আক্ষেপ নিয়েই শেষ বিশ্বকাপ

মোস্তাফিজ ও সাকিবের এই আক্ষেপ তো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সেরই প্রতিচ্ছবি। ছবি: প্রথম আলো
মোস্তাফিজ ও সাকিবের এই আক্ষেপ তো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সেরই প্রতিচ্ছবি। ছবি: প্রথম আলো
গ্যালারিতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শকদের ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিৎকার দিন শেষে আর লর্ডসের আকাশ কাঁপায়নি। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের বিষাদ আগেই ছেয়েছে। কাল আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার শেষ ম্যাচে হতাশার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরলেন সবাই। আক্ষেপ নিয়েই শেষ হলো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ।

প্রেসবক্সের লাউড স্পিকারে ঘোষণা এল, পাকিস্তানকে সেমিফাইনালে যেতে হলে বাংলাদেশকে ৭ রানের মধ্যে অলআউট করতে হবে। শুনে হেসে উঠলেন সবাই। এটাও কি সম্ভব!

বাংলাদেশ বা পাকিস্তান, লর্ডসে কারোরই কাল বড় কিছু পাওয়ার ছিল না। বাংলাদেশ জিতলেও সেমিফাইনালে যাবে না। পাকিস্তানের পক্ষে সূক্ষ্ম অঙ্কের হিসাব ছিল। সেটি কতটা অসম্ভব, তা ওই ঘোষণাতেই পরিষ্কার। তবু শেষ ম্যাচে জয় বাংলাদেশকে রাখতে পারত পয়েন্ট তালিকার পঞ্চমে। এক বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বোচ্চ জয় নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন ক্রিকেটাররা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে জয়টা হতে পারত মনে রাখার মতো এক স্মারক।

কিছুই হয়নি শেষ পর্যন্ত। গ্যালারিতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শকদের ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিৎকার দিন শেষে আর লর্ডসের আকাশ কাঁপায়নি। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের বিষাদ আগেই ছেয়েছে। কাল আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার শেষ ম্যাচে হতাশার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরলেন সবাই। আক্ষেপ নিয়েই শেষ হলো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ।

৩১৫ রান করে পাকিস্তানের জয় ৯৪ রানের। তারাও এখন দেশে ফেরার বিমানে ওঠার অপেক্ষায়। বাংলাদেশকে যে ৭ রানের মধ্যে অলআউট করে দেওয়া যায়নি! তবু তাদের প্রাপ্তি, টুর্নামেন্টের শুরুটা ভালো না করেও প্রায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা। ইমাম-উল-হকের সেঞ্চুরি, বাবর আজমের ৯৬ পাকিস্তানের সবুজ দর্শকদের মুখরিত রেখেছে সারা দিন। মুশফিকুর রহিমের হাত থেকে বাবরের ফিরে পাওয়া জীবনের সুবাদে পাকিস্তানের ১৫৭ রানের জুটিটাকেই বাংলাদেশের হারের বড় কারণ বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় উইকেটে ওই জুটির পর মাত্র ১৩৪ রানে পড়েছে শেষ ৮ উইকেট। মোস্তাফিজুর রহমান আরও একবার ভাসলেন ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দে। লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠালেন তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে।

৩১৫ রান টপকানোর মতো ব্যাটিং অর্ডার বাংলাদেশের ছিল। এই বিশ্বকাপেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩২১ রান তাড়া করে জেতার গৌরব আছে দলটার। অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের জবাবে করেছে ৩৩৩। তাহলে ৩১৬ হবে না কেন?

হয়নি কারণ, বিশ্বকাপে কাল দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের ব্যাটিংটা কোনো দিক দিয়েই ভালো হলো না। ১৯ বছর বয়সী এক বাঁহাতি পেসার শাহিন শাহর সামনেই কেঁপে অস্থির বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা! নতুন স্পেলে আসেন আর উইকেট নেন। এই করে ৩৫ রানে ৬ উইকেট শাহিনের। ওয়ানডেতেই এটি তাঁর প্রথম ৫ উইকেট, বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেরা বোলিংও। জয়ের কাছে গিয়েও হেরে যাওয়া নিউজিল্যান্ড ম্যাচের ব্যাটিংও ছিল হতাশাজনক। তবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের কাছে হারলেও ব্যাটিংয়ে ফিরে আসার প্রত্যয় ছিল, যেটি কাল ছিল একেবারেই অনুপস্থিত।

সাকিব আল হাসান যথারীতি আপন আলোয় আলোকিত। শেষ দুই ম্যাচে ৫টি করে উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ সামনে এগিয়ে এসেছেন। নইলে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপটা যেন একাই খেললেন সাকিব! প্রথম দুই ম্যাচে ফিফটি। পরের দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি। এরপর ৪১, ৫১, ৬৬। কাল আবার ৬৪। মধ্যে বল হাতে ৫ উইকেট নিলেন আফগানিস্তানের সঙ্গে। এই হলো সাকিবের এবারের বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্ট থেকে যে ৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ দলের আজ রাতে দেশের বিমানে ওঠার কথা, তার ছয়-সাড়ে ছয় পয়েন্ট সাকিব একাই দাবি করতে পারেন। এই বিশ্বকাপের কাছে আরেকটা দাবিও আছে এই অলরাউন্ডারের। ৬০৬ রান করে কাল আবার সবচেয়ে বেশি রান করাদের তালিকার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন নিজেকে। সঙ্গে একটি ৫ উইকেটসহ ১১ উইকেট। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে গেলে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার দাবিটা নিশ্চিতভাবেই আরও জোর গলায় জানাতে পারতেন তিনি।

টস জিতে পাকিস্তানের বড় সংগ্রহে সিংহভাগ অবদান দুই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ইমাম-উল-হক ও বাবর আজমের। বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার দিকে ভালোভাবেই এগোচ্ছিলেন দুবার জীবন পাওয়া বাবর। তবে তাঁকে ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরিবঞ্চিত করেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। দারুণ এক ইয়র্কারে এলবিডব্লিউ করেছেন এ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান বাবরকে। তবে সেঞ্চুরি না পেলেও দারুণ একটি অর্জন হয়েছে বাবরের। জাভেদ মিয়াঁদাদকে পেছনে ফেলে পাকিস্তানের হয়ে এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান এখন বাবরের। এর আগে ১৯৯২ বিশ্বকাপে ৪৩৭ রান করেছিলেন মিয়াঁদাদ। বাবর থেমেছেন ৪৭৪ রানে।

বাবর না পারলেও বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি ঠিকই তুলে নিয়েছেন ইমাম। রেকর্ড হয়েছে ইমামেরও। ক্রিকেট বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম বয়সী পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ড এখন ইমামের। তবে ৯৯ বলে সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর পরের বলেই আউট হয়েছেন ইমাম। সেটিও কীভাবে! মোস্তাফিজুর রহমানের বলে পিছু সরে খেলতে গিয়ে তাঁর পা লেগে গেছে স্টাম্পে। শেষ দিকে ২৬ বলে ৪৩ করে পাকিস্তানকে ৩০০ পার করিয়েছেন ইমাদ ওয়াসিম।

পাকিস্তানকে এ রান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের ‘অবদান’ ছিল ভীষণ দৃষ্টিকটু। এক মেহেদী হাসান মিরাজ বাদে প্রত্যেক বোলারই ছিলেন ভীষণ খরুচে। বেশির ভাগেরই ইকোনমি সাড়ে ৬-এর বেশি। ফিল্ডাররাও যেন আজ মাঠে থেকেও ছিলেন না। এক বাবর আজমের ক্যাচই পরপর দুই ওভারে ফেলেছেন মোসাদ্দেক-মুশফিক। প্রথমবারে বাবরের রান ছিল ৫৭, দ্বিতীয় ক্যাচের সময় ৬৫।

তাড়া করতে নেমে আরও একবার হতাশ করেছেন তামিম। আসলে এই বিশ্বকাপই সবচেয়ে বেশি হতাশায় কাটালেন তামিম ইকবাল। ভাগ্য তো সহায় ছিলই না, ফুটওয়ার্ক বিভ্রাটও তাঁকে করতে দেয়নি তাঁর ব্যাটিংটা। তিন ম্যাচে প্লেড অন হয়েছেন, কাল সরাসরি বোল্ড। আফ্রিদির স্লোয়ারে ড্রাইভ খেলতে গিয়েছিলেন ব্যাট আর পায়ের মধ্যে অনেক জায়গা রেখে। সৌম্য সরকার কখন আউট হবেন, সেটি এখন আগেই বলে দেওয়া যাচ্ছে। কিছু আত্মবিশ্বাসী শট খেলে উইকেটে থিতু হবেন। এরপর সেই আত্মবিশ্বাস তাঁকে আরও বেশি শট খেলতে অনুপ্রাণিত করবে, ডাউন দ্য উইকেটে আসা শুরু করবেন এবং একপর্যায়ে ক্যাচ তুলে দেবেন। মোহাম্মদ আমিরের বলে কালও পয়েন্টে তা–ই দিলেন ফখর জামানের হাতে। মুশফিকুর রহিম অনেকটা তামিমের আগের আউটগুলোর মতোই আউট হলেন। ওয়াহাব রিয়াজের বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট চালিয়ে প্লেড অন।

৭৮ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর সাকিব-লিটনের কাছে আশা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচের মতো কালও কিছু করবেন। কিন্তু লিটনের আউটে জুটি ভাঙল মাত্র ৫৮ রানে। এরপর আসলে ম্যাচটা থেকে বাংলাদেশের পাওয়ার আর কিছুই ছিল না। বিশ্বকাপের শুরুতে পাওয়া সাফল্য আর শেষ দিকের ব্যর্থতার ভাগফল হয়ে থাকল শুধুই হতাশা। কিছু দুর্দান্ত ছয়, কিছু ব্যক্তিগত সাফল্যের আলোয় হয়তো এবারের বিশ্বকাপটা মানুষের মনে থাকবে অনেক দিন। কিন্তু সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে এসে প্রাপ্তি তো শেষ পর্যন্ত তিনটি মাত্র জয়ই!