১১ বছর পর...

ফেদেরার-নাদাল দ্বৈরথের আরেক অঙ্ক মঞ্চস্থ হবে আজ, উইম্বলডনে। ছবি : টুইটার
ফেদেরার-নাদাল দ্বৈরথের আরেক অঙ্ক মঞ্চস্থ হবে আজ, উইম্বলডনে। ছবি : টুইটার
>১১ বছর পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ গ্র্যান্ড স্ল্যামের আসর উইম্বলডনের সেমিফাইনাল খেলতে অল ইংল্যান্ড কোর্ট ক্লাবে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন দুই কিংবদন্তি - সুইস তারকা রজার ফেদেরার ও স্প্যানিশ তারকা রাফায়েল নাদাল। ২০০৮ সালের মহাকাব্যিক সেই ফাইনালের পর উইম্বলডনে এই প্রথম মুখোমুখি হচ্ছেন এই দুই মহারথী।

২০০৮ সাল। বছরের হিসেবে এগারো বছর আগে। বিশ্ব ক্রীড়ার অবস্থাটা কেমন ছিল তখন?

ইউরোপীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় তখন ইংলিশ ক্লাবগুলোর আধিপত্য। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে ওঠা চার দলের মধ্যে তিনটিই ইংল্যান্ডের। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের যোগ্য নেতৃত্বে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন সবার সেরা। ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের বার্সেলোনা তখন অস্তাচলে। রিয়াল মাদ্রিদ সেমিতে উঠতেই খাবি খাচ্ছিল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি’অর জেতার দ্বারপ্রান্তে, ওদিকে পেপ গার্দিওলার সান্নিধ্যে লিওনেল মেসি বিশ্বসেরা হওয়ার অপেক্ষায়। ক্রিকেটে তখন ভারত মাত্রই আইপিএল শুরু করার ধন্বন্তরি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অলিম্পিকের এক আসরে আট সোনা জেতার অনন্য রেকর্ড করেছেন সাঁতারু মাইকেল ফেলপস। ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনার পদক জিতে উসাইন বোল্টও তখন নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

টেনিসে তখন ঝাঁকড়া চুলের এক স্প্যানিশ তরুণ খুব করে চাইছেন নিজেকে নিয়ে জনমনে চলে আসা একটা ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে। টেনিসের অবিসংবাদিত রাজা তখন রজার ফেদেরার। ফেদেরারের সাম্রাজ্যে ধীরে ধীরে হানা দেওয়া শুরু করেছে ছেলেটি। মাটির কোর্টে ছেলেটাকে হারাতেই পারেন না ফেদেরার। তবে ফেদেরারের মতো সর্বজয়ী হতে শুধু মাটির কোর্ট না, অন্যান্য কোর্টেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে হবে, এটা ছেলেটা বেশ ভালোভাবেই জানে। এর আগে তিন বার মাটির কোর্টে রজার ফেদেরারকে থামিয়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতলেও, অন্যান্য গ্র্যান্ড স্ল্যাম আসলে ছেলেটার আধিপত্য যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ২০০৮ এর আগে তিন বার ফ্রেঞ্চ ওপেনে ছেলেটার কাছে ফেদেরার পাত্তা না পেলেও, উইম্বলডনের ঘাসের রাজ্যে সে হিসাব সুদে-আসলে মিটিয়ে দেন ফেদেরার।

এই অবস্থায় আসল ২০০৮ সালের উইম্বলডন গ্র্যান্ড স্ল্যাম। ফাইনালে যথারীতি সেই ছেলের মুখোমুখি রজার ফেদেরার। বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল মহাকাব্যিক এক দ্বৈরথ। টেনিসের শীর্ষ দুই তারকার দ্বৈরথ। উইম্বলডন দেখল ইতিহাসের দীর্ঘতম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। অল ইংল্যান্ড কোর্ট ক্লাবে তখন আস্তে আস্তে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের একদম শেষ অঙ্কে ফেদেরারের এক শট নেটে লাগার সঙ্গে সঙ্গে চিত হয়ে কোর্টে শুয়ে পড়ল ছেলেটা। ৪ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের সেই মহারণের পর উইম্বলডন পেল নতুন রাজাকে। ঘাসের কোর্টে টিকে থাকার জন্যও যে যোগ্যতা আছে, দেখিয়ে দিল ছেলেটা। অনেকের মতে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম টেনিস ম্যাচ ওটাই।

রাফায়েল নাদালের কথাই হচ্ছে। টানা দুই উইম্বলডনের ফাইনালে ব্যর্থ হওয়ার পর সেবারই ফেদেরারকে ঘাসের রাজ্যের একাধিপতির আসন থেকে টেনে নামান নাদাল। স্কোরলাইনটাও ছিল বাঁধাই করে রাখার মতো ; ৬-৪, ৬-৪, ৬–৭, ৬-৭, ৯-৭।

সেই শেষ। এরপর কেটে গেছে এগারো বছর। টেনিসে নাদাল-ফেদেরার দ্বৈরথের মতো ফুটবলেও মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ দেখছে বিশ্ব। আইপিএলের কল্যাণে টেস্ট-ওয়ানডেকে টপকে ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফরম্যাট এখন টি-টোয়েন্টি। টেনিসের শ্রেষ্ঠত্ব এখন শুধু নাদাল-ফেদেরারে সীমাবদ্ধ নেই, এসে গেছেন নোভাক জোকোভিচও। এর পর নাদালের ক্রমাগত উত্থান দেখে গেছে বিশ্ব, নিজের ঝুলিতে আরও ১৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম পুরেছেন নাদাল। একই সময়ে ক্যারিয়ারের গোধূলির দিকে হাঁটতে শুরু করা ফেদেরার জিতেছেন আট খানা। এই এগারো বছরে উইম্বলডনে নাদাল-ফেদেরার দ্বৈরথ দেখা যায়নি আর।

তবে, গত এগারো বছরে নাদালের জেতা ১৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে আটটিই ফ্রেঞ্চ ওপেন ও মাত্র একটি উইম্বলডন হওয়ার কারণে আবারও সেই আগের আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে। নাদাল কি শুধুই ফ্রেঞ্চ ওপেনের জন্য? অন্যান্য কোর্টে নাদালের জারিজুরি নিয়মিত কেন দেখা যায় না? নিজের জেতা মোট আঠারো গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে নাদাল ফ্রেঞ্চ ওপেনই জিতেছেন ১৩ বার, শতকরা হিসেবে ৭২.২২%। ফেদেরার পুরো ক্যারিয়ারে বিশটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেও কোনো নির্দিষ্ট গ্র্যান্ড স্ল্যামে এতটা আধিপত্য দেখাতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি জিতেছেন এই উইম্বলডনেই, আটবার। শতকরা হিসেবে ৪০%।

নিন্দুকদের মতে, ফ্রেঞ্চ ওপেন না থাকলে টেনিসের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের তালিকায় নাদালের নাম উচ্চারণই করত না কেউ! আসলেই কি তাই? সে সব নিন্দুকদের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার সুযোগ আজ আরেকবার পাচ্ছেন নাদাল। আর সেই জবাব দেওয়ার জন্য এগারো বছর পর উইম্বলডনের সেমিতে ফেদেরারের চেয়ে ভালো প্রতিপক্ষ আর কাকেই বা পেতেন তিনি!

এ পর্যন্ত ৩৯ বারের দেখায় ২৪ ম্যাচ জিতে এগিয়ে নাদাল। ১৫ বার শেষ হাসি হেসেছেন ফেদেরার। উইম্বলডনে রেকর্ড ১০০ ম্যাচ জিতেছেন ফেদেরার। এই ঐতিহাসিক টুর্নামেন্টে এটি হবে তার ১৩ তম সেমিফাইনাল। সেমির পথে জাপানি কেই নিশিকোরিকে ৪-৬, ৬-১, ৬-৪, ৬-৪ সেটে হারিয়েছেন আটবারের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন ফেদেরার। আর মার্কিন স্যাম কুয়েরি ৭-৫, ৬-২, ৬-২ সেটে পাত্তাই পাননি দুবারের চ্যাম্পিয়ন নাদালের কাছে।

নাদাল কি পারবেন আরেকবার ফেদেরারকে ঘাসের কোর্টে থামিয়ে দিয়ে ফাইনালে উঠতে? নাকি ফেদেরার ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে এসে নিজের পুরোনো ঝলক আরেকবার দেখিয়ে প্রমাণ করবেন সেই চিরাচরিত প্রবাদবাক্যটা, ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পারমানেন্ট?’

আজ রাত আটটায় বোঝা যাবে সেটা! চোখ রাখুন স্টার স্পোর্টস সিলেক্ট ওয়ান চ্যানেলে।