যেভাবে তৈরি হয় ক্রিকেটার?

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে চলছে নবীন ক্রিকেটারদের অনুশীলন। ছবি: জাহিদুল করিম
ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে চলছে নবীন ক্রিকেটারদের অনুশীলন। ছবি: জাহিদুল করিম
>রোমাঞ্চ ছড়িয়ে গতকাল শেষ হয়ে গেল ক্রিকেট বিশ্বকাপ। লর্ডসের ফাইনালের প্রতিটা শিহরণই ছুঁয়ে গিয়েছে আমাদের। বেড়ে গিয়েছিল সাকিব-মাশরাফিদের জার্সির চাহিদা। একজন বালক বা কিশোর আপাতত জার্সি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও ভবিষ্যতে একজন সাকিব বা মাশরাফি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে সবাই। কীভাবে একজন ক্রিকেটার হয়ে ওঠা যায়, সে রাস্তা দেখানোর চেষ্টা হয়েছে এখানে

‘পড়ার সময় পড়া, খেলায় সময় খেলা’, ৯০ দশক পর্যন্ত কথাটি শোনেনি কোনো কিশোর-কিশোরী, এমন দাবি করলে অবাক হওয়ারই কথা। বর্তমানে হয় উল্টো, বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা বা ভিডিও গেমসে মজে থাকা ছেলেকে বাইরে খেলতে পাঠানোর জন্য চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না মা-বাবার।

উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণেরা তো ক্রিকেট বলতেই পাগলপ্রায়। তারা স্বপ্ন দেখে মস্ত বড় ক্রিকেটার হওয়ার। শুধু খেলা কিংবা বিনোদন নয়, সময়ের পালাবদলে শখের খেলা ক্রিকেট এখন বড় পেশাদারি পরিচয়। ভালো ক্রিকেটার হতে পারলেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে যশ-খ্যাতি নিশ্চিত!

তাই অভিভাবকেরাও চান সন্তান ক্রিকেটার হোক। আর এ জন্য চাই সঠিক গাইডলাইন। তার জন্য অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। ঢাকার অদূরে সাভারের ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেট মাতাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, আবদুর রাজ্জাকদের মতো ক্রিকেটাররা। তাই অনেকেই ভেবে থাকেন, ছেলেকে একবার বিকেএসপিতে দিতে পারলে সে-ও বুঝি হয়ে গেল মস্ত বড় ক্রিকেটার।

শিষ্যকে দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে ব্যাট চালাতে হয়। ছবি: জাহিদুল করিম
শিষ্যকে দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে ব্যাট চালাতে হয়। ছবি: জাহিদুল করিম

বিকেএসপিতে ভর্তি হতে পারলে ভালো একটা গাইডলাইন পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আসনসংখ্যা সীমিত থাকায় সবাই তো আর প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না। তাহলে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে না পারলে কি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে ক্রিকেট হওয়ার স্বপ্ন? মোটেই না। জেলা শহর ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেট মাতানোর উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। তামিম ইকবাল উঠে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে, মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নিজ জেলায় সঠিক গাইডলাইন পেয়েছিলেন বলেই তাঁরা আজ প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার। তবে হ্যাঁ, সঠিক দিকনির্দেশনার সঙ্গে প্রয়োজন ব্যক্তিগত মেধা ও কঠোর পরিশ্রম।

কোন বয়স থেকে খেলা শুরু করা উচিত?

খেলা শুরুর ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। তবে যত কম বয়স থেকে শুরু করা যায়, ততই ভালো। বিষয়টি একটা ছেলে বা মেয়ের পছন্দের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কোনো বাচ্চা ৫ বছর বয়স থেকে শুরু করতে পারে, কেউবা ১০ বছর বয়সে। তবে যেকোনো বয়সে খেলার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে খেলতে দেওয়া উচিত। সে যেন আনন্দ নিয়ে খেলতে পারে, সে পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে অভিভাবকদের।

কোচের কাছে কখন যাবে?

কেউ মনের আনন্দে নিয়মিত খেলতে থাকলে পরবর্তী ধাপ নিয়ে ভাবা উচিত। যদি দেখা যায় খেলার দিকে আগ্রহ বেশি, তাকে সেভাবেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে। বাসায় বা এলাকার মাঠে নিয়মিত খেলতে থাকলে ১০-১২ বছর বয়সে একটা ছেলেকে কোচের কাছে পাঠানো উচিত। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুশীলনের পরিবেশ দেখতে হবে। শুরুতে মৌলিক বিষয়গুলো শেখার জন্য অবশ্যই ভালো কোচ নির্বাচন করতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন ভালো খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য অবশ্যই একজন ভালো কোচের প্রয়োজন।

একাডেমি

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় তিন শ ব্যক্তিগত একাডেমি গড়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই আছে প্রায় এক শ একাডেমি। সেখানে ব্যাট-বল হাতে অনেক বালক বা কিশোরেরা আসে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। গত মৌসুমে দেশজুড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তিনটি বয়সভিত্তিক খেলোয়াড় বাছাইয়ে প্রাথমিক ধাপে (স্বাস্থ্য পরীক্ষা) অংশ নিয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। এই ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ যুক্ত থাকে বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমিতে। ঠিকমতো তদারকি করা হলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় এই একাডেমিগুলো রাখতে পারে বড় ভূমিকা।

একাডেমিতে খরচ কেমন?

একাডেমিগুলোয় ভর্তি হতে সাধারণত খরচ হয় ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। মাসে দিতে হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে বিশেষ ছাড় দেয় অনেকে। অন্য খেলার তুলনায় ক্রিকেট বেশ ব্যয়বহুল হলেও ঢাকা শহরে এ খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবার। এমনকি গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার একাডেমিতেও অধিকাংশ খেলোয়াড় আসে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে।

বিভাগগুলোতে উল্লেখযোগ্য একাডেমি

ঢাকা: বর্তমান সময়ে ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি মানসম্পন্ন একাডেমি গড়ে উঠেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেখ জামাল ধানমন্ডি একাডেমি, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব, ধানমন্ডি আবাহনী মাঠ, সিটি ক্লাব (মিরপুর)। এ ছাড়া উত্তরায় নতুন কয়েকটি একাডেমি পথচলা শুরু করেছে।

সিলেট: সিলেট জেলার রাগীব-রাবেয়া বাংলাদেশ স্পোর্টস একাডেমি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেখানে মানসম্পন্ন কোচ দ্বারা খেলোয়াড় তৈরি করা হয়। ২০১৪ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী রাগীবনগরে একাডেমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

চট্টগ্রাম: দেশের ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর বলা হয়ে থাকে চট্টগ্রামকে। চট্টগ্রাম জেলা শহরের মধ্যে ব্রাদার্স ইউনিয়ন একাডেমি, চট্টগ্রাম পোর্ট সিটি একাডেমি ও ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমি উল্লেখযোগ্য।

রাজশাহী: সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিভাগ থেকে অনেক ক্রিকেটার উঠে আসছে। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ক্লেমন রাজশাহী ও বাংলা ট্রাক একাডেমি।

খুলনা: মোহামেডান ও আবাহনী ক্লাবের একাডেমি

ময়মনসিংহ: এমসিসি ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের একাডেমি

প্রতিভা অন্বেষণ: প্রতিভা অন্বেষণের আওতায় থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজকের যারা বড় বড় তারকা, কিশোর বয়সে ভালো মানের প্রতিভা অন্বেষণ থেকেই উঠে আসা। যেকোনো কিশোরের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে প্রতিভা অন্বেষণ। ক্রিকেটার হতে চাইলে এমন স্কুলে পড়া উচিত, যে স্কুলের নিজস্ব মাঠ আছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের আয়োজনে স্কুল ক্রিকেটে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে থাকে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া যে একাডেমিতে ভর্তি হবে, তারা একাডেমি কাপ টুর্নামেন্টে খেলে কি না, সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সে দ্রুত প্রতিভা অন্বেষণদের নজরে আসতে পারে।

বয়সভিত্তিক দল

জাতীয় দলের পাইপলাইন হিসেবে ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে অনূর্ধ্ব ১৫, ১৭ ও ১৯ দল আছে। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে জেলা দলের হয়ে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট খেললে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকা বা ঢাকার বাইরে একাডেমিগুলো নিয়ে নিয়মিত একাডেমি কাপ টুর্নামেন্ট হয়। সেখানে খেলেও বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলগুলো মূল জাতীয় দলের পাইপলাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বিকেএসপি

বিকেএসপির আসনসংখ্যা সীমিত। ফলে বিকেএসপিতে সুযোগ পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত মেধা ও পরিশ্রমের পরিশ্রমের সঠিক পথটা জানা খুব জরুরি। সে পথটা দেখিয়ে দিতে পারে বিকেএসপি। প্রতি বছরের শুরুতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে ভর্তি করানো হয় বিকেএসপিতে।

মেয়েরা কীভাবে ক্রিকেটার হবে?

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরেই। ছেলেদের ক্রিকেট বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিচয়, এশিয়ান গেমসের স্বর্ণপদক। কিন্তু সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজারাও একটি অতৃপ্তি রেখে দিচ্ছিলেন বারবার। বেশ কয়েকবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিতে উৎসবের সুযোগ করে দিতে না পারেনি ছেলেদের দল। ছেলেদের সেই অতৃপ্তি ঘুচিয়েছেন মেয়েরা। গত বছর ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে বাংলাদেশ।

মেয়েদের ক্রিকেটটা এখনো জমজমাট না হয়ে ওঠেনি। কারণ মেয়েদের ক্রিকেটে আমরা এখনো নতুনই বলা চলে। তবে মেয়েদের ক্রিকেট খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের অংশগ্রহণ আরও বাড়লে বাংলাদেশও হয়ে উঠবে শক্তিশালী দল। এখন অনেক মেয়েকেই দেখা যায় পিঠে ক্রিকেট ব্যাগ ঝুলিয়ে যাচ্ছে মাঠে। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে অনুশীলন করছে তারা। ঢাকা, জেলা শহর বা একাডেমিগুলোতে ছেলেমেয়েদের একই সঙ্গে অনুশীলন করানো হয়। আশার কথা, এক দশকের বেশি সময় ধরে নারীদের ক্রিকেট বিভাগ চালু করা হয়েছে বিকেএসপিতে।