খেলা হলো লর্ডসে, উৎসব এজোয়ার রোডে

লন্ডনের রাস্তায় উৎসব করার কথা ইংল্যান্ডের মানুষের। উৎসব করল কিনা আলজেরিয়ার মানুষ! আতশবাজির আলোয় লাল-সাদা পতাকা ওড়েনি। উড়েছে সবুজ-সাদা জমিনে চাঁদ-তারাখচিত পতাকা।

ক্রিকেট ইংল্যান্ডের সন্তান। বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে শুরু। অথচ সেই সন্তান ইংল্যান্ডকে ভুলে থাকল ৪৪ বছর। বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডের দিকে মুখ তুলে চাইল না এই ৪৪ বছর ধরেই। ইতিহাস বদলানোর দায় ছিল ইংলিশদের। এউইন মরগানের দলের কাছে দাবি ছিল, ঘরের মাঠে ফিরে আসা বিশ্বকাপে এবার অন্তত ট্রফিটা চাই। রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তায় সে দাবি মিটিয়ে দিল মরগানের দল। নিউজিল্যান্ডকে হয়তো তারা খেলে হারাতে পারেনি, কিন্তু বিশ্বকাপ তো জিতেছে! ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছে মহা উৎসবে মেতে ওঠার এক উপলক্ষ।

কিন্তু ইংলিশরা উৎসবে মাতল কই! লর্ডস থেকে বিজয়ানন্দে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে যাওয়াই কি উৎসব? এ দেশের মানুষের কাছে ব্যাপারটা আসলে সে রকমই। ইংলিশদের উৎসব হয় পাবে, বারে, সপ্তাহান্তে পিকাডিলি সার্কাসে।

ওয়ানডের এক নম্বর দল হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছে ইংল্যান্ড। ‘টপ ফেবারিট’-এর ছাপ ছিল গায়ে। লর্ডসের ফাইনালে শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডই জিতে গেলে এ জাতি শোকস্তব্ধ হতো নিশ্চিত। কিন্তু বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার পর তাদের যেন সবই পাওয়া হয়ে গেছে। সেই প্রাপ্তিকে তারা এতটাই অবধারিত ধরে নিয়েছিল যে এ নিয়ে আনন্দের আতিশয্যে ভাসার প্রয়োজন মনে করেনি। সড়কে নেমে আনন্দ মিছিল করার দরকার মনে করেনি। তাদের বিশ্বজয়ের সুখ মনে মনে। বিয়ারের পাইন্টের গায়ে জমা শীতল জলকণায়। বন্ধুর সঙ্গে ‘হা হা হা’ অট্টহাসিতে আনন্দ ভাগাভাগি করায়।

তবে উৎসব কাল রাতে ইংল্যান্ডের রাস্তায়ও হয়েছে। সেটি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে নয়। ইংল্যান্ড থেকে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ মিসরে হওয়া এক খেলার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল লন্ডনের এজোয়ার রোডে। আফ্রিকা কাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে নাইজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে আলজেরিয়া। ছুটির দিনে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার তৃপ্তি নিয়ে লন্ডনবাসী ইংলিশরা যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখনই হঠাৎ লন্ডনপ্রবাসী আলজেরিয়ানরা নেমে এল রাস্তায়।

লর্ডসের বাইরে ইংলিশরা উল্লাস করলেও আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যায়নি। ছবি: রয়টার্স
লর্ডসের বাইরে ইংলিশরা উল্লাস করলেও আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যায়নি। ছবি: রয়টার্স

গাড়ি আর মোটরসাইকেলের তীব্র হর্ন রাতের নিস্তব্ধতা চৌচির করে দিচ্ছিল। অনেকের হাতেই আলজেরিয়ার জাতীয় পতাকা, কণ্ঠে আরবি ভাষার কোনো গান। হতে পারে তাদের জাতীয় সংগীত অথবা অন্য কিছু। কেউ কেউ মোটরসাইকেলের ওপর উঠে যাচ্ছিলেন নাচতে নাচতে। এমন আনন্দ যেন বহুদিন করেনি আলজেরিয়ানরা!

এজোয়ার রোডের সিসা রেস্টুরেন্টগুলোয় আরব মানুষদের আনাগোনাই বেশি। গভীর রাত পার হয়ে যায় এসব রেস্টুরেন্টের ঝাঁপি পড়তে পড়তে। আফ্রিকা কাপের ফাইনালে ওঠার উৎসব করতে সে জায়গাটিকেই বেছে নিলেন শ খানেক আলজেরিয়ান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের মানুষও।

ফাইনালে উঠে আলজেরিয়া এখন আফ্রিকা জয়ের স্বপ্ন দেখছে। আর ইংল্যান্ডের পূরণ হয়ে গেছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নই। তবে জয়টা যদি বাউন্ডারির হিসাবে না হয়ে খেলাতেই হয়ে যেত, তাহলেই বোধ হয় ইংল্যান্ডের মানুষ বেশি খুশি হতো। নিউজিল্যান্ড তাদের তৃপ্তিতে সেই কাঁটাটা ঠিকই বিঁধিয়ে দিয়েছে। ম্যাচ শেষে মরগানের কথায়ও নিউজিল্যান্ডের প্রশংসা, ‘নিউজিল্যান্ড অসাধারণ একটা দল। ঈর্ষা করার মতোই...। এ রকম লড়াই করার মানসিকতা, এ রকম খেলা তারা অনেক দিন ধরেই খেলছে। আমরা মাত্রই সেটা শুরু করলাম এবং চেষ্টা করব চার বছর পরের বিশ্বকাপ পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে।’

এবারের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে চার বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে ইংল্যান্ড। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় সার্থক করেছে তাদের সেই চেষ্টা। ইংল্যান্ডের মানুষের এতেই আনন্দ, এতেই সুখ। এজোয়ার রোডের উৎসবের রাত না হয় শুধু আলজেরিয়ানদের হয়েই থাকুক।