ক্রিকেট-বন্দনা

নির্মলেন্দু গ‌ুণ
নির্মলেন্দু গ‌ুণ

বর্তমান বিশ্বে তথ্যসন্ধানী মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল হলো গুগল। আমি তাকে স্যারই বলব। স্যার বলব এ জন্য যে স্যার কথাটার চেয়ে সম্মানসূচক কোনো শব্দ অন্তত আমার জানা নেই।

আমি আমার লেখার প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই আমার ওই গুগল স্যারের শরণাপন্ন হই। এবং যেসব তথ্য জানার জন্য আমাকে বহু ক্রোশ পাড়ি দিতে হতো, বহু পণ্ডিতের দুয়ারে ধরনা দিতে হতো, বহু বই পড়তে হতো—

গুগল স্যার এখন সেসব সংবাদ ও তথ্য-উপাত্ত চোখের পলকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন।

এই যে আইসিসি আয়োজিত দ্বাদশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা চলছে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ১১টি ক্রিকেট ভেন্যুতে, এই নিয়ে আমাদের উপমহাদেশের পাঁচটি দেশ (ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও আফগনিস্তান) মূলপর্বে অংশ নিচ্ছে। আশ্চর্য যে এই বিশ্ব ক্রিকেট কাপের প্রতিযোগী ১০ দেশের অর্ধেক দেশই হচ্ছে আমাদের নিকট প্রতিবেশী। ফলে চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে আমাদের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনার শেষ নেই।

অন্য যে পাঁচটি দেশ (ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) অংশ নিচ্ছে এই ক্রিকেটযুদ্ধে সেই দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার এক–দশমাংশের বেশি হবে না। তার মানে—ক্রিকেট হচ্ছে মূলত আমাদের এই উপমহাদেশেরই জনপ্রিয় খেলা। তার জন্ম এবং শৈশব-কৈশোর যেখানেই কাটুক না কেন।

আমরা আছি বলেই ক্রিকেট আছে। আমরা না থাকলে ক্রিকেট নেই। ক্রিকেট প্রায় থাকেই না। আমরা স্পনসর না করলে ক্রিকেট চলবে কেমন করে? ক্রিকেটাররা টাকা পাবে কই? দর্শক পাবে কই?

৭৩০ কোটি মানুষের এই গ্রহটিতে কমবেশি ২০০ কোটি মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে। এর বেশি নয়। ফলে ফুটবলের বিশ্বকাপ যেমন বিশ্বজুড়ে উত্তাপ ও উত্তেজনা ছড়ায়, ক্রিকেট তার ধারেকাছেও নেই। ১৩০ কোটির দেশ চীনকে ক্রিকেট–বিশ্বে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল আইসিসি। বাংলাদেশের ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম সেই দায়িত্ব নিয়ে চীনে কাটিয়েছেন কিছুকাল। কিন্তু তিনি চীনকে টানতে পারেননি।

উত্তর আমেরিকা বা দক্ষিণ আমেরিকা তো ক্রিকেটের নাম শুনেছে বলেই মনে হয় না।

কানাডা ক্রিকেটে এসেছিল, কিন্তু তার আসাটাকে কবিগুরুর গানের ভাষায় বলা যায়—এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে।

এই যখন অবস্থা, তখন একজন ক্রিকেট–ভক্ত হিসেবে আমার খারাপ লাগলেও গুগল স্যারকে আর দোষ দিই কী করে?

আমি বিশ্বের খেলাধুলা নিয়ে রচিত বিশ্বখ্যাত কিছু গ্রন্থের নাম ও গ্রন্থের লেখকের নাম জানার জন্য আমার শ্রদ্ধেয় গুগল স্যারকে প্রশ্ন করেছিলাম।

The top 100 Sports Book of All time শিরোনামে একটি পেজ আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেন গুগল স্যার।

ভাবলাম এই শত গ্রন্থের তালিকায় ক্রিকেট নিয়ে রচিত কিছু গ্রন্থের হদিস নিশ্চয়ই এবার পাব। কিন্তু হায়, একে একে ১০০টি বই ও লেখকের নাম এবং গ্রন্থসমূহের সংক্ষিপ্তসার পাঠ করেও ক্রিকেট নিয়ে লেখা একটি বইও পেলাম না। পেলাম না মানে পেলামই না। নো বুক অন ক্রিকেট।

রেসলিং, ফুটবল, বেসবল, বাস্কেটবল, হকি, জিমন্যাস্টিকস, অ্যাথলেটিকস—সব বিষয়ভিত্তিক বইয়ের খবর পেলাম। ওই সব বইয়ের অনেকগুলোই বেস্ট সেলার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিচারে। জানলাম, বেশ কিছু ছবিও নাকি নির্মিত হয়েছে ওই গ্রন্থগুলো নিয়ে।

কিন্তু ক্রিকেট নৈব নৈব চ। একটি বইও পেলাম না ক্রিকেট নিয়ে লেখা।

প্রশ্ন জাগল মনে, ২০০ কোটি মানুষের প্রিয় খেলা ক্রিকেটকে বাদ দিয়ে ক্রীড়াবিশ্ব পূর্ণতা পায় কীভাবে?

হায় ক্রিকেট–সাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাস। হায় মাইক ব্রিয়ারলি, হায় রামচন্দ্র গুহ, হায় নির্মলেন্দু গুণ, ক্রিকেট নিয়ে লেখা আপনাদের বইগুলোর একটিও আটলান্টিকের ওপারে পৌঁছেনি? গুগল স্যার তো এমনটিই জানালেন।

ক্রিকেট নিয়ে রচিত গ্রন্থের কিছু গ্রন্থ কি সর্বকালের সেরা ক্রীড়াগ্রন্থের তালিকায় স্থান পেতে পারত না? ক্রিকেট খেলাটি কি স্পোর্টসের বাইরের কিছু?

বলি, ক্রিকেটের মতো দীর্ঘ সময় ধরে দর্শকদের আনন্দ ও উত্তেজনায় মাতিয়ে রাখার মতো খেলা, ক্রিকেট ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কোন খেলাটা আছে?

ক্রিকেটই তো একমাত্র খেলা, যে খেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি খেলোয়াড়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার রেকর্ড সযতনে সংরক্ষিত হয়।