যেখানে ডানা মেলে বিশ্বকাপের স্বপ্ন

সাদাচোখে একটা টিভিরুমই তো, অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই এমনটা থাকে। কিন্তু এই রুমের পরিবেশে বোঝাতে প্রয়াত মান্না দের বিখ্যাত ‘কফি হাউস’ গানের একটি লাইন একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়—‘কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই টিভিরুমে’। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) এই টিভিরুমে বসে একদিন বিশ্বকাপ দেখেছেন, বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন বুনেছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমেরা। তাঁদের জায়গায় এসেছে নতুন কুঁড়ি। উত্তরসূরিদের মতো তাদের চোখেও বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পেছনে ছোটা কিশোরদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ দেখে এসে লিখছেন রাশেদুল ইসলাম
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখা চলছে বিকেএসপিতে। এই শিক্ষার্থীদের চোখেও খেলা করছে স্বপ্ন। ছবি: খালেদ সরকার
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখা চলছে বিকেএসপিতে। এই শিক্ষার্থীদের চোখেও খেলা করছে স্বপ্ন। ছবি: খালেদ সরকার

টিভিতে শান্ত চোখ, হাতে নাচছে বল। জোড়া জোড়া চোখগুলো বড় পর্দায় আটকে থাকলেও হাতে হাতে আঙুলের ফাঁকে বল ঘুরছে। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং জুটি ভাঙে না, ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে ওঠে কিশোরদের শান্ত চোখ। মাঝেমধ্যে ক্যাচ বা রান আউটের ক্ষীণ সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে শোনা যায় চাপা রব—‘ইশ্​ওহহো...হলো না!’

আফসোসের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে উল্লাসের ধ্বনি শুনতে সময় লাগল ২০.৫ ওভার। সৌম্য সরকারের বলে অ্যারেন ফিঞ্জ শট থার্ড ম্যানে রুবেল হোসেনের হাতে ক্যাচ দিতেই টিভির বড় হলরুমে শুরু হলো উল্লাস, ‘সৌম্য ভাই খাইয়া দিছে।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে একে অন্যকে ‘হাই ফাইভ’ দিয়ে জড়িয়ে নিল বুকে। শরীরী ভাষা দেখে মনে হলো, উইকেটটা তারাই পেয়েছে!

টিভির পর্দায় ততক্ষণে দৌড়ে এসে সৌম্যকে জড়িয়ে ধরে গভীর স্নেহে আলিঙ্গন করছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা। প্রথম দৃশ্যটি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আর দ্বিতীয়টি সবারই জানা নটিংহামে। গুগল বলছে, দুই শহরের দূরত্ব ৮ হাজার ১৪ কিলোমিটার। কিন্তু গাণিতিক দূরত্ব এক পাশে সরিয়ে রেখে খুব সহজেই নটিংহাম ও বিকেএসপির টিভির রুমকে মেলানো যায় এক বিন্দুতে!

হয়তো এদের মধ্যেই আছে আগামী দিনের সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম। ছবিটি বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার দিন তোলা।
হয়তো এদের মধ্যেই আছে আগামী দিনের সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম। ছবিটি বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার দিন তোলা।

এই ভাই, সেই ভাই

নটিংহামে সৌম্য-সাকিবরা যখন বল হাতে ছুটছেন, টিভির পর্দার সামনে অলক্ষ্যে তাঁদের সঙ্গে ছুটছিল শ খানেক উত্তরসূরি। ব্যাটিংয়ে মুশফিক যখন মিশেল স্টার্ক-অ্যাডাম জাম্পাদের বলগুলো সীমানার বাইরে পাঠাচ্ছিলেন, বাতাসে ব্যাট ধরার ভঙ্গিতে হাত ঘুরিয়ে এই কিশোরেরা নিজেরাই যেন তুলোধুনো করছিল অস্ট্রেলীয় বোলারদের। মুশফিকের সেঞ্চুরির দৃশ্যটা বিকেএসপির টিভিরুমে বসে না দেখলে হয়তো বোঝাই হতো না, সেঞ্চুরির পর ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটসম্যানের অনুভূতিটা কেমন হয়! সবাই দাঁড়িয়ে দুই হাত মুষ্টি করে ঝাঁকিয়ে বলছিল, ‘মুশফিক ভাই, মুশফিক ভাই’।

হাজার মাইল দূরত্বের দুটি দৃশ্যর কোলাজকে এক ফ্রেমে বাঁধানো যায় অতি সহজেই! এই টিভিরুমে বসেই একসময় আবদুর রাজ্জাক, আল শাহরিয়ার রোকনদের সঙ্গে অলক্ষ্যে বিশ্বকাপে খেলেছেন সাকিব, মুশফিকরা। সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন বাস্তবেই তাঁরা ১৮ কোটি মানুষের বিশ্বকাপ স্বপ্নের সারথি। আর অতীতের সিঁড়ি বেয়ে একই সে বাগানে আজ এসেছে আকবর আলি, সাদমান রহমান, রাতুল খানের মতো নতুন কুঁড়িরা।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ম্যাচগুলো আমি-আপনি দেখে উল্লাস করছি, কখনো ভেঙে পড়েছি হতাশায়। কিন্তু বিকেএসপির ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের খেলা দেখার পরিবেশ মেলানো যাবে না। মোটা দাগে বড় পার্থক্য—রাতুল, সাদমানরা বিশ্বকাপ দেখে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন নিয়ে। হ্যাঁ, ওদের মতো করে দেশের আনাচকানাচে অনেক বালক-কিশোরই দেখছে। কিন্তু বিকেএসপির টিভিরুমের প্রতিটি ইটে সাকিব-মুশফিকদের যে ইতিহাস খোদাই করে লেখা, তা তো অন্যদের ড্রয়িংরুমে নেই।

এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ দলে বিকেএসপির ছাত্র সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, লিটন দাস ও মোহাম্মদ মিঠুন। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া সৌম্য ও অভিষিক্ত লিটন তো ২০১১ বিশ্বকাপেও গলা ফাটিয়েছেন এই টিভিরুমে বসেই। ৮ বছরের ব্যবধানে বোকা বাক্সের মধ্যে তাঁরাই এখন দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অগ্রজ লিটন-সাকিবেরা দৃষ্টিনন্দন শট খেললেই তাই রব ওঠে ‘ওয়েল ডান সাকিব/লিটন ভাই।’ রুমের দেয়ালে বড় করে টানানো সাকিব আল হাসানের ছবি। আপাতত ছবিটাই না হয় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের হয়ে ধন্যবাদ জানাল!

টিভিতে ‘ভাই’দের খেলা দেখার আনন্দ অন্য রকম
টিভিতে ‘ভাই’দের খেলা দেখার আনন্দ অন্য রকম

 আমার সোনার বাংলা

ম্যাচের শুরুতে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলায় বাংলাদেশ দল, টিভিরুমে ছেলেগুলোও দাঁড়িয়ে যায়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ কল্পনার সব রং মিলিয়ে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় খেলোয়াড়দের ওই কাতারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩২২ রান তাড়া করার পথে সেঞ্চুরি করে হেলমেট উঁচু করে ধরেছিলেন সাকিব, বিকেএসপির বর্তমান সিনিয়র দলের ওপেনার সাদমান রহমান নিজেকে ভাবতে শুরু করেছেন পূর্বসূরির জায়গায়, ‘সেঞ্চুরির পর সাকিব ভাই হেলমেট খুললে সবাই দাঁড়িয়ে যে সম্মান দেখিয়েছে, একজন খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত। ম্যাচ শেষে সাকিব ভাই বলেছেন, আত্মবিশ্বাসের জোরেই সম্ভব। এরপর আমিও ভাবতে শুরু করেছি, বিকেএসপি থেকে সাকিব ভাই পারলে আমি কেন পারব না।’ শেষ প্রিমিয়ার লিগে বিকেএসপির জার্সিতে ৫ ম্যাচে ১৯৫ রান করেছেন ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়ুয়া সাদমান। তাঁর লক্ষ্য পূরণের পথটা কঠিন হলেও অসম্ভব তো নয়।

অন্যদের স্বপ্নপূরণের পথটাও তো এমনই ছিল। বর্তমানে জাতীয় দলের বাইরে থাকা এনামুল হক বিজয়ের কথাই স্মরণ করতে পারেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ছয়জন খেলোয়াড়ের মধ্যে সাকিব ও মুশফিকদের সঙ্গে গর্বের সেই তালিকায় নাম ছিল নাসির হোসেন, মুমিনুল হক, সৌম্য সরকার ও এনামুল হকের। ২০০৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে এনামুলের সৌভাগ্য হয়েছিল আজকের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবের সঙ্গে একই টিভিরুম, ডাইনিং হলে সময় কাটানোর। ২০০৬ সালে যে সাকিব ছিলেন উঠতি একজন প্রতিভা, ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের আশার আলো ও প্রাণ। সাকিবের সেই ভোজবাজির গল্পটা কিশোর এনামুলের মগজে গেঁথে পরবর্তী সময়ে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা।

রোমাঞ্চকর স্মৃতির সিন্দুক খুলে দিয়ে এনামুল শোনালেন সেই গল্প, ‘২০০৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে সাকিব ভাইয়ের পেছনে লাইন ধরে মাঠে গিয়েছি। এক বছর পরে তাঁকেই যখন টিভিতে দেখলাম বিশ্বকাপ খেলতে, সেটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। আমি এখনো বিশ্বাস করি, ২০০৭ সালে সাকিব ভাইয়ের বিশ্বকাপ খেলাটাই ছিল আমার জাতীয় দলে খেলার অনুপ্রেরণা। কারণ ঘটনাটি ঘটেছিল চোখের সামনে।’

এক যুগ আগের গল্প ছাড়ুন। শুনুন টাটকা অনুপ্রেরণার গল্প। বৃহস্পতিবার রাতে দেখা মুশফিকের লড়াকু সেঞ্চুরির ইনিংসের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ উঠে গিয়েছে আকবর আলির ডায়েরিতে। মুশফিকের সঙ্গে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক আকবরের মিলের অন্ত নেই। দুজনই বিকেএসপির ছাত্র, উইকেটরক্ষক, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ও দুজনেরই আছে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। আরও একটা বড় মিল আছে। এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছেন দুজনই। সবকিছুই কাকতালীয়ভাবে মিলে যাচ্ছে। কে জানে, আকবরই হয়তো ভবিষ্যৎ বিশ্বকাপ দলের উইকেটরক্ষক! এই টিভিরুম থেকেই তো ওরা শুরু করে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নের রেণু।

বিকেএসপিতে ভর্তি

সন্তানদের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণের পথে অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। যেখান থেকে উঠে এসে বিশ্বক্রিকেট মাতাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, মোহাম্মদ মিঠুন, নাসির হোসেন, আবদুর রাজ্জাকদের মতো ক্রিকেটাররা। বিকেএসপিতে ভর্তি হতে পারলে ভালো একটা নির্দেশনা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্যক্তিগত মেধা ও পরিশ্রম ছাড়া ক্রীড়ায় সাফল্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। আবার সঠিক উপায়ে পরিশ্রমের পথটা জানা উচিত। সে পথটা দেখিয়ে দিতে পারে বিকেএসপি। প্রতিবছরের শুরুতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু করে ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানো হয়।