যে বিদেশির হাতে বদলে গেছে মোহামেডান

তিনি মনে হয় কোনো জাদুর কাঠি নিয়ে এসেছেন। নইলে লিগের প্রথম পর্বে ১২ ম্যাচে মাত্র ৬ পয়েন্ট পাওয়া মোহামেডান এতটা ঘুরে দাঁড়ায় কীভাবে! দ্বিতীয় পর্বে দলের দায়িত্ব নিয়ে ৯ ম্যাচে এনে দিয়েছেন ১৭ পয়েন্ট। ৫ জয়, ২ ড্র, ২ হার। বোঝাই যাচ্ছে, এত দিন প্রতিপক্ষের হাতে রক্তাক্ত মোহামেডান আজ নিজেই ঘুষি মারতে শিখেছে। নেপথ্য কারিগর অবশ্যই শন লেন। সাদা–কালোর অবনমনশঙ্কা কার্যত কাল তিনি দূর করে দিলেন নোফেলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তাই হাসিখুশি ৫৫ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ কোচকেই দেখা গেল। মোহামেডানের এই ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিবৃত্ত প্রথম আলো শুনল তাঁর কাছে।
মোহামেডান কোচ শন লেন
মোহামেডান কোচ শন লেন

প্রশ্ন: আপনার আর দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়। ২৩ পয়েন্ট নিয়ে সম্ভবত অবনমনটা বাঁচিয়ে ফেললেন? হাতে আরও তিনটি ম্যাচ আছে।
শন লেন: হ্যাঁ, আমিও তা-ই ভাবছি। আমাদের অবনমনের চিন্তাটা আর তেমন না করলেও চলবে। এটা দারুণ ব্যাপার। 
প্রশ্ন: আপনি যদি পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি বা নব্বই দশকের দিকে তাকান, তাহলে এখনকার মোহামেডানের ফলটা অবশ্য চরম অবমাননাকরই মনে হবে...
লেন: হ্যাঁ, আমিও শুনেছি মোহামেডানের ইতিহাস সম্পর্কে। কিন্তু গত কয়েক বছরে দলটির ফল প্রত্যাশিত নয়। আমি এসে দেখলাম এবারের প্রিমিয়ার লিগে প্রথম পর্বে মাত্র ৬ পয়েন্ট পেয়েছে মোহামেডান। তখন আমাকে বলা হলো দলটাকে বাঁচাতে হবে। আমি চেষ্টা করেছি। আজ হয়তো সেটার ফল কিছুটা হলেও এসেছে। প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে আমাদের ফল ভালো। সেটাই আসলে দারুণ ব্যাপার।
প্রশ্ন: এই ভাঙাচোরা দলটাকে কীভাবে মোটামুটি দাঁড় করিয়েছেন?
লেন: রহস্য একটাই। আমি ছেলেদের নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছি গত চার মাসে। প্রতিদিন অন্তত দুটি সেশন করেছি। প্রায়ই দৈনিক আমি তিনটি সেশনও রাখতাম। তা রোদ, ঝড় বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন। এখানে এসে দেখেছি ছেলেদের ফিটনেসের অবস্থা খুবই খারাপ। সেই ফিটনেস এখন অনেক ভালো। ছেলেগুলো দৌড়াচ্ছে। আর আধুনিক ফুটবলই এখন এমন যে আপনার হেঁটে হেঁটে ফুটবল খেলা চলবে না।

প্রশ্ন: আপনি এসে বেঞ্চের কয়েকজন খেলোয়াড়কে একাদশে এনেছেন। এমিলি, তকলিচদের একাদশে খেলাচ্ছেন এবং তাঁরা ভালোই করছেন।
লেন: আগে কারা প্রথম একাদশে খেলেছে, সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করিনি আমি। অনুশীলনে দেখে যাকে ভালো মনে করেছি, তাকেই একাদশে নিয়েছি। যেমন এমিলি এখন বয়সের কারণে কম দৌড়ায় ঠিক। কিন্তু ও বুদ্ধিমান। কখন কী করতে হবে জানে। ইউসুফ সিফাত ছেলেটার বাঁ পা ভালো। তকলিচ গোল করতে পারে। ফিনিশিং চমৎকার। ওকে আমি সুযোগ দেওয়ার পর দ্বিতীয় পর্বে ৫–৬টা গোল করেছে। সিফাতও গোল করছে। আপনি দেখুন প্রথম পর্বে মোহামেডানের গোল ছিল ৮টি। আমার সময়ে ৯ ম্যাচে ১৯টি গোল এসেছে। সর্বশেষ দুটি ম্যাচে আমরা ৭ গোল করেছি।

প্রশ্ন: হ্যাঁ, এটা দারুণ ব্যাপার। তবে মালির ফরোয়ার্ড সুলেমানি দিয়াবাতেকেই মনে হচ্ছে আপনার সেরা বন্দুক। অসাধারণ খেলছেন সুলেমানি...
লেন: দ্বিতীয় পর্বে ও এসেই সত্যিই অসাধারণ খেলছে। আমার দলের প্রাণ। গোল করেছে দলের সর্বোচ্চ ৭টি। সহায়তা করেছে অন্তত ১০টি। ও-ই আমার লড়াইয়ের মূল অস্ত্র।
প্রশ্ন: এই ক্লাবের কাছে একটা সময় রানার্সআপ হওয়াও ছিল অপরাধ। আবাহনীর সঙ্গে তাদের চিরকালের দ্বৈরথ। সেই আবাহনীকে ১৯৭৫ সালের পর এই প্রথম ৪-০ গোলের লজ্জা দিয়েছে মোহামেডান। আবাহনীকে হারানোর পর রাতটা নিশ্চয়ই একটু অন্য রকম ছিল?
লেন: অবশ্যই। আমরা জয়টা উপভোগ করেছি। তবে সত্যি বলতে কাকে হারালাম, সেটার চেয়ে বড় হচ্ছে, ৩টি পয়েন্ট জিতলাম। পয়েন্টটাই আসল। আবাহনীকে হারিয়ে নিশ্চয় আমি ৪ পয়েন্ট পাইনি, ৩ পয়েন্টই পেয়েছি। তারপরও সবার কাছেই শুনেছি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ছিল একসময় বাংলাদেশের ফুটবলের প্রাণ। সেই আবাহনীকে বছর চারেক পর লিগ ম্যাচে মোহামেডান হারাতে পেরেছে, এটা ভাবলেই ভালো লাগে। মোহামেডানকে কিছু দিতে পেরেছি, এটা ভাবলেও ভালো লাগছে। আমি খুশি।

প্রশ্ন: এমনিতে আপনি মোহামেডানে কেমন স্বাধীনতা ভোগ করছেন? সম্প্রতি কয়েকজন কোচ বলে গেছেন, ক্লাবটিতে স্বাধীনভাবে কাজ করা যায় না। টিম ম্যানেজমেন্টের এক কর্মকর্তা হস্তক্ষেপ করেন। আপনি এমন কিছু দেখছেন?
লেন: মাথা খারাপ! এমন কিছু হওয়ার সুযোগই নেই। কর্মকর্তা তাঁর কাজ করবেন, আমি আমার। আমি কারও কাজে হস্তক্ষেপ করি না। আমার কাজেও কেউ এখন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেনি। করলে পরদিনই আমি চলে যাব (হাসি)।

প্রশ্ন: মোহমেডানের একটা বদনাম আছে। টিম ম্যানেজমেন্ট ভালো না। টাকাপয়সা পায় না কোচ। এটা নেই, ওটা নেই। আপনি কী দেখছেন এখানে এসে?
লেন: এখন পর্যন্ত খারাপ কিছু দেখেনি। সব ঠিকঠাকই আছে। ক্লাবের কর্মকর্তা লোকমান সাহেব বেশ আন্তরিক। আবাহনীকে হারানোর পর নিজেই আমাকে ফোন করেছেন।
প্রশ্ন: সামনের পরিকল্পনা নিয়ে ক্লাব কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?
লেন: এখনো বলেনি। এখন আসলে খেলা বাকি আছে আরও তিনটি। পরের ম্যাচটাই নীলফামারীতে বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে। আমি সেই ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়েই এখন ব্যস্ত থাকব। ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্লাব নিশ্চয়ই ভাববে।

প্রশ্ন: আপনার নিজের কথা বলুন। জন্ম–বেড়ে ওঠা কোথায়?
লেন: আমি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্মেছি। ২৫ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাই। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় দুই দেশেরই পাসপোর্ট আছে। আমার স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ান। আমাদের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। কদিন আগে আমাদের মেয়েরা ও ওদের মা ঢাকায় ঘুরে গেছে। আমি ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ শুরুর আগে যে লিগ কাঠামো ছিল, সেটির অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেছি। ছিলাম স্ট্রাইকার। কোচ হিসেবে এটিই আমার প্রথম কোনো বিদেশি ক্লাব।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। সব মিলিয়ে ঢাকায় কেমন লাগছে? গৎবাঁধা উত্তর না, সত্যিটা বলুন?
লেন: এখানকার মানুষজন আন্তরিক। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে যখন রিকশায় চড়ে পাশেই আমার আবাস ফার্স হোটেলে যাই, লোকজন হ্যান্ডশেক করে। আবাহনীকে হারানোর পর সেদিন পাল্টানের (পল্টন) রাস্তায় বেশ বাহবা পেয়েছি। এটা খুব ভালো লেগেছ এবং লাগছে।