ফুটবল নগরে এ কোন ধোনি-কোহলি!

ভারতের অনুশীলনে ফুটবলেও মজেছেন ধোনি। ছবি: রয়টার্স
ভারতের অনুশীলনে ফুটবলেও মজেছেন ধোনি। ছবি: রয়টার্স

ফুটবলটা তাঁর দিকেই আসছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি লোভ সামলাতে পারলেন না। হাতে থাকা কিট ব্যাগ ছেড়ে প্যাড পরা পায়েই দৌড়ে গিয়ে মারলেন এক কিক। ওল্ড ট্রাফোর্ড ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এরপর কিছুক্ষণ চলল ভারতীয় ক্রিকেট তারকার ফুটবল কারিকুরি। ক্রিকেট মাঠ থেকে খুব বেশি দূরে নয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব। সেখান থেকে উড়ে আসা হাওয়াই কি ছুঁয়ে গেল ধোনিকে!

বিশ্বকাপ ক্রিকেট সেমিফাইনালের আগে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিকেও কাল একটু অন্য ‘মুডে’ পাওয়া গেল। হাসি-খুশি এক মানুষ। রসিকতার জবাবে পাল্টা রসিকতার রসদে টইটম্বুর। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্বটা যেন বেশ ঘুচেই গেল ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মহা তারকার।

কোহলির সংবাদ সম্মেলনে ছিল উপচে পড়া ভিড়। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন যাকে বলে! ভারতের দু-একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকও দেখা গেল ভেতরে জায়গা পাননি। তবে সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রেসবক্সের লিফট পর্যন্ত অধিনায়কের পিছু নিলেন তাঁরা। ডাক শুনে কোহলি পেছন ফিরে তাকান, কারও কাঁধে হাত রাখেন, হাসতে হাসতে কথা বলেন। একজন জার্সি বাড়িয়ে দিলে অটোগ্রাফ লিখে দিলেন হাসিমুখে। নিরাপত্তাকর্মীরা যাঁদের আটকে দিচ্ছিলেন, ভারত অধিনায়ক কাছে ডেকে নেন তাঁদেরও। সেলফি তুলতে তুলতে দু-চার বাক্য বলেছেন। ‘কোহলি তো আমাদেরই মানুষ’—সবার মধ্যেই এমন একটা তৃপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে ভারত অধিনায়ক ঢুকে পড়েন লিফটে।

একটু আগে শেষ হওয়া সংবাদ সম্মেলনেও সেমিফাইনাল-পূর্ব ভাবগাম্ভীর্য ছিল অনুপস্থিত। ওল্ড ট্রাফোর্ডে আজকের ম্যাচের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড বলেই কি! হতে পারে। অথবা কোহলির হাসিমুখই হালকা করে দিয়েছে পরিবেশটাকে। তাঁকে যখন মনে করিয়ে দেওয়া হলো, ১১ বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কেন উইলিয়ামসের নেতৃত্বাধীন নিউজিল্যান্ড হেরেছিল কোহলির ভারতের কাছে, অধিনায়ক হেসে ওঠেন। ‘কেনের উইকেটটা সেবার আপনিই তো পেয়েছিলেন মনে হয়’, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে হেসে রসিকতা, ‘পেয়েছিলাম নাকি! পেলেও জানি না এবার পাব কি না।’

মূল স্টেডিয়ামের পাশের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করছিলেন ধোনি। শেষ করে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথে যথারীতি তাঁর পিছু পিছু সাংবাদিক সমাজের একাংশ। সেটি দেখে মাঠ থেকে এক সতীর্থের রসিকতা, ‘পুরি মিডিয়া কো সাথ লে আয়া!’ ধোনি কিছু বলার আগেই ফুটবলটা গড়াতে গড়াতে চলে এল তার কাছে। এরপরের তো তিনি পুরোই অন্য মানুষ।

ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্য থেকে কে একজন নিমন্ত্রণ জানালেন কলকাতায় গেলে বিরিয়ানি খাওয়াবেন। ধোনির পাল্টা-নিমন্ত্রণ, ‘কলকাতা এলে তো আমিই আপনাকে বিরিয়ানি খাওয়াতে পারি!’ এখানেও চলল অটোগ্রাফ দেওয়া আর ছবি তোলার পর্ব। ধোনির মুখে চওড়া হাসি। যেন এ কাজ করতেই এসেছেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার সময় একজন আবার ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ‘কাল তো ৭৫ রান করবেন। ছয়টি ছক্কা হবে, চারটি যাবে ওদিক দিয়ে।’ ধোনি আবার হাসেন। তবে দৃষ্টিটা ওই সাংবাদিক হাতের ইশারায় যেদিকটা দেখালেন, সেদিকে।

কিন্তু এরাই যদি ধোনি-কোহলি হবেন, তবে তাঁরা কারা ছিলেন? তারকাখ্যাতির কারণেই বলুন, আনুশকার স্বামী হিসেবে বা সময়ে সময়ে কাঠখোট্টা কথার কারণেই হোক, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে একটা দূরত্ব তো আছেই কোহলির। এ বছরের শুরুতে যেমন ধোনির সমালোচনায় মেতে ওঠা সংবাদমাধ্যমকে কড়া জবাব দিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক।

কিন্তু কাল যেন সবকিছুকেই ইতিবাচকভাবে নেবেন বলে ঠিক করে এসেছিলেন। লিডস থেকে ম্যানচেস্টারে আসার পরিকল্পনায় শেষ দিকে একটু এদিক-সেদিক হওয়াতেও তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। ম্যানচেস্টার শহরটাও নাকি এখন পর্যন্ত বেশ লাগছে। যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতি কোহলির কোনো দুর্বলতার খবর কেউ জানেন না। তাঁকে বরং দেখা গেছে লর্ডসে টটেনহাম তারকা হ্যারি কেনের সঙ্গে ছবি তুলতে। এতে কেউ কোহলিকে টটেনহামের সমর্থক ভাবলে সেটিও ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এর আগে ২০১৪ সালে চেলসির মাঠ দেখতে গিয়ে ক্লাবটির নীল জার্সি হাতেও তিনি ছুবি তুলেছিলেন। সেটির প্রতিদান দিতেই কি না চেলসির ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজ এবারের বিশ্বকাপে বলে-কয়ে ভারতের সমর্থক।

ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ছবি: রয়টার্স
ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ছবি: রয়টার্স

বিরাট কোহলি ইউনাইটেডের সমর্থক হয়ে থাকলে সেটি এখানে বড় শিরোনাম হতেই পারে। আর কোহলি এখন যে রকম হালকা ‘মুডে’, নিরাপত্তার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যেতে পারলে ফুটবল প্রসঙ্গে কথা বলতে আপত্তি করবেন না নিশ্চয়ই।

ধোনিকেও অন্তত কাল অনেকটাই মিডিয়া-দরদি মনে হলো। অথচ তাঁর মিডিয়া-বিদ্বেষের জুড়ি ছিল না একসময়। যখন অধিনায়ক ছিলেন, সংবাদ সম্মেলনে বাঁকা-ত্যাড়া উত্তর দেওয়া ছাড়া সোজা কথা কমই বলতেন। কাউকে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, মাঠে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেছেন, সে রকম দৃষ্টান্তও তাঁর খুব একটা নেই। মাথা গরম করে কখনোসখনো আক্রমণাত্মক হয়েছেন ভক্ত-সমর্থকদের প্রতি। সেই ধোনি, সেই কোহলি এতটাই বদলে গেলেন বিশ্বকাপে!

অধিনায়ককে অপ্রিয় অনেক কিছুই হাসিমুখে করতে হয়। আর এটা তো বিশ্বকাপ! কোহলির চেয়ে তাই ধোনির পরিবর্তনটাই বেশি বিস্ময়কর, যিনি অধিনায়ক থাকার সময়ও কথায় আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়াতেন। সেই ধোনি এতটা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে মিডিয়াকে! হতে পারে বয়সের ডাক। এই বিশ্বকাপেই তো ৩৮ বছরে পা দেওয়ার কেক কেটেছেন। আর কত!