সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই হয় না, প্রমাণ ইংল্যান্ড

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে বিশ্বজয়ী ইংলিশ ক্রিকেট দল।! ছবি : রয়টার্স
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে বিশ্বজয়ী ইংলিশ ক্রিকেট দল।! ছবি : রয়টার্স
>ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ের প্রস্তুতি এক দিনে আসেনি। এই সাফল্য হঠাৎ করে আসেনি। চুয়াল্লিশ বছর পর নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতার নেপথ্যে ইংল্যান্ড গুরুত্ব দিয়েছিল সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে। সঙ্গে সকলের পরিশ্রম তো ছিলই!

২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা বাংলাদেশের মানুষের বেশ মনে থাকার কথা।

মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি আর মুশফিকুর রহিমের দারুণ এক ইনিংসে ২৭৫ রান তোলে বাংলাদেশ। জবাব দিতে নেমে ইয়ান বেল, জস বাটলারের ফিফটি সত্ত্বেও ম্যাচটা জিততে পারেনি ইংলিশরা। শেষদিকে রুবেল হোসেনের তোপে ১৫ রানে ম্যাচ হেরে যা তারা। সেটি কেবল একটি হারই ছিল না, বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের। ব্যাপারটি সহজে মেনে নেয়নি ইংলিশ ক্রিকেট প্রশাসকেরা।

ইংলিশ বোর্ড ভাবতে বসে নতুন করে। ঐতিহ্যগতভাবেই সাদা বলের ওয়ানডে খেলাকে কখনোই অত বেশি গুরুত্ব দেয়নি ইংল্যান্ড। তাদের কাছে সব সময় সাদা বলের চেয়ে লাল বলের ক্রিকেটের গুরুত্ব বেশি ছিল। বিশ্বকাপের চেয়ে অনেক সময় অ্যাশেজ ছিল তাদের কাছে বেশি মর্যাদার। তবে বিশ্বকাপে তিনবার ফাইনালে উঠে একবারও শিরোপা না জেতার ব্যাপারটা সব সময়ই পুড়িয়েছে ইংল্যান্ডকে। ১৯৮৭ আর ১৯৯২ সালে ফাইনালে ইংল্যান্ডের হার ছিল যথাক্রমে ৭ আর ২২ রানে—একেবারে তীরে এসে তরী ডোবার অবস্থা। এরপর ছয়টি বিশ্বকাপে কেউ ইংল্যান্ডকে গোনাতেই ধরেনি। ২০১৫ বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশের কাছে হেরে ইংল্যান্ডের বিদায় ঘটল—ক্রিকেটের জনকেরা তখন ক্রিকেট দুনিয়ার কাছে হাসাহাসির বিষয়।

ইংলিশ ক্রিকেটের ধরনটাই ছিল মান্ধাতার আমলের। টি-টোয়েন্টির যুগে ক্রিকেটে যখন আগ্রাসন আর পাওয়ার হিটিংয়ের জয়জয়কার, উত্তুঙ্গ সাহস নিয়ে খেলোয়াড়েরা যখন ভয়ডরহীন খেলায় অভ্যস্ত, ঠিক তখন ইংল্যান্ড দল খেলত ঢিমেতালে, পুরোনো কায়দায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের সবচেয়ে ‘একঘেয়ে’ দল ছিল তারা। বাংলাদেশ তাদের হারিয়ে সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিল চোখে আঙুল দিয়েই।

সে ম্যাচের পরই আত্মোপলব্ধি ঘটে ইংলিশ ক্রিকেটের। ইংলিশ ক্রিকেট প্রশাসকেরা মনে করেন, বড় ধরনের পরিবর্তনই প্রয়োজন। একটা পরিবর্তন অবশ্য ২০১৫ বিশ্বকাপ শুরুর আগেই শুরু হয়েছিল। বিশ্বকাপের মাত্র দুই মাস আগে দীর্ঘদিনের অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুকের হাত থেকে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব নিয়ে এউইন মরগানকে দেওয়া হয়। বিশ্বকাপের পর পর বোর্ড থেকে শুরু করে দল, খোলনলচে বদলে যায় সবকিছুর। বোর্ডে নিয়ে আসা হয় সাবেক অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রসকে। আসার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলা মাত্র ছয়জন ক্রিকেটার টিকে যান এই পরিবর্তনের জোয়ারে—মরগান, মঈন আলী, অ্যালেক্স হেলস, জস বাটলার, জো রুট ও ক্রিস ওকস। এই ছয়জনের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে দলে এমন সব ক্রিকেটারদের নিয়ে আসা হয়, যারা মারকাটারি ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে পিছপা হন না। ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলো তখন টি-টোয়েন্টির কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে ওয়ানডে খেলা শুরু করেছে আক্রমণাত্মক ঢংয়ে। ইংল্যান্ডও চাইল তেমন কিছু করতে। নতুন এই দলে ইয়ান বেল, জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, রবি বোপারা, জেমস ট্রেডওয়েলদের মতো ক্রিকেটারদের জায়গা হলো না। আধুনিক যুগের মানানসই তারকাদের খুঁজে বের করা হলো। দলে যেন সব ধরনের খেলোয়াড় থাকে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হলো।

ইনিংসের মারকাটারি শুরু এনে দেওয়ার জন্য বিধ্বংসী ওপেনার দরকার? চলে এলেন জেসন রয় আর জনি বেয়ারস্টো। একটু ধরে খেলার সঙ্গে রানের চাকাও সচল রাখতে পারে, ইনিংস গড়তে পারে এমন খেলোয়াড় দরকার? জো রুটের সঙ্গে অধিনায়ক মরগান তো আছেনই। দরকার কার্যকরী পেস বোলিং অলরাউন্ডার? ডাকো বেন স্টোকস আর ক্রিস ওকসকে। স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার লাগবে? মঈন আলী তো আছেনই। সুইংয়ের বিষ মাখা বোলিং করার মতো খেলোয়াড় প্রয়োজন? দলে এলেন লিয়াম প্লাঙ্কেট। ইংল্যান্ড নিখাদ গতিতারকা পেল মার্ক উড আর জফরা আর্চারের মধ্যে। ইনিংসের শেষ দিকে স্লগ ওভারে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করার জন্য উইকেটরক্ষক জস বাটলার তো ছিলেনই। আধুনিক ক্রিকেটের প্রত্যেক ওয়ানডে দলে এখন একজন করে লেগ স্পিনার থাকেনই। আফগানিস্তানের আছেন রশিদ খান, ভারতের যুজবেন্দ্র চাহাল, পাকিস্তানের শাদাব খান, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পা, নিউজিল্যান্ডের ইশ সোধি। ইংল্যান্ডও পেল একজনকে। এলেন আদিল রশিদ। মানে সব দিকেই ইংল্যান্ড কার্যকরী খেলোয়াড় পেয়ে গেল।

এখন দরকার একজন যোগ্য কোচের, যার চিন্তাধারা আধুনিক ওয়ানডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। প্রথমে শোনা গেল, দলের কোচ হিসেবে আনা হবে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান পেসার জেসন গিলেস্পিকে। কিন্তু না, স্ট্রসের মনে যে আরেকজন ছিলেন!

তিনি ট্রেভর বেলিস। এই কোচ ২০১১ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের একদম হাতছোঁয়া দূরত্বে। শেষমেশ ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল লঙ্কানরা, কিন্তু প্রশংসিত হয়েছিল এই অস্ট্রেলিয়ানের কোচিং-প্রজ্ঞা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ হয়ে তিন বছরের মধ্যে দুবার আইপিএলও জিতেছিলেন এই কোচ। সিডনি সিক্সার্সকে দুবার বিগ ব্যাশের ফাইনালে তুলে একবার জিতিয়েছিলেন শিরোপা। বেলিসকে দলের কোচ বানাতে তাই দুবার ভাবেননি স্ট্রস।

স্ট্রস-মরগান-বেলিস ত্রয়ীর হাতে সাফল্য ধরা দিতে শুরু করল হাতেনাতে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের জয়ের হার প্রায় ৭১ শতাংশ। র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দলও তারা।

বাকি ছিল শুধুই বিশ্বকাপ জেতা। যেটা জেতার জন্য এত আয়োজন, এত পরিবর্তন।

অবশেষে সেটাও জিতে ইংল্যান্ড জানিয়ে দিল, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিশ্রম ছাড়া, কিছুই অর্জন করা সম্ভব না! ক্রিকেট দুনিয়ার বাকিদের জন্য শেখার অনেক কিছুই আছে ইংল্যান্ডের কাছে।