ক্রীড়াঙ্গনে প্রতারণার পাঁচ

কয়েক দিন আগে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার সময় জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দাবা দলের কোচ সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার ইগর রাউসিস। টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মুঠোফোন ব্যবহার করে দাবার চাল দেখে নেওয়ার দায়ে ধরা পড়েছেন এ কোচ।

ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ ওপেনে খেলছিলেন রাউসিস। সাধারণত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলা চলার সময় মুঠোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করছিলেন এবং টয়লেটে গিয়ে দাবার চাল দেখে নিচ্ছিলেন। আর এতেই সন্দেহ হয় টুর্নামেন্টের আরবিটারের। আগে থেকেই টয়লেটে লুকানো ক্যামেরা বসানো ছিল। এরপর সেই ক্যামেরায় ধরা পড়ে রাউসিসের এমন অনৈতিক কাজের।

বিভিন্ন খেলায় যুগে যুগে এমন জালিয়াতির বহু নজির আছে। এর মধ্যে থেকে বাছাই করা পাঁচটি প্রতারণার কাহিনি উল্লেখ করা হলো এখানে:

এভাবেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে গোল করতে প্রতারণার সাহায্য নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ছবি : টুইটার
এভাবেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে গোল করতে প্রতারণার সাহায্য নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ছবি : টুইটার


হ্যান্ড অব গড
বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত গোল বোধ হয় এটাই। ফকল্যান্ড যুদ্ধের ক্ষত থাকতেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ফকল্যান্ডের যুদ্ধে সাড়ে ছয় শরও বেশি আর্জেন্টাইন নিহত হওয়ায় যেভাবেই হোক জেতার পণ করেই মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৫১ মিনিটে ইংল্যান্ডের ডি বক্সে মিডফিল্ডার স্টিভ হজের ভুল ক্লিয়ারেন্সে বল চলে আসে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের মাথার ওপরে। ম্যারাডোনা দেখলেন তাঁর চেয়ে লম্বা শিলটনকে হারানো যাবে না হেড করার লড়াইয়ে। তাই তিনি মুহূর্তের মধ্যেই হেড না করে বাঁ হাত দিয়ে বলটা ঠেলে দিলেন গোলপোস্টের দিকে। স্তব্ধ শিলটন দেখলেন হাত দিয়ে স্পর্শ করা বল গোলপোস্টে ঢুকে গেল। ইংলিশ খেলোয়াড়দের প্রতিবাদে কাজ হয়নি। রেফারি অনড় থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। পরে ম্যারাডোনাকে এই গোল সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‘হ্যান্ড অব গড’, অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়েই নাকি তিনি গোলটি করেছিলেন।

তুলা যখন প্লাস্টার
দুবার গোল্ডেন গ্লাভস চ্যাম্পিয়ন পুয়ের্তো রিকান বক্সার লুই রেস্টর ক্যারিয়ারের শুরুর দিককার কাহিনি একদম। নামকরা বক্সার হওয়ার পথে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। নিউইয়র্কের বাইরে তাঁকে তেমন কেউ চিনত না, তাই রেস্তোর সাধ ছিল বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করার। সে লক্ষ্য অর্জনের পথে এক বড় ধাপ অতিক্রম করেন ১৯৮৩ সালে। তখন পর্যন্ত অপরাজিত বক্সার বিলি কলিন্সকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন রেস্তো। ১০ রাউন্ড পর্যন্ত চলতে থাকা ম্যাচে কলিন্সকে বেধড়ক পেটান রেস্তো। চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে যায় কলিন্সের। রেস্তো জোরে ঘুষি মারতে পারেন না, এমনটা ধারণা ছিল তখন, কিন্তু এ ম্যাচ সেই ধারণা পালটে দেয়। ম্যাচ শেষে রেস্তোর সঙ্গে করমর্দন করতে আসেন কলিন্স ও তাঁর কোচ, তাঁর বাবা বিলি কলিন্স সিনিয়র। করমর্দন করতে গিয়ে অনুভব করেন, স্বাভাবিক গ্লাভসের চেয়ে পাতলা গ্লাভস পরেছেন রেস্তো, যা অনৈতিক। বিলি কলিন্সের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হলো। দেখা গেল, গ্লাভস জোড়ার ভেতর থেকে এক আউন্স করে তুলা সরিয়ে ‘প্লাস্টার অব প্যারিস’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর কাজটা করেছিলেন রেস্তোর কোচ পানামা লুইস। সেই প্লাস্টার অব প্যারিস ভেতরে জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যায়। ফলে আস্তে করে ঘুষি মারলেও তার প্রভাব হয় সাংঘাতিক। যে কারণে বিলি কলিন্সকে হারাতে পেরেছিলেন রেস্তো। সেটাই কলিন্সের জীবনের শেষ খেলা ছিল। পরে এই হারের জ্বালা সইতে না পেরে মারা যান কলিন্স। রেস্তোর লাইসেন্সও বাতিল করা হয়।

ম্যারাথন দৌড় শেষে রোজি রুইজ। ছবি: টুইটার
ম্যারাথন দৌড় শেষে রোজি রুইজ। ছবি: টুইটার


ম্যারাথন জেতার সহজ (!) উপায়
১৯৮০ সালের বোস্টন ম্যারাথনের মহিলা বিভাগে বিজয়ী হন রোজি রুইজ। দৌড়ের সময় কোনো সমস্যা ছিল না, সমস্যা বের হলো দৌড় শেষ হওয়ার পরে। এত দীর্ঘ এক দৌড় শেষ করার পর যতটুকু ক্লান্ত থাকার কথা, রোজিকে তেমন ক্লান্ত লাগছিল না। এমনকি তিনি ঘামছিলেনও না, হৃৎপিণ্ডের গতি ছিল স্বাভাবিক। ফলে সন্দেহ হয়, রোজি কি আদৌ দৌড়েছেন ম্যারাথনে? তদন্ত শেষে দেখা গেল, বেশ কিছু চেকপয়েন্টে রোজিকে দেখাই যায়নি। বের হলো, রোজি আসলে দর্শক হয়ে ছিলেন। দৌড় শেষ হওয়ার আধা মাইল আগে যিনি দর্শকদের ভিড় থেকে কোনো রকমে বের হয়ে গিয়ে নিজেই দৌড়ানো শুরু করে দেন! আট দিন পর রোজির কাছ থেকে বিজয়ীর পদক কেড়ে নেওয়া হয়। যদিও প্রতারণা করেছেন, এমন অভিযোগ এখনো অস্বীকার করেন তিনি!

পোষা কুকুর যখন ম্যাচ জেতায়
আমেরিকান ফুটবল লিগের একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল শিকাগো বিয়ারস। ম্যাচ জেতার জন্য শিকাগো বিয়ারসের মালিক ও প্রথম কোচ জর্জ হালাস বেশ কিছু অদ্ভুত কাণ্ড করতেন। খেলার মধ্যে দরকার হলে শিকাগো বিয়ারস যেন ‘স্টপেজ টাইম’ পায়, সে কারণে খাল থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই নিজের পোষা কুকুরকে মাঠে ছেড়ে দিতেন। কুকুরটাকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া শিকাগোর মাঠে যখনই প্রতিপক্ষ খেলতে আসত, তাদের খেলোয়াড়দের প্রসাধনীর মধ্যে চুলকানির পাউডার ঢুকিয়ে দিতেন হালাস। তোয়ালে ফুটো করে দিতেন!

নিজের জার্সি নিজেই টানছেন লিয়ান্দ্রো দামিয়াও। ছবি: টুইটার
নিজের জার্সি নিজেই টানছেন লিয়ান্দ্রো দামিয়াও। ছবি: টুইটার



পেনাল্টির জন্য এত কিছু!
ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকার লিয়ান্দ্রো দামিয়াওকে নেওয়ার জন্য তখন টটেনহাম-আর্সেনালে টানাটানি চলছে। সান্তোসে খেলতেন তিনি। এমন সময়ে ক্রিসিয়ুমা ক্লাবের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে সান্তোস। ম্যাচ জেতার জন্য মরিয়া দামিয়াও একপর্যায়ে নিজের জার্সি নিজেই পেছন থেকে টেনে ধরে পড়ে যান! আর কিছুই না, রেফারির চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে ফ্রি কিক জেতার চেষ্টা আরকি। সৌভাগ্যবশত দামিয়াওর চাতুরি বুঝতে পারেন রেফারি। পরে ব্রাজিলের এক চ্যানেল ম্যাচ ভিডিওর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখায়, ২০১২ অলিম্পিকের সর্বোচ্চ গোলদাতা দামিয়াও নিজেই নিজের জার্সি টেনে পড়ে যাচ্ছেন!