রোহিতকে চাহাল দিয়ে যোগ করলে এক সাকিব হয়!

সাকিব আল হাসান, একাই দুজন! ছবি: প্রথম আলো
সাকিব আল হাসান, একাই দুজন! ছবি: প্রথম আলো
এক সাকিব আল হাসান আসলে কতটা? যদি বলা হয়, সাকিব সমান-সমান রোহিত শর্মা যোগ যুজবেন্দ্র চাহাল? কথাটা বাড়িয়ে বলা হয় না এক রত্তিও। এই বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে রোহিত আর বল হাতে চাহালের সমান অর্জন একা সাকিবের।

বাংলাদেশের যদি একজন ডেভিড ওয়ার্নার থাকত কিংবা একজন কেন উইলিয়ামসন! ভারতের আছে রোহিত শর্মা, ইংল্যান্ডের জো রুট। বাংলাদেশেরও যদি এমন কেউ থাকত—এমন আফসোস কি আমরা কম করেছি? এ তো গেল শুধু ব্যাটিংয়ের কথা। বোলিংয়েও একজন প্যাট কামিন্স, একজন ট্রেন্ট বোল্ট, একজন মার্ক উড কিংবা একজন যুজবেন্দ্র চাহালের মতো বোলারের আফসোস কি আমরা করি না? মাঝের ওভারে কিংবা ইনিংসের শুরুতেই যাঁরা উইকেট এনে দেবেন। আমাদের এমন কেউ নেই।

কিন্তু আমাদের আছেন একজন সাকিব আল হাসান। একজন সুপারম্যান। ব্যাট হাতে যিনি ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়ার্নার, রোহিতদের টেক্কা দিয়ে গেছেন। বল হাতে টেক্কা দিয়েছেন কামিন্স, বোল্ট, উড ও চাহালদের। এর সঙ্গে যোগ করুন তাঁর ফিল্ডিং আর নেতৃত্বগুণ। বাংলাদেশের টেস্ট ও টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক যে ওয়ানডেতে মাশরাফিকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাহায্য করেন, সেটা সম্ভবত অন্য যেকোনো দলের সহ–অধিনায়ক থেকেই অনেক বেশি।

বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের সম্ভাবনা আছে—এমন দলগুলোর সেরা ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটেছেন সাকিব আল হাসান। সেই লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর থেকে চুল ব্যবধানে এগিয়ে আছেন শুধুই রোহিত শর্মা। সাকিবের সমান ৭ ম্যাচ খেলে রোহিত শর্মার সংগ্রহ ৫৪৪ রান। সাকিব করেছেন ৫৪২ রান। এক ম্যাচ বেশি খেলেও ডেভিড ওয়ার্নার করেছেন ৫১৬ রান। নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন তাঁর দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। গতকালের ম্যাচের আগ পর্যন্ত সাকিবের সমানসংখ্যক ম্যাচে তিনি করেছেন ৪৫৪ রান। ইংল্যান্ড দলের সেরা ব্যাটসম্যান জো রুট গতকালের ম্যাচের আগ পর্যন্ত এক ম্যাচ বেশি খেলেও করেছেন ৪৭৬ রান। সেমিফাইনালের সম্ভাবনা টিমটিম করে জ্বলছে আরেক দল পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজমের রান ৩৭৮। অনেক পিছিয়ে থাকলেও সাকিবের সমান ইনিংস খেলেছেন তিনি। গড়ে উইলিয়ামসন কিছুটা এগিয়ে দুবার নটআউট থাকার সুবাদে। রোহিত শর্মা এগিয়ে আছেন মাত্র ০.৩৩ রানে। স্ট্রাইক রেটে আবার তাঁদের সবাইকে ছাড়িয়ে সাকিবই এগিয়ে আছেন।

এবার দেখা যাক বোলারদের পরিসংখ্যান। বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ট্রেন্ট বোল্ট, ইংল্যান্ডের হয়ে মার্ক উড, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্যাট কামিন্স, ভারতের পক্ষে যুজবেন্দ্র চাহাল ও পাকিস্তানের পক্ষে ওয়াহাব রিয়াজরা নিজ নিজ দেশের হয়ে দুর্দান্ত খেলছেন। বল হাতেও সাকিব তাঁদের কারও থেকে পিছিয়ে নেই। ৭ ইনিংসে সাকিব ৩১.০৯ গড়ে নিয়েছেন ১১ উইকেট। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৫.৩৪। গতকালের ম্যাচের আগে নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট ৭ ম্যাচে ২৪.১৫ গড়ে উইকেট পেয়েছেন ১৩টি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের মার্ক উড ২৫.৭৬ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ১৩টি। ভারতের যুজবেন্দ্র চাহাল ৩৪.৪৫ গড়ে সাকিবের সমান ১১ উইকেট পেয়েছেন। আর মিচেল স্টার্ককে যোগ্য সাহচর্য দিয়ে আসা অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্স এক ম্যাচ বেশি খেলে ২৭.২৫ গড়ে নিয়েছেন ১২ উইকেট। পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ ৭ ম্যাচে ৩৬.৭০ গড়ে নিয়েছেন ১০ উইকেট। শুধু প্যাট কামিন্স ও ট্রেন্ট বোল্টের ইকোনমি সাকিবের থেকে কম। খেলাটা হচ্ছে ইংল্যান্ডে আর বাংলাদেশের বোলিং শক্তি বিবেচনায় রাখলে বল হাতেও সাকিব ছিলেন অসাধারণ।

মনে হতে পারে অলরাউন্ডারদের কাজই এটা। কোনো একটা বিশ্বকাপে ব্যাটে–বলে ভালো হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের স্মরণীয় কিছু অলরাউন্ড নৈপুণ্যের সঙ্গে সাকিবের এবারের পারফরম্যান্সকে তুলনা করলে সেটা আরও অসাধারণ মনে হবে। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে কপিল দেব, ১৯৮৭ বিশ্বকাপে স্টিভ ওয়াহ, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সনৎ জয়াসুরিয়া, ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ল্যান্স ক্লুজনার আর ২০১১ বিশ্বকাপে যুবরাজ সিংয়ের অলরাউন্ড নৈপুণ্য এখনো ক্রিকেট রূপকথার অংশ। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া কপিল দেব ৮ ম্যাচে ৬০.৬০ গড়ে করেছিলেন ৩০৩ রান। বল হাতে ২০.৪১ গড়ে উইকেট নিয়েছিলেন ১২টি।

১৯৮৭ বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ৫৫.৬৬ গড়ে স্টিভ ওয়াহ করেছিলেন ১৬৭ রান আর ২৬.১৮ গড়ে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সনৎ জয়াসুরিয়া ব্যাটে–বলে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন। ৬ ম্যাচে জয়াসুরিয়া ৩৬.৮৩ গড়ে করেছিলেন ২২১ রান আর ৩৩.০০ গড়ে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ল্যান্স ক্লুজনার স্বপ্নের এক টুর্নামেন্ট কাটিয়েছিলেন। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাগুলে দৌড় ছাড়া ক্লুজনারের বিশ্বকাপটা ছিল নিখুঁত। ৯ ম্যাচে ১৪০.৫০ গড়ে ক্লুজনার করেছিলেন ২৮১ রান আর ২০.৫৮ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট। ২০১১ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়া যুবরাজ সিং ৯ ম্যাচে ৯০.৫০ গড়ে করেছিলেন ৩৬২ রান ও ২৫.১৩ গড়ে নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট। অথচ সাকিবের ৫৪২ রান ও ১১ উইকেটের পাশে এই সব মহারথীর পরিসংখ্যান কত ম্লান লাগছে।

তবে পরিসংখ্যান পুরো সত্যটা তুলে ধরতে পারে না। জয়াসুরিয়া ছাড়া বাকি সব অলরাউন্ডারই নামতেন ম্যাচের শেষ ভাগে। জয়াসুরিয়া খেলেছেন ওপেনার হিসেবে আর যুবরাজ মিডল অর্ডারে। সেখানে সাকিব খেলছেন টপ অর্ডারে। আবার একমাত্র কপিল দেব ছাড়া আর কোনো বোলারই দলের মূল বোলার ছিলেন না। স্টিভ ওয়াহ আর ক্লুজনার ছিলেন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বোলার। আর জয়াসুরিয়া আর যুবরাজ পঞ্চম ও ষষ্ঠ বোলারের কোটা পূরণ করেছেন। সাকিবই একমাত্র বোলার, যাঁকে দলের মূল ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি দলের মূল বোলারের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে। ক্রিকেট মানসিক খেলা। দুই বিভাগেই এত দায়িত্ব নিয়ে খেলা ক্রিকেটার ক্রিকেট ইতিহাসেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্তত আধুনিক ক্রিকেটে তো নয়ই। এ কারণেই সাকিব আল হাসান অনন্য। সেমিফাইনালের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও সাকিব এই স্বপ্নযাত্রায় তুলির শেষ আঁচড়টা ঠিকমতো দিয়ে আসবেন, আগামীকালের ম্যাচে এটাই প্রত্যাশা।

২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

৫৪২

১২৪*

৯০.৩৩

৯৭.৮৩

/

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

৬৪.

১১

/২৯

৩১.০৯

.৩৪

দুজন মিলে সাকিবের সমান

ভারত

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

রোহিত শর্মা

৫৪৪

১৪০

৯০.৬৬

৯৬.৯৬

/

 

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

 যুজবেন্দ্র চাহাল

৬৪.

১১

/৫১

৩৪.৪৫

.৯২

অস্ট্রেলিয়া

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

ডেভিড ওয়ার্নার

৫১৬

১৬৬

৭৩.৭১

৮৬.৫৭

/

 

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

প্যাট কামিন্স

৭০.

১২

/৩৩

২৭.২৫

.৬৬

ইংল্যান্ড

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

জো রুট

৪৭৬

১০৭

৬৮.০০

৯১.৫৩

/

 

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

মার্ক উড

৬১.

১৩

/১৮

২৫.৭৬

.৪৩

নিউজিল্যান্ড

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

কেন উইলিয়ামসন

৪৫৪

১৪৮

১১৩.৫০

৭৭.৮৭

/

 

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

ট্রেন্ট বোল্ট

৬৯.

১৩

/৩০

২৪.১৫

.৫৫

পাকিস্তান

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

স্ট্রাইক রেট

১০০/৫০

বাবর আজম

৩৭৮

১০১*

৬৩.০০

৮৫.৫২

/

 

ওভার

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

ওয়াহাব রিয়াজ

৫৯.

১০

/৪৬

৩৬.৭০

.১৫