি প্রিয় দল কোনো ভাবে জয় পেয়ে যায়! কেউ কেউ তো নিজের প্রিয় মানুষটিকে পাশে বসিয়ে প্রিয় দলের খেলা দেখেন আর ভাবেন তার প্রিয় মানুষটি পাশে থাকলে দলটিও জিতে যাবে। অনেকের আবার খেলা দেখার লাকি জার্সি আছে, লাকি চেয়ারও আছে। এমনকি খেলা দেখার লাকি পজিশন ও আছে!

এসবই মোটাদাগে সংস্কার— বেশির ভাগ মানুষ যাকে আসলে কুসংস্কার হয়েছে চেনেন। এগুলোকে হাস্যকর, অযৌক্তিক বলা গেলেও অমূলক বলা যাবে কি? মনে হয় না। কারণ এসবই আমরা করি আমাদের প্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে— হোক সেটি নিজ দেশ বা ক্লাব পর্যায়ের কোনো দল। আমরা সবাই কমবেশি ভাগ্যে বিশ্বাসী এবং সবাই পছন্দের দলটিকে বিজয়ী দেখতে চাই। আর দর্শক হিসেবে আমরা দলগুলোকে বিজয়ী দেখতে চাই বলে খেলোয়াড়রাও বিভিন্ন সংস্কারে ভুগতে থাকেন দলকে জিতিয়ে আপনার আমার মুখে হাসি ফোটাতে। ক্রিকেটারদের সেরকমই কিছু সংস্কার জানাব আপনাদের।

ক্রিকেটারদের জার্সি- রুমাল সংস্কার:
ধরুন স্টেডিয়ামে বা টেলিভিশনের সামনে বসে বাংলাদেশের খেলা দেখেছেন একটা লাল টিশার্ট বা জার্সি গায়ে। সেদিনই বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অন্য দলকে হারিয়ে দিল। সেই খুশিতে সারা রাত টিশার্টটা খুললেনই না। ভাবছেন এমন পাগলামি শুধু আপনিই করছেন? মোটেও না। পাকিস্তানের শোয়েব আখতারও সেরকম করতেন। তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ঘুমানোর সময়ও পাকিস্তান দলের জার্সি গায়েই ঘুমাতেন! প্রাক্তন ভারতীয় উইকেটরক্ষক চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত তো সারা জীবন সেই শার্টটি ধুতে পর্যন্ত দেননি, যেটা পড়ে তিনি তার প্রথম শতক অর্জন করেছিলেন! সম্ভবত এই জার্সি আর রুমাল নিয়েই ক্রিকেটারদের সংস্কারের ভান্ডারটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

১৯৯৩ সাল। লিডসে চতুর্থ অ্যাশেজ টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিং করছেন অস্ট্রেলিয়ার তখনকার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। খেলার সময় ঘাম মুছতে তিনি একটি লাল রুমাল ব্যবহার করছিলেন। স্টিভ সেদিন ১৫৭ রানের একটি চমৎকার ইনিংস খেলেন। এরপর তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বাকি ১১ বছরের জন্য এই লাল রুমালটিকে করে নিলেন ‘সিকিউরিটি ব্ল্যাঙ্কেট’!

অনিল কুম্বলেও কম যাননি এসব ক্ষেত্র। ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। দিল্লির ফিরোজশাহ কোটলা স্টেডিয়াম। ভারত বনাম পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংস চলছে। টার্গেট ৪২০ রান। একটার পর একটা উইকেট পেয়ে চলেছেন ভারতের অনিল কুম্বলে। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছিলেন কি? বোলিং মার্কে যাওয়ার আগে কুম্বলের সোয়েটার আর ক্যাপ আম্পায়ারের হাতে পৌঁছে দিচ্ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার! এবার আপনার মনে হতেই পারে যে, যতবার শচীন আম্পায়ারের কাছে কুম্বলের ক্যাপ আর সোয়েটার পৌঁছে দিচ্ছিলেন, ততবারই একটি করে উইকেট পাচ্ছিলেন কুম্বলে! ইউটিউব থেকে একবার দেখে নিতে পারেন এ দৃশ্য।

কৃষ্ণ মাচারী শ্রীকান্ত দুই ঘণ্টা ড্রেসিংরুমের ভেতরে বসতেও পারেননি সেদিন। ছবি: স্পোর্টস উইকি
কৃষ্ণ মাচারী শ্রীকান্ত দুই ঘণ্টা ড্রেসিংরুমের ভেতরে বসতেও পারেননি সেদিন। ছবি: স্পোর্টস উইকি


নট নড়নচড়ন:
ধরুন, বন্ধুদের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা দেখছেন। অবস্থা খুব খারাপ। কিছুতেই উইকেট পড়ছে না প্রতিপক্ষের। হঠাৎ একজন বন্ধু কিছু একটা করতে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই একটা উইকেট পতন! এরপর সব বন্ধু মিলে ‘তুই দাঁড়িয়েই খেলা দেখ’ বলে বেচারাকে আর বসতেই দিলেন না। এসব সংস্কার যে ক্রিকেটারদের মাঝেও আছে, তা জানেন? ১৯৮৩ বিশ্বকাপে কপিল দেব যখন জিম্বাবুয়ের বোলারদের তুলোধুনা করে ১৭৫ রানের সেই বিখ্যাত ইনিংসটি খেলছিলেন, তখন ড্রেসিংরুমের সব খেলোয়াড়কে তাদের জায়গা থেকে নড়তে নিষেধ করা হয়। একেবারে নট নড়নচড়ন! সবার ধারণা, একটু নড়লেই আউট হয়ে যাবেন কপিল। বেচারা কৃষ্ণ মাচারী শ্রীকান্ত তো দুই ঘণ্টা ড্রেসিংরুমের ভেতরেও বসতে পারেননি। বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছেন পুরোটা। এমনকি প্রকৃতির ডাক আসা সত্ত্বেও তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন!

শ্রীলঙ্কান আদর:
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের আবার ক্রিকেটের প্রতি অন্যরকম প্রেম ছিল বলে মনে হয়! সঠিকভাবে বললে ক্রিকেটের সরঞ্জামের প্রতি। মাহেলা জয়া বর্ধনে প্রতি ইনিংসেই একাধিকবার তার ব্যাট চুম্বন করতেন। রোশন মহানামা নিয়মিতভাবে প্রতিটি বলের আগে তার ব্যাটের হ্যান্ডেল টিপ চুম্বন করতেন। লাসিথ মালিঙ্গার বল করার আগে বলকে চুমু খাওয়ার রীতি তো জগদ্বিখ্যাত— যা পরে অনেক তরুণ বোলারই অনুসরণ করেছেন। সনাত জয়াসুরিয়া আবার প্রতিটা বল ফেইস করার আগে তার ব্যাটের বিভিন্ন জায়গা স্পর্শ করতেন। যেন, ব্যাটকে আদর করছেন! শ্রীলঙ্কান গ্রেটরা ক্রিকেটকে খেলা ভাবতেন না প্রেমিকা সেটা আসলে গবেষণার বিষয় হতে পারে।

স্পিকটি নট আথারটন:
সাবেক ইংলিশ খেলোয়াড় মাইক আথারটনের একটি অদ্ভুত সংস্কার ছিল। টেস্টের যেদিন তিনি অপরাজিত থাকতেন, সেদিন তিনি কোনো সাক্ষাৎকার, মতামত বা নিজের ইনিংস সম্পর্কে কিছু প্রকাশ করতেন না। শুধু সংবাদমাধ্যম নয় নিজের টিমমেটদের সঙ্গেও তিনি ইনিংস নিয়ে কথা বলতেন না। কারণ পরদিন সকালে তাকে ওই ইনিংসটিই বড় করতে হবে, পাছে কারও নজর লাগে!

রোডসের শুচিবায়ু:
সর্বকাল সেরা ফিল্ডার জন্টি রোডস সব সময় প্যাড আপ করে ব্যাট করার জন্য অপেক্ষা করার সময় তার সব সরঞ্জাম, আশপাশের সবকিছু পরিষ্কার এবং সুশৃঙ্খল রাখার ব্যাপারে খুঁতখুঁত করতেন। তার টিমমেটরা ভুলেও সামান্য ময়লা ফেললে, এমনকি কফি ছলকে পড়লেও তার মাথা খারাপ হয়ে যেত। কারণ রোডস ভাবতেন, এ জন্যই তার ইনিংস আজকে খারাপ হবে।

ভারতীয়দের আসন-সংস্কার:
শুরুতে ‘লাকি সিটের’ কথা বলেছিলাম। ভারতের শ্রীশান্ত সব সময় বাস থেকে সবার শেষে নামতেন। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়ই তিনি এই সংস্কার পালন করেছেন। কোনভাবেই তাকে আগে সিট থেকে ওঠানো যায়নি! শচীন টেন্ডুলকার, অজিত আগারকার, ওয়াসিম জাফর ও অমল মজুমদারের মতো কিছু খেলোয়াড়ের টিম বাসে নিজেদের নির্দিষ্ট সিটই ছিল। তারা সেখানে বসেই ভ্রমণ করতেন। যেদিন তারা ভালো খেলতেন সেদিন মনেপ্রাণে মানতেন যে এই সিটই তাদের জন্য ভাগ্য বয়ে এনেছে!

সংস্কারের মুকুটহীন রাজা নিল ক্যামেঞ্জি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
সংস্কারের মুকুটহীন রাজা নিল ক্যামেঞ্জি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


জিম্বাবুয়ের সাপে-বর:
এই ঘটনাটি একটু বেশিই অদ্ভুতুড়ে, মজারও বটে! জিম্বাবুয়ের সাবেক ক্রিকেটার গ্রান্ড ফ্লাওয়ার এবং মার্ক ডেকার যখনই একসঙ্গে ব্যাট করতে নামতেন, তখনই তারা পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা বার্তা না জানিয়ে ছুড়ে দিতেন অভিশাপ! হ্যাঁ, অভিশাপ। একজন বলতেন ‘আশা করি বল তোমার মাথায় লাগুক!’ অপরজন উত্তর দিতেন ‘সেম টু ইউ!’ ভাবতে পারেন? কিন্তু এই শাপকেই তারা তাদের জন্য বর মনে করতেন।

নিল ম্যাকেঞ্জি: কুসংস্কারের মুকুটহীন সম্রাট
যতই সংস্কারাচ্ছন্ন ক্রিকেটারদের কথা হোক, তাদের যত অদ্ভুত সংস্কারই থাকুক না কেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান নিল ম্যাকেঞ্জি সর্বকালের সবচেয়ে অদ্ভুত সংস্কার গুলির জন্য মুকুটের দাবিদার হয়ে থাকবেন। তিনি বেশ কয়েকটি অদ্ভুত সংস্কার কড়াভাবে মানতেন, যার মধ্যে একটি হলো, ব্যাটিংয়ে যাওয়ার আগে তার টয়লেটের সিটগুলি নামানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা। ব্যাটিং করতে যাওয়ার আগে ড্রেসিংরুমের সমস্ত বাতি নেভানো হয়েছে কিনা তা চেক করা। এমনও শোনা যায়, একবার নাকি তিনি ৮ বারের মতো ড্রেসিংরুমের সমস্ত বাতি নেভানো কি না সেটি চেক করেছিলেন! এ ছাড়া প্রতিটি ইনিংসের পর তার ব্যাট ড্রেসিংরুমের ছাদে টেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হতো।

এই নিল ম্যাকেঞ্জি এখন বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ। এবার খুঁজতে থাকুন, বাংলাদেশ দলের কোনো খেলোয়াড় কোনো ধরনের সংস্কারে ভুগছেন!