রশিদ-মুজিবদের যেভাবে খেলতে হবে সাকিবদের

স্পিনে মুশফিকের পায়ের কাজ বেশ ভালো। কাল পায়ের ব্যবহার করতে হবে তাঁকে। ছবি: প্রথম আলো
স্পিনে মুশফিকের পায়ের কাজ বেশ ভালো। কাল পায়ের ব্যবহার করতে হবে তাঁকে। ছবি: প্রথম আলো
>

সাউদাম্পটনে কাল আফগানিস্তানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এ মাঠে সবশেষ ম্যাচে ভারতের ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন আফগান স্পিনাররা। তাঁদের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ের ধরন কেমন হওয়া উচিত?

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের তুলনা চলে? জবাব দেওয়া দূরে থাক অনেকে এ প্রশ্নেই বিরক্ত হতে পারেন। তবে মাইকেল হাসির কথা শুনলে অনেকে এ নিয়ে যুক্তি-তর্কেও মেতে উঠতে পারেন। ‘বাংলাদেশের ব্যাটিং প্রায় অস্ট্রেলিয়ার সমমানের’—অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচ বিশ্লেষণে কথাটা বলেছিলেন হাসি।

বিশ্বকাপে কাল আফগানিস্তানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ভেন্যু সাউদাম্পটনের রোজ বোল। এ মাঠেই কাল আফগান স্পিনারদের বিপক্ষে ভুগেছে ভারতীয় ব্যাটিং। সে জন্যই প্রসঙ্গটির অবতারণা। তা যে দলের ব্যাটিং-ই ভালো হোক আফগান স্পিনাররা তো আর পাল্টাচ্ছেন না! তাঁদের তূণের বিষ একই থাকবে। কৌশলের বিষ দিয়ে সেই বিষক্ষয় করা যাবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

ভারতের তারকাসমৃদ্ধ ব্যাটিং অর্ডার কিন্তু পারেনি। ‘রহস্য’ স্পিনার খ্যাত রশিদ খান এবং মুজিব উর রহমানের বিপক্ষে তাঁদের হাঁসফাঁস করা ছিল চোখে পড়ার মতো। আসলে মন্থর উইকেটে চার আফগান স্পিনারেই ভুগেছে ভারত। দেখে মনে হয়নি এ দলটাই নাকি ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্পিন খেলতে পারে’! কাল রোহিত-ধোনিদের স্পিনজালে হাঁসফাঁস করা দেখে বাংলাদেশের সমর্থকেরা নিশ্চয়ই ভেবেছেন, ভারতেরই যদি এমন ত্রাহি ছুটে যায় তাহলে মাশরাফির দলের কী হবে!

সবার আগে যে কথাটি বলা যায়, নতুন ম্যাচ মানেই সবকিছু নতুন করে শুরু করা। রশিদ-মুজিব যে কালও বিষ ছড়াবেন, সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছে কে? ছড়ালেও সমাধান ব্যাটসম্যানেরাই সবচেয়ে ভালো জানেন। বিপিএলের সুবাদে আফগান স্পিনাররা তামিম-মুশফিকদের কাছে চেনা বইয়ের মতো। স্পিন পড়তে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরাও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। হাসি এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে তুলনাটা টেনেছেন। সব মিলিয়ে আফগানদের স্পিন জাল ফেলা আর মুশফিকদের সেই জাল কাটতে দেখার দুর্দান্ত একটা লড়াই আশা করাই যায়।

লড়াইয়ে নামার আগে প্রস্তুতি থাকতে হয়। ক্রিকেট বিশ্বকাপ এখন যে পর্যায়ে গড়িয়েছে, তাতে গ্রুপ পর্বে প্রতিটি ম্যাচই এখন বাংলাদেশের জন্য দৃশ্যত ‘বাঁচা-মরার’ লড়াই। এর সঙ্গে যোগ করুন আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের ‘কোনোভাবেই হারা যাবে না’ মানসিকতা। কাল ভারত-আফগানিস্তান ম্যাচে চোখ রেখে তামিম-মুশফিকরা যে রাতের ঘুমেও মুজিব-রশিদদের খেলেছেন, সে আর বলতে! তাই প্রস্তুতিতে যে কোনো ফাঁক থাকবে না, তা নিশ্চিত। মাঠের বাইরে থেকে ব্যাটসম্যানদের শুধু কৌশলগত কিছু ব্যাপার মনে করিয়ে দেওয়া যায়।

সাউদাম্পটনের বাইশ গজ কিছুটা মন্থর। বল থেমে থেমে আসে। এমন উইকেটে স্পিনারদের খেলা বেশ কঠিন। হয় বল আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, নতুবা সামনে থেকে ব্যাট আগে চালাতে হয়। সে ক্ষেত্রে সুবিধামতো ফাঁকা জায়গায় বারবার বল পাঠিয়ে রানের চাকা সচল রাখা একটু কঠিন। আর সঙ্গে যদি টার্ন থাকে, তাহলে যেকোনো ব্যাটসম্যানের দম আটকে আসাই স্বাভাবিক। তবে ভালো ফুটওয়ার্ক থাকলে এই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা যায়। তা ছাড়া স্পিনে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ফুটওয়ার্ক বেশ ভালো।

স্পিনারদের বিপক্ষে সাকিব একটু আক্রমণাত্মক ব্যাট করে থাকেন। ছবি: প্রথম আলো
স্পিনারদের বিপক্ষে সাকিব একটু আক্রমণাত্মক ব্যাট করে থাকেন। ছবি: প্রথম আলো

চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হলো, কাল ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে রশিদ-মুজিব দুজনেই কিন্তু একটু ঝুলিয়ে বল ছেড়েছেন। মানে ‘ফ্লাইট’ ছিল সঙ্গে বাঁক আর বৈচিত্র্য। আফগানিস্তানের আগের ম্যাচগুলো হয়েছে মোটামুটি পেসবান্ধব উইকেটে। সেখানে সুবিধামতো বাঁক না পাওয়ায় বল একটু জোরের ওপর করতে হয়েছে রশিদ-মুজিবকে। এতে দুজনের কেউ তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তো একটু জোরের ওপর সামনে বল ফেলতে গিয়ে প্রচণ্ড মার খেয়েছেন রশিদ। কিন্তু সাউদাম্পটনে একটু স্পিনবান্ধব বাইশ পেতেই বেরিয়ে পড়েছে দুজনের আসল রূপ। দুজনে একটি করে উইকেট পেলেও রান দেওয়ায় ছিলেন ভীষণ কিপটে।

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের স্বনামধন্য কোচ এবং জেমি সিডন্স জাতীয় দলের কোচ থাকতে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এখানে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, কাল ম্যাচে আফগান স্পিনাররা এতটা কিপটে বোলিং করতে পারতেন না যদি শুরু থেকে তাঁদের চড়ে বসার সুযোগটা না দিত ভারতের টপ অর্ডার। ‘শুরুতে নিজেদের জায়গায় বল পেয়েও ওরা মারেনি। এতে স্পিনাররা সুযোগটা পেয়েছে’—ব্যাখ্যা করলেন সালাউদ্দিন।

রশিদ-মুজিব দুজনেই কবজির স্পিনার। একজন লেগি আরেকজন অফ স্পিনার হলেও দুজনেই উল্টোটা মারতে পছন্দ করেন এবং প্রতি ওভারেই অন্তত দু-একটা মেরে থাকেন। তাঁদের রহস্য পড়ার সবচেয়ে বড় টোটকা হলো বল ছাড়ার আগে বোলারের কবজিতে খেয়াল রাখা। কবজি পড়তে পারলে মানে বোলারের হাত দেখেই যদি বুঝে ফেলা যায় ডেলিভারি কোনদিকে যাবে তাহলে খেলতে এবং গ্যাপ বের করতে সুবিধা। স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের মৌলিক বিষয় আর ‘স্পিনারদের কবজি পড়তে ব্যাটসম্যানদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়’—বলেই মনে করেন সালাউদ্দিন।

আফগান স্পিনারদের বিপক্ষে রান বের করায় বড় সুবিধা হতে পারে সাউদাম্পটনের মাঠ। ইংল্যান্ডের অন্যান্য মাঠের তুলনায় এখানকার সীমানা মোটামুটি বড়। বোলার-ব্যাটসম্যানের সামনে-পেছনে ৮২ মিটার, অফ সাইড ও লেগ সাইডে ৭৬ মিটার। অর্থাৎ ফাঁকা জায়গা থাকবে বেশি। চার-ছক্কা নিয়মিত বের করতে না পারলেও সিঙ্গেলস নিতে সুবিধা হবে এবং সুযোগমতো তা ডাবলসও বানানো যাবে।

তামিম ইকবালকে তাঁর নিজের খেলাটা খেলতে হবে। ছবি: প্রথম আলো
তামিম ইকবালকে তাঁর নিজের খেলাটা খেলতে হবে। ছবি: প্রথম আলো

কাল আফগানিস্তানের ইনিংসে মাঝপথের ব্যাটিংটা মনে থাকলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। শেষ দুই-তিন ওভারের আগ পর্যন্তও ম্যাচে ভালোভাবেই টিকে ছিল আফগানিস্তান। ভারতের স্পিনারদের মুখোমুখি হয়ে বলের সঙ্গে রানের ব্যবধানটা সামর্থ্যের ভেতরেই রেখেছিলেন মোহাম্মদ নবী-নজিবুল্লাহ জাদরানরা। কীভাবে? যেহেতু চার-ছক্কা সেভাবে মারা যাচ্ছিল না তাই বল নিয়মিত গ্যাপে পাঠিয়ে স্ট্রাইক অদল-বদল করা এবং সুযোগ বুঝে সিঙ্গেলসকে ডাবলসে পরিণত করে। আর ম্যাচ শেষে মিক্সড জোনে বিরাট কোহলির কথাটা মুশফিক-তামিরা শুনে থাকলে তো কথাই নেই!

ভারতের ব্যাটসম্যানেরা কাল স্পিনের বিপক্ষে খাবি খেলেও ব্যতিক্রম ছিলেন কোহলি। রান (৬৭) তুলেছেন এক শ-র বেশি স্ট্রাইক ধরে রেখে। সঞ্চালকের জিজ্ঞাসা ছিল, কীভাবে পারলেন? ‘উইকেটে গিয়ে বলের গতি বোঝার চেষ্টা করেছি। আড়াআড়ি ব্যাট চালিয়ে যে রান করা যাবে না, তা টের পেয়ে যাই। এ উইকেটে আড়াআড়ি ব্যাট চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে আমাদের’—ব্যাখ্যা করেন কোহলি।

অর্থাৎ, সোজা ব্যাটে খেলতে হবে। অযথা চাপ নিয়ে রান বাড়ানোর তাড়নায় ক্রস ব্যাট না চালানোই নিরাপদ। সোজা-সোজা খেলে বাজে বলের সদ্ব্যবহার আর নিয়মিত সিঙ্গেলস বের করতে পারলেই স্পিনাররা চড়ে বসতে পারবে না বলে মনে করেন সালাউদ্দিন। রশিদ-মুজিবকে নিয়ে অযথা ‘জুজু’তে ভোগার কিছু নেই। ‘উইকেট ভালোই আছে। বোলাররা যেন চড়ে বসতে না পারে, তা খেয়াল রাখতে হবে। সে জন্য সুবিধামতো জায়গায় বল পেলে মেরে দেওয়াই ভালো। এখানে বেশি ভাবনার কিছু নেই। ব্যাটসম্যানরা স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারলেই হবে। তা ছাড়া যেকোনো একজন স্পিনার যেমন রশিদের কাছ থেকে যদি ৫০ রান বের করা যায়, তাহলে বাকিরাও চাপে পড়বে। এটি মোটেও কঠিন কাজ নয়। ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন ১০ ওভারের পর চারজন ফিল্ডার এমনিতেই বাইরে থাকে। তাই গ্যাপ পাওয়া যাবে’—ব্যাখ্যা করলেন সালাউদ্দিন।

সহজ কথায়, স্পিন খেলায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যে সহজাত সামর্থ্য তার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলেই রশিদ-মুজিবের জাল ছিঁড়ে বের হওয়া সম্ভব। ভারতের বিপক্ষে ভালো করেছে, তা ভেবে চাপ নিয়ে ফেললে ওদের খারাপ বলটাও কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।