বিশ্বকাপ-সেরা তো হয়েই গেছেন সাকিব!

আফগানিস্তানের বিপক্ষেও চওড়া হয়ে উঠেছিল সাকিবের ব্যাট। বল হাতেও দুর্দান্ত ফর্মে আছেন এ অলরাউন্ডার। ছবি: শামসুল হক
আফগানিস্তানের বিপক্ষেও চওড়া হয়ে উঠেছিল সাকিবের ব্যাট। বল হাতেও দুর্দান্ত ফর্মে আছেন এ অলরাউন্ডার। ছবি: শামসুল হক
>

সাকিব আল হাসান এবার বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। ৬ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৪৭৬ রান। বল হাতে ৬ ম্যাচে নিয়েছেন ১০ উইকেট। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে কোনো ক্রিকেটারই এক টুর্নামেন্টে এমন অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখাতে পারেনি। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল-পর্ব এখনো শুরু না হলেও টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কারটা তো সাকিবের হাতে এখনই তুলে দেওয়া যায়!

আফগানিস্তান তখন হার দেখছে। জয়ের সুবাস পাচ্ছে বাংলাদেশ। স্ট্রেট অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসা বল ডাইভ দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলেন সাকিব আল হাসান। পারলেন না। ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান স্মিথ বলে উঠলেন, ‘হি ইজ হিউম্যান! সাকিব ইজ অফিশিয়ালি হিউম্যান’!

ভিনগ্রহের খেলোয়াড়—কথাটাকে ফুটবলে একধরনের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে নিয়েছেন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ক্রিকেটে এ বিশেষণ খুব বেশি ব্যবহার হয় না। আর বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের কেউ এমন মনে করবেন, তা ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ জাগে। নিউজিল্যান্ডের সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান স্মিথ সাকিবের ওই ফিল্ডিং মিসের আগ পর্যন্ত তাঁকে রক্ত-মাংসের মানুষ বলেই মনে করেননি, মানে ভিনগ্রহের কেউ! অত্যুক্তি মনে করে স্মিথকে দোষ দিতে পারবেন না। সাকিবের পারফরম্যান্সই বলছে ব্যাটে-বলে এমন ‘সব্যসাচী’ ক্রিকেটার বিশ্বকাপের এক সংস্করণে এর আগে দেখা যায়নি।

সাকিব এরই মধ্যে চলতি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। ৬ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৪৭৬ রান। বল হাতেও ভেলকি দেখাচ্ছেন ভালোই। এ ৬ ম্যাচে তাঁর শিকার ১০ উইকেট। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে কোনো ক্রিকেটারই এক টুর্নামেন্টে এমন অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখাতে পারেনি। অর্থাৎ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সাকিবই প্রথম ক্রিকেটার যিনি, এক টুর্নামেন্টে ন্যূনতম ৪০০ রানের পাশাপাশি ১০ উইকেট নিলেন। এমন অনন্য কীর্তি গড়া ক্রিকেটারের হাতে এবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠবে তো?

প্রশ্নবোধক চিহ্নটা রাখতেই হচ্ছে। কারণ, বিশ্বকাপে ‘প্লেয়ার অব দা টুর্নামেন্ট’ মানে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার চালুর পর একটি অলিখিত নিয়ম চলে আসছে। ন্যূনতম সেমিফাইনাল খেলেছে এমন দলের পারফরমারদের হাতে উঠেছে টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কার। বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠার সুযোগ যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু ধরুন, উঠতে পারল না তবুও কিন্তু সাকিবের এ অর্জন অনন্য হয়েই থাকবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সাকিবের হাতে তো এখনই তুলে দেওয়া যায়!

বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৯২ সংস্করণ থেকে। সেবার ৪৫৬ রান করে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান মার্টিন ক্রো। তাঁর দল হেরেছিল সেমিফাইনালে। পরের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলো শ্রীলঙ্কা। দলটির ওপেনার সনাথ জয়াসুরিয়া ২২১ রান ও ৭ উইকেট নিয়ে হলেন টুর্নামেন্ট–সেরা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ তো ল্যান্স ক্লুজনারের। সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়া দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ২৮১ রানের পাশাপাশি ১৭ উইকেট নিয়েছেন সাবেক এ অলরাউন্ডার।

২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা শচীন টেন্ডুলকার ভারতের হয়ে ৬৭৩ রানের পাশাপাশি ২টি উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট-সেরা। এরপর ২০০৭ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একাই ২৬ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট-সেরা হন গ্লেন ম্যাকগ্রা। পরের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ভারতের যুবরাজ সিং ৩৬২ রান করার সঙ্গে তুলে নিয়েছিলেন ১৫ উইকেটও। টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কারটা তাঁর হাতেই উঠেছিল। আর সবশেষ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় মিচেল স্টার্ক অস্ট্রেলিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ২২ উইকেট নিয়ে দুর্দান্ত অবদান রেখেছিলেন। সাকিব কিন্তু ব্যাটে-বলে এসব পারফরমারদেরও ওপরে।

চলতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে এত দিন এ টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ড নৈপুণ্য হিসেবে দেখা হতো দুজনের অবদানকে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ক্লুজনারের ২৮১ রানের পাশাপাশি ১৭ উইকেট এবং ২০১১ বিশ্বকাপে যুবরাজ সিংয়ের ৩৬২ রানের সঙ্গে ১৫ উইকেটশিকার। উইকেটসংখ্যায় সাকিব এখনো তাঁদের ধরতে পারেননি বটে কিন্তু রানসংখ্যায় দুজন তাঁর পেছনে। কিন্তু অলরাউন্ড নৈপুণ্যের মাইলফলক হিসেবে ৪০০ রান ও ন্যূনতম ১০ উইকেট ধরলে সাকিবের ধারে-কাছে কেউ নেই। আর এবার বিশ্বকাপে তিনে ব্যাটিংয়ে নেমে সাকিব বলতে গেলে একাই টানছেন দলকে, বোলিংয়েও নতুন বলে বল করার চাপ নিচ্ছেন, রান আটকাচ্ছেন, উইকেট নিচ্ছেন—এবার বিশ্বকাপে আর কোনো ক্রিকেটার ব্যাটে-বলে দলের জন্য নিজেকে এতটা নিংড়ে দিতে পেরেছেন?

বিশ্বকাপে তো নেই, এমনকি ওয়ানডে ইতিহাসেই নির্দিষ্ট কোনো সিরিজে ন্যূনতম ৪০০ রানের পাশাপাশি ১০ উইকেট নেওয়ার নজির আছে শুধু বেনসন অ্যান্ড হেজেজ ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে। ১৯৮০ সালে ১৪ ম্যাচে তা করে দেখিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি গ্রেগ চ্যাপেল। এরপর দুবার মাইলফলকটি ছুঁয়েছেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস; ১৯৮১ ও ১৯৮৫ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেজ ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে। যথাক্রমে ১৪ ও ১৩ ম্যাচ খেলে মাইলফলকটির দেখা পেয়েছিলেন ভিভ রিচার্ডস। সাকিব এখানেও অনন্য। এ মাইলফলক ছুঁতে তাঁর লাগল মাত্র ৬ ম্যাচ।

বাংলাদেশ এ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে এখনো দুটি ম্যাচ খেলবে। অর্থাৎ রান ও উইকেটসংখ্যা আরও বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন সাকিব। ধরে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে পারল না কিন্তু বিশ্বকাপে অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের মানদণ্ড সাকিব যে উচ্চতায় স্থাপন করলেন, তাতে টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কারটা কি তাঁর প্রাপ্য নয়?