ভুল আম্পায়ারিংয়ে ভরা এক বিশ্বকাপ

আফগানিস্তানের বিপক্ষে লিটন দাসের ক্যাচটি নিয়েও আছে প্রশ্ন। ছবি: টু্ইটার
আফগানিস্তানের বিপক্ষে লিটন দাসের ক্যাচটি নিয়েও আছে প্রশ্ন। ছবি: টু্ইটার
>

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এবার ভুলের পর ভুল করছেন আম্পায়াররা। কাল পাকিস্তান-আফগানিস্তান ম্যাচেও ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন মাঠের আম্পায়ার

মাঠে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত—ক্রিকেটের প্রচলিত আপ্তবাক্য। কথাটা এখন বেশ হাস্যকরই মনে হচ্ছে। মাঠে আম্পায়াররা তাঁদের মতো করেই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। ক্রিকেটাররা তা মানতে না পারলে নিচ্ছেন রিভিউ। মাঠের সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা ঠিক করছেন টিভি আম্পায়ার। আর টিভি কিংবা থার্ড আম্পায়ারও ভুল করছেন নিয়মিতই। যে আম্পায়ারিং নিয়ে একসময় কথা উঠত খুব কমই, এখন খেলার সেই বিচারকার্যই প্রশ্নের মুখে। এবার ক্রিকেট বিশ্বকাপের আম্পায়াররা তো বলতে গেলে অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছেন। সহজ কথায়, ভুলের চূড়ান্ত করে ছাড়ছেন!

কাল আফগানিস্তান-পাকিস্তান ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। হারিস সোহেল জীবন পেয়েছেন আম্পায়ারের ভুলে। সে ওভারে আম্পায়ার ছিলেন নাইজল লং। হারিসের ব্যাটে লেগে বল জমা পড়েছে উইকেটকিপারের গ্লাভসে কিন্তু লং আউট দেননি। এরপর পাকিস্তানকে ম্যাচ জেতানো ইমাদ ওয়াসিম ১ রানে থাকতেও জীবন পেয়েছেন আম্পায়ারের ভুলে। রশিদ খানের বল ইমাদের প্যাডে লেগেছিল। আফগানরা জোরালো আবেদন করলেও আম্পায়ার পল উইলসন সাড়া দেননি। পরে টিভি রিপ্লেতে দেখা গেছে ওটা নিশ্চিত আউট ছিল। রিভিউ না থাকায় আফগানরাও উইলসনের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারেনি।

আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে তাই কালও প্রশ্ন উঠেছে। আর টুইটারে তা তুলেছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক আকাশ চোপড়া, ‘আম্পায়ারিং ও নেতৃত্বের মান আজ প্রশ্নের মুখে...।’ সে ক্ষেত্রে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একই প্রশ্ন তুলতে মুখিয়ে থাকার কথা! গত বৃহস্পতিবার ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যায়—সে ম্যাচ পর্যন্ত আম্পায়ারদের নয়টি ভুল সিদ্ধান্ত সফলভাবে ঠিক করতে পেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর বাকি দলগুলো মিলে রিভিউ নিয়ে ঠিক করেছে ১৪টি ভুল সিদ্ধান্ত। ভাবা যায়!

ইমাদ ওয়াসিম পরিষ্কার লেগ বিফোর হলেও মাঠের আম্পায়ার সাড়া দেননি। ছবি: টুইটার
ইমাদ ওয়াসিম পরিষ্কার লেগ বিফোর হলেও মাঠের আম্পায়ার সাড়া দেননি। ছবি: টুইটার

এবার বিশ্বকাপ শুরুর দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তো আম্পায়ার ক্রিস গ্যাফানি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ক্রিস গেইলের ইনিংসে তাঁর বিপক্ষে তিন-তিনবার আঙুল তুলেছিলেন গ্যাফানি। দুবার বেঁচেছেন রিভিউ নিয়ে। তৃতীয়বারে দুর্ভাগ্য। রিভিউ নিলেও ‘আম্পায়ারস কল’ তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। মজাটা সবাই পায় একটু পর। টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল, গেইল যে বলে আউট হয়েছেন, সেটি করার আগে মিচেল স্টার্ক করেছেন বিশাল এক নো বল। ক্রিজের অনেক বাইরে পা ফেললেও গ্যাফানির চোখ এড়িয়ে গেছে তা।

পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে মাঠের আম্পায়ার ছিলেন কুমার ধর্মসেনা ও জোয়েল উইলসন। পাকিস্তানের ইনিংসে ১৪তম ওভারে ৭ বলে ওভার দিয়েছেন দুই আম্পায়ার। মাঠের দুই আম্পায়ারই বলের হিসেব রাখতে ভুল করেন। ভাগ্য ভালো, ওই ওভারের সপ্তম বলে কোনো রান হয়নি কিংবা উইকেট পড়েনি। না হলে বিতর্ক আরও বাড়ত। ওই ম্যাচেই বিতর্কের খোরাক জুগিয়েছে সফট সিগন্যাল। ক্রিস মরিসের বলে ডিপ মিড উইকেটে ইমরান তাহিরকে ক্যাচ দেন হারিস সোহেল। তাহির একপ্রকার নিশ্চিতই ছিলেন, ক্যাচটা যথার্থভাবে ধরেছেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠানোর আগে মাঠের আম্পায়ার সফট সিগন্যাল দিলেন নট আউট। বারবার রিপ্লে দেখেও নিশ্চিত হতে পারেননি থার্ড আম্পায়ার। ফলে মাঠের আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেই নট আউট দেওয়া হয় হারিসকে।

আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক আছে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচেও। মুজিব উর রেহমানের বলে লিটন দাসের ক্যাচ এখনো ক্রিকেটপ্রেমীদের যুক্তিতর্কের খোরাক। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠানোর আগে মাঠের আম্পায়ার সফট সিগন্যাল দিয়েছিলেন আউট। কিন্তু বারবার রিপ্লে দেখেও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না টিভি আম্পায়ার আলিম দার। শেষ পর্যন্ত মাঠের আম্পায়ারের সফট সিগন্যালের ওপর ভিত্তি করে লিটনকে আউট ঘোষণা করেন আলিম দার। তবে সিদ্ধান্তটি নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। টিভি রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, ক্যাচটা তালুবন্দীর সময় বল কিছু সময়ের জন্য মাটি ছুঁয়েছিল।

গেইলকে আউট করার আগে বিশাল নো বল করেন স্টার্ক। কিন্তু তা আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে যায়। ছবি: টুইটার
গেইলকে আউট করার আগে বিশাল নো বল করেন স্টার্ক। কিন্তু তা আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে যায়। ছবি: টুইটার

গত বৃহস্পতিবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত ম্যাচে রোহিত শর্মার আউটের সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ। কেমার রোচের শিকার হয়ে ফিরে যান রোহিত। মাঠের আম্পায়ারের নট আউটের সিদ্ধান্ত থার্ড আম্পায়ারের কাছে গিয়ে বদলে যায়। ইনসাইড এজের আবেদন করেছিল ক্যারিবীয়রা। মাঠের ইংলিশ আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ আবেদনটি সরাসরি নাকচ করে দেন। কিন্তু থার্ড আম্পায়ার মাইকেল গফ বল যখন ব্যাট পার হয়, তখন স্নিকো মিটারে স্পাইক দেখে সেটাকে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়ে আউটের সিদ্ধান্ত নেন। তবে বলটি ব্যাট এবং প্যাডের মাঝ দিয়ে একই সময়ে পার হওয়ায় স্পাইকগুলো আসলে ব্যাটের নাকি প্যাডের, তা নিশ্চিত হওয়া ছিল বেশ কঠিন। আর আম্পায়ার গফ আউট নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তটি খুব দ্রুত জানিয়ে দেওয়াতে বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা।

ক্রিকেটমোদীরা কিন্তু চুপ করে থাকেননি। রোহিতের আউটের প্রতিশোধ নিতে উইকিপিডিয়ায় মাইকেল গফের পেজের কিছু কথা পাল্টে দিয়েছেন অজানা এক বা একাধিক ক্রিকেটপ্রেমী। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘...রোহিতকে মাঠের আম্পায়ার নট আউট ঘোষণা করলেও অকাট্য প্রমাণ ছাড়া সিদ্ধান্তটি পাল্টে তিনি তোপের মুখে পড়েন। সন্দেহ ছিল, তিনি ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার পথ করতে তাদের দিকে টেনেছেন।’

আসলে ক্রিকেটপ্রেমীদের এই প্রতিশোধপ্রবণ মানসিকতা হওয়ার পেছনে আম্পায়ারদের অবদান কিন্তু কম নয়। ভুলের পর ভুল সিদ্ধান্তে ম্যাচের ফল পাল্টে গেলে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনও পাল্টে যায়। এবার বিশ্বকাপে আম্পায়াররা যে পরিমাণ ভুল করছেন, তাতে আরও কী কী ঘটে কে জানে!