বিশ্বকাপের ফ্লপ একাদশে থাকছেন কারা?

বিশ্বকাপে ফ্লপ মেরেছেন যারা। ফাইল ছবি
বিশ্বকাপে ফ্লপ মেরেছেন যারা। ফাইল ছবি
>অনেকে যেমন রূপকথার মতো বিশ্বকাপ কাটাচ্ছেন, ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকের। দল এবং সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ ক্রিকেটারদের নিয়েই সাজানো হয়েছে এবারের বিশ্বকাপের ‘ফ্লপ একাদশ’।

বিশ্বকাপে খেলা প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন। শুধু অংশগ্রহণ করাই নয়, বিশ্বকাপে পারফর্ম করে সমর্থকদের মনে জায়গাটাও পাকা করে নিতে চান অনেকে। এই যেমন সাকিব আল হাসান, রোহিত শর্মা, মিচেল স্টার্করা দুর্দান্ত পারফর্ম করে মাতিয়ে দিয়েছেন এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। কিন্তু সবার বিশ্বকাপটা এদের মতো এতটা রঙিন কাটেনি। দলের চাহিদা পূরণ করতে পারেননি অনেকে, ব্যক্তিগত প্রত্যাশার খাতায়ও অনেকে ফিরছেন শূন্য এঁকে। বিশ্বকাপে প্রত্যাশা মেটাতে না পারা ক্রিকেটারদের নিয়েই এই ‘ফ্লপ একাদশ’।

মার্টিন গাপটিল, নিউজিল্যান্ড, ৯ ম্যাচে ১৬৭ রান

টুর্নামেন্টের শুরুটা করেছিলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঝোড়ো ফিফটি দিয়ে। মনে হচ্ছিল, গত বিশ্বকাপটা যেখানে শেষ করেছেন, এ বিশ্বকাপটাও সেখান থেকেই শুরু করেছেন মার্টিন গাপটিল। কিন্তু সকাল যে সব সময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয় না, সেটিই যেন এবারের বিশ্বকাপে দেখালেন গাপটিল। গত বিশ্বকাপে যিনি ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, চার বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপে তিনিই চূড়ান্ত ব্যর্থ! সেমিফাইনাল পর্যন্ত ৯ ইনিংস খেলে রান করেছেন মাত্র ১৬৭, গড় মাত্র ২০.৮৭! এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই করেছিলেন অপরাজিত ৭৩ রান। বাকি ৮ ইনিংস মিলিয়ে করেছেন মাত্র ৯৪ রান! গাপটিল ব্যর্থ হওয়ায় ভুগতে হয়েছে নিউজিল্যান্ডকেও। পুরো ব্যাটিং অর্ডারের দায়িত্ব বলতে গেলে একাই সামলাতে হয়েছে কেন উইলিয়ামসনকে।

গুলবদিন নাইব, আফগানিস্তান, ৯ ম্যাচে ১৯৪ রান

বিশ্বকাপের আগে অনেকটা হুট করেই আফগানিস্তানের অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন গুলবদিন নাইব। নতুন দায়িত্ব পেয়েই যেন ঠিক করে নিয়েছিলেন, বিশ্বকাপে দলের সব দায়িত্ব একার কাঁধেই তুলে নেবেন! নতুন বল যেমন নিয়মিতভাবে হাতে নিয়েছেন, তেমনি প্রতিটি ম্যাচেই ব্যাট হাতে নেমে গেছেন ওপেনিংয়ে। কিন্তু ওপেনিংয়ে নেমে সফল হতে পারেননি মোটেও। ৯ ইনিংসে ২১.৫৫ গড়ে করেছেন মাত্র ১৯৪ রান। ফিফটি করতে পারেননি একটি ম্যাচেও, সর্বোচ্চ স্কোর ৪৭।

এইডেন মার্করাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, ৮ ম্যাচে ১৪০ রান

ডি ভিলিয়ার্স ব্যতীত দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং এমনিতেই কিছুটা দুর্বল ছিল এবার। হাশিম আমলাও ছিলেন না নিজের চেনা ছন্দে। অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসির সঙ্গে মিলে বড় রান এনে দেওয়ার দায়িত্বটা তাই ভাগাভাগি করে নিতে হতো এইডেন মার্করামকেই। কিন্তু ডানহাতি এ ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থ। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসা মার্করাম ৮ ম্যাচের ৬ ইনিংসে ২৩.৩৩ গড়ে করেছেন মাত্র ১৪০ রান। গুলবদিনের মতো তাঁরও কোনো ফিফটি নেই, সর্বোচ্চ স্কোর ৪৫।

কুশল মেন্ডিস, শ্রীলঙ্কা, ৭ ম্যাচে ১৪৩ রান

শ্রীলঙ্কার অনভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইন-আপে টেকনিকের দিক থেকে সেরা ব্যাটসম্যান সম্ভবত ছিলেন কুশল মেন্ডিস। মেন্ডিসের ওপর অনেকটা ভরসা ছিল লঙ্কান টিম ম্যানেজমেন্টেরও। কিন্তু চরমভাবে হতাশ করেছেন মেন্ডিস। ৭ ইনিংসে মাত্র ২০.৪২ গড়ে করেছেন ১৪৩ রান। গড়ের মতো স্ট্রাইক রেটটাও বড্ড মলিন, ৬৭.১৩! পুরো টুর্নামেন্টে ফিফটি করতে পারেননি তিনিও, সর্বোচ্চ স্কোর মাত্র ৪৬।

টম ল্যাথাম, নিউজিল্যান্ড, ৯ ম্যাচে ১০৮ রান

বিশ্বকাপের জন্য ল্যাথামকে প্রায় বছর দু-এক সময় নিয়ে তৈরি করেছে নিউজিল্যান্ড। টেস্টে যিনি ওপেনার, ওয়ানডেতে সেই লাথামকেই নিয়মিত পাঁচে খেলিয়ে প্রস্তুত করেছিল নিউজিল্যান্ড। ল্যাথামও মানিয়ে নিয়েছিলেন, মিডল অর্ডারে রস টেলরের সঙ্গে জুটি গড়ে বেশ কিছু ভালো ইনিংসও খেলেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপে এসে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ৯ ইনিংস খেলে মাত্র ১০৮ রান করেছেন ল্যাথাম! গড় তো অবিশ্বাস্য রকমের খারাপ, ১৫.৪২! বিশ্বকাপে অন্তত ২০০ রান করেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ল্যাথামের চেয়ে কম গড় আছে মাত্র দুজনের, রশিদ খান ও মোহাম্মদ নবীর। ১০৮ রানের মধ্যে এক ইনিংসেই করেছেন ৫৭ রান, বাকি ৮ ইনিংস মিলিয়ে মাত্র ৫১ রান এসেছে ল্যাথামের ব্যাট থেকে!

সরফরাজ আহমেদ পাকিস্তান, ৮ ম্যাচে ১৪৩ রান

সরফরাজের নেতৃত্বেই ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছিল পাকিস্তান। দুই বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপ যখন সেই ইংল্যান্ডেই, সরফরাজের ওপরই ভরসা করেছিল পাকিস্তান। অধিনায়ক হিসেবে প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি, দলকে সেমিফাইনালে তুলতে পারেননি। কিন্তু অধিনায়ক সরফরাজের চেয়েও বেশি হতাশ করেছেন ব্যাটসম্যান সরফরাজ। ৮ ইনিংসে ব্যাট করে ২৮.৬০ গড়ে করেছেন মাত্র ১৪৩ রান। ফিফটি করেছেন একটি, সর্বোচ্চ স্কোর ৫৫। টুর্নামেন্টে বেশির ভাগ সময়ই শেষের দিকে নেমেছেন সরফরাজ, কিন্তু ব্যাটে ঝড় তুলতে পারেননি সেরকম। প্রমাণ, ৮ ইনিংসে বাউন্ডারি মেরেছেন মাত্র ৯টি!

থিসারা পেরেরা শ্রীলঙ্কা, ৬ ম্যাচে ৮৮ রান, ১ উইকেট

ফ্লপ একাদশে অলরাউন্ডার কোটা পূরণ করছেন থিসারা পেরেরা। হার্ড হিটার পেরেরার ওপর অনেক আস্থা রেখেই বিশ্বকাপে এসেছিল শ্রীলঙ্কা। আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি পেরেরা, ৬ ইনিংসে ব্যাট করে রান করেছেন মাত্র ৮৮! গড় তো ১৫ এরও নিচে। ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা যে বল হাতে পুষিয়ে দেবেন, সেটিও পারেননি। পুরো বিশ্বকাপে পেরেরার নামের পাশে উইকেট জমা পড়েছে মাত্র ১টি।

মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশ, ৮ ম্যাচে ১ উইকেট

মোস্তাফিজ-সাকিবরা ছিলেন বটে, তবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বটা ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার কাঁধেই। অথচ মাশরাফি কি বোলিংই না করলেন বিশ্বকাপে! ৮ ম্যাচ মিলিয়ে মাত্র ৫৬ ওভার বল করেছেন তিনি, উইকেট পেয়েছেন মোটে ১টি! বোলিং গড় তো অবিশ্বাস্য। একটি উইকেটের জন্য গড়ে ৩৬১ রান খরচ করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক! বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বাজে গড়ের নতুন রেকর্ডই এটি। গড়ের পাশাপাশি ইকোনমিও ভীষণ বাজে। প্রতি ওভারে গড়ে ৬.৪৪ করে রান দিয়েছেন মাশরাফি।

হাসান আলী পাকিস্তান, ৪ ম্যাচে ২ উইকেট

মোহাম্মদ আমির আর ওয়াহাব রিয়াজ বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত প্রাথমিক দলে ছিলেন না। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের নতুন বলের দায়িত্ব সামলানোর কথা ছিল তাই হাসান আলীর। আমির-ওয়াহাব ফিরলেও বিশ্বকাপের শুরুতে হাসান আলীর ওপরই ভরসা রেখেছিল পাকিস্তান। সেই হাসান আলীকে ৪ ম্যাচ পরেই বাদ দিতে একপ্রকার বাধ্য হলো তারা! বাদ না দিয়ে উপায়ও ছিল না, ৪ ম্যাচে ২৫৬ রান খরচায় মাত্র ২টি উইকেট তুলেছেন এ ডানহাতি পেসার! গড়টা মাশরাফির মতো না হলেও যথেষ্টই বাজে, প্রতি উইকেটের জন্য তাঁকে খরচ করতে হয়েছে ১২৮ রান। ইকোনমি তো মাশরাফির চেয়েও বাজে, প্রতি ওভারে গড়ে খরচ করেছেন ৭.৭৫ রান।

রশিদ খান আফগানিস্তান, ৯ ম্যাচে ৬ উইকেট

এ বিশ্বকাপে আলাদা নজর ছিল রশিদ খানের ওপর। বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে বেড়ান যিনি, সেই রশিদ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে কেমন করেন, সেটি নিয়ে আগ্রহ ছিল অনেকেরই। হতাশ করেছেন রশিদ। ৮ ইনিংসে বল করে মাত্র ৬ উইকেট পেয়েছেন রশিদ। ইংল্যান্ড ম্যাচে তো লজ্জার রেকর্ডই করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান খরচ করার রেকর্ডটি এখন রশিদের। ওই একই ম্যাচে করেছেন আরেকটি অস্বস্তির রেকর্ড। এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছয় হজম করেছেন। টুর্নামেন্টে প্রত্যেক উইকেট পেতে রশিদকে গড়ে খরচ করতে হয়েছে ৬৯.৩৩ রান। ইকোনমিও তাঁর মানের তুলনায় বাজে, প্রতি ওভারে গড়ে খরচ করেছেন ৫.৭৯ রান।

কাগিসো রাবাদা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ৯ ম্যাচে ১১ উইকেট

১১ উইকেট পাওয়ার পরও রাবাদাকে ফ্লপ লিস্টে দেখে অনেকে অবাক হতে পারেন। কিন্তু রাবাদার ওপর দলের প্রত্যাশা, ম্যাচে ইমপ্যাক্ট বিবেচনায় রাবাদার পারফরম্যান্স- সবকিছু মিলিয়ে এবারের টুর্নামেন্টে জ্বলে উঠতে পারেননি রাবাদা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারির তালিকায় অনেকেই রেখেছিলেন রাবাদাকে। কিন্তু পারেননি তিনি। তাঁর মাপের বোলারের নামের পাশে ৮ ইনিংসে ১১ উইকেট একেবারেই বেমানান। দলের ভীষণ প্রয়োজনের সময় ব্রেক থ্রু দিতে পারেননি, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতেও ছিলেন অনেকটা নিষ্প্রভ। গড় ৩৬.০৯, ইকোনমি ৫.০৮।