স্যালুট, সাকিব!

উৎপল শুভ্র
উৎপল শুভ্র

এর মধ্যে ব্যাটিংটা একটু বিস্ময় হয়েই এসেছে। যতটা না রান, তার চেয়ে বেশি ব্যাটিংয়ের ধরন। ক্যারিয়ারের শুরুতে যখন চার নম্বরে নামতেন, সাকিবের ব্যাটিং দেখতে খুব সুন্দর লাগত। মাঝখানে টি-টোয়েন্টির প্রভাবেই কি না, সেই ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে কার্যকারিতাই বড় হয়ে উঠেছিল। এই বিশ্বকাপে সাকিবের ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্য আর কার্যকারিতার মধ্যে কোনো আড়ি নেই। দুটির মেলবন্ধন ঘটিয়ে শুধু বাংলাদেশ দলেরই নয়, এই বিশ্বকাপেরই সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। অথচ মনে করে দেখুন, গত কয়েক বছর বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিবের নাম কখনো আলোচিত হয়েছে কি না। কখনো এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তামিম ইকবাল, কখনোবা মুশফিকুর রহিম।

এমনই ব্যাটিং করছেন যে বিশেষজ্ঞরাও দেখছি বলছেন, সাকিব যত ভালো বোলার, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ব্যাটসম্যান। অথচ মাঝখানে লম্বা একটা সময় আমরা কি উল্টোটাই জেনে আসিনি! কখনো মনে হবে ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিং ভালো, কখনোবা বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিং—একজন অলরাউন্ডারের জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি তো এটাই।

সাকিব ভালো, সবাই জানতেন। কতটা ভালো, তা বুঝিয়ে দিতে যেন পরিকল্পনা করেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চটাকে বেছে নিয়েছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি আর ৫ উইকেটের কীর্তিতে যুবরাজ সিংয়ের অংশীদারত্ব আছে। যদিও সবাই জানেন ব্যাটসম্যান যুবরাজের সঙ্গে বোলার যুবরাজের কোনো তুলনাই চলে না। এই ম্যাচের পর আরেকটি যে কীর্তি, সেটিই বরং সাকিবের অলরাউন্ডার সত্তার সত্যিকার জয়গান। এক বিশ্বকাপে আর কারও ৪০০ রান আর ১০ উইকেটের যুগলবন্দী নেই। কীর্তিটা কত বড়, তা বোঝাতে মনে করিয়ে দিই, গ্যারি সোবার্স ছাড়া ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত সব অলরাউন্ডারই বিশ্বকাপ খেলেছেন। একই সময়ের ইমরান খান, কপিল দেব, ইয়ান বোথাম, রিচার্ড হ্যাডলির মতো এঁদের উত্তরসূরি জ্যাক ক্যালিসও ক্যারিয়ারের সেরা সময়েই।

বর্তমান এবং সাম্প্রতিক অতীত ছাড়িয়ে সাকিবের মাহাত্ম্য যে আরও অনেক দূর বিস্তৃত, এটি এর একটা প্রমাণ। এর চেয়েও বড় একটা প্রমাণ আমি বের করেছিলাম আমার এগারো বইয়ে সাকিবকে নিয়ে লিখতে গিয়ে। কৌতূহল, নিছকই কৌতূহল থেকে দেখতে চেয়েছিলাম, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ছয়জন অলরাউন্ডারের তুলনায় সাকিব কোথায় থাকেন। বাহন অবশ্যই পরিসংখ্যান। তখন পর্যন্ত সাকিব খেলেছিলেন ৫৫টি টেস্ট ও ১৯৫টি ওয়ানডে। টেস্টের ক্ষেত্রে ৫৫ টেস্ট শেষে বাকিদের রান-উইকেটের সঙ্গে সাকিবের রান-উইকেটের তুলনাই যথেষ্ট ছিল। ওয়ানডেতে একটু সমস্যায় পড়লাম। সোবার্স মাত্র একটিই ওয়ানডে খেলেছেন বলে তিনি না হয় বাদ। বাকিদের মধ্যেও যে কপিল আর ক্যালিস ছাড়া আর কেউ ১৯৫টি ওয়ানডে খেলেননি। এই দুজনের সঙ্গে সরাসরি তুলনা হলো। বাকিদের ক্ষেত্রে বিকল্প পথ—ইমরান (১৭৫), বোথাম (১১৬), হ্যাডলির (১১৫) সমান ম্যাচ খেলার পর সাকিব কোথায় ছিলেন। তা করতে গিয়েই বিষম চমক। সাকিব তো দেখছি কারও চেয়ে কম নন! কেউ রানে এগিয়ে থাকলে সাকিব উইকেটে এগিয়ে, কারও ক্ষেত্রে বা উল্টোটা। যেটির সরল সমীকরণ—সাকিব শুধু বর্তমান সময়েরই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। যা নিয়ে কখনোই সেভাবে আলোচনা হয় না। এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর হয়তো হবে।

আপাতত একটা কাজ তো আমরা করতেই পারি। ২০১৬ সালে ঢাকা টেস্টে বেন স্টোকসকে আউট করে সাকিবের স্যালুট দেওয়ার যে দৃশ্যটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমর ছবি হয়ে আছে, চলুন, সেই স্যালুটটাই দিয়ে দিই সাকিবকে।

স্যালুট, সাকিব!