সৌম্য-মোসাদ্দেকদের তরুণ কাঁধ তৈরি তো?

মুশফিকদের কাঁধে সওয়ার হয়ে নয়, এবার ভার বইতে হবে মোস্তাফিজ সৌম্যদেরই। ফাইল ছবি
মুশফিকদের কাঁধে সওয়ার হয়ে নয়, এবার ভার বইতে হবে মোস্তাফিজ সৌম্যদেরই। ফাইল ছবি
>

২০২৩ বিশ্বকাপ প্রতিবেশী দেশ ভারতে। অনেকটা চেনা কন্ডিশনে ভালো করতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে? চার পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয়টি আজ। সাবেক ক্রিকেটার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন রানা আব্বাস

শুক্রবার শ্রীলঙ্কা সফরপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এলেন নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আর অন্তর্বর্তীকালীন কোচ খালেদ মাহমুদ। দুজনের সংবাদ সম্মেলনের বড় অংশ জুড়ে থাকল ২০২৩ বিশ্বকাপ। পরের বিশ্বকাপে ভালো করতে হলে আগামী চার বছরে বাংলাদেশকে কী করতে হবে—এ শীর্ষক একটা দীর্ঘ আলোচনাই যেন হয়ে গেল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ।

বিসিবির অন্যতম পরিচালক ও দলের ভারপ্রাপ্ত কোচ মাহমুদ জানালেন, পরের বিশ্বকাপ সামনে রেখে ‘মাস্টার প্ল্যান’ করছে বোর্ড। শুধু বিশ্বকাপই নয়, আগামী চার বছরে বাংলাদেশকে খেলতে হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ২০ ওভারের সংস্করণে আগামী বছর খেলতে হবে এশিয়া কাপও। ২০২১ সালে আছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। বড় বড় তিনটি টুর্নামেন্ট বাদে আছে ২০-এর অধিক দ্বিপক্ষীয় সিরিজ।

পরের বিশ্বকাপে ভালো করতে শুধু জাতীয় দলে চোখ নয়, বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা মনে করেন, বেশি গুরুত্ব দিতে হবে পাইপলাইনে, ‘চার বছর অনেক সময়। এ সময়ে বেশি জরুরি জাতীয় দলের চেয়ে জরুরি অনূর্ধ্ব-১৯ বা “এ” দলে মনোযোগ দেওয়া। আগামী চার বছরে ভালো করতে হলে এখান থেকে কিছু ক্রিকেটার বের করতে হবে। তারা যেন দলে থিতু হতে পারে, সে সুযোগও করে দিতে হবে। শুধু একটা দলের দিকে মনোযোগ থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করা কঠিন। এই সফরে ধরেন সাকিব নেই, তাঁর বিকল্প হিসেবে এখন দুজনকে খুঁজতে হচ্ছে। বিশ্বকাপে ভালো করতে হলে “এ” দল বা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আমাদের মনোযোগ দিতেই হবে।’

যেহেতু চার বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভীষণ ব্যস্ত থাকবে, চোটাঘাতে পড়বেন অনেক ক্রিকেটার। তাঁদের বিকল্প খেলোয়াড়ও তৈরি রাখতে হবে। শুধু চোটাঘাত নয়, একেকটি পজিশনের জন্য একাধিক ক্রিকেটার লড়াই করলেই না তবে একটা ভালো করার ইতিবাচক লড়াই তৈরি হবে সবার মধ্যে। সেরা একাদশের পছন্দের কেউ ফর্ম বা ইনজুরির কারণে বাইরে চলে গেলে যেন দ্রুত তাঁর বিকল্প তৈরিই থাকে।

ইংল্যান্ড যে ২০১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলো, গত চার বছরে তারা যে দীর্ঘ পরিকল্পনা করেছে সেটির ফল হিসেবেই ইংলিশদের এ সাফল্য। এ সময়ে জেসন রয়-জফরা আর্চারদের মতো দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার পেয়েছে। বেন স্টোকস-জস বাটলারদের মতো ক্রিকেটারদের ওয়ানডেতে থিতু হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। একেকটি পজিশনের জন্য লড়াই করেছেন একাধিক ক্রিকেটার।

নতুন ক্রিকেটার কেমন উঠে আসবেন আগামী চার বছরে, এখনই বলা কঠিন। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, মোস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন, সাব্বির রহমানদের মতো যাঁরা এখন ‘জুনিয়র’ আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠবেন। উদ্বেগটা হচ্ছে জুনিয়রদের পারফরম্যান্স। তাঁদের পারফরম্যান্স এতটাই ওঠা-নামা করে, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই আগামী চার বছর তাঁদের কাছে নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাওয়া যাবে। গত চারটা বিশ্বকাপে মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ যেভাবে ধারাবাহিক খেলে গেছেন, তরুণদের কাছে এই সেবাটা কেন পাওয়া যাবে না?

ঘরোয়া ক্রিকেটের সফল কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকেও ভাবাচ্ছে বিষয়টি, ‘মোস্তাফিজ-মিরাজ বোলার হিসেবে এ বিশ্বকাপে ভালো করছে। তবে ব্যাটসম্যানদের নিয়ে খুশি হওয়ার কিছু নেই। খুবই হতাশাজনক পারফরম্যান্স। অনেকে দুইটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে। নতুন ক্রিকেটার বলার উপায় নয়। আর কত দিন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের মুলা ঝুলিয়ে খেলবেন? অনেকে বলবে সাকিব-তামিম তো শুরুর দিকে এমন ছিল। কিন্তু তাদের ড্রেসিংরুমে বা তাদের সামনে এমন ক্রিকেটার ছিল না যে যাদের ছাপিয়ে যাওয়ার বিষয় ছিল। এখন সৌম্যদের তো সিনিয়র ক্রিকেটারদের ছাপিয়ে যাওয়া উচিত। সিনিয়রদের সমান বা তাদের চেয়েও ভালো যদি না করতে পারে বলতে হবে আমরা এগোচ্ছি না। ওদের সামনে বেঞ্চ মার্ক আছে, তাদের চেয়ে ভালো করতে না পারলে আসলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের ভালো কিছু করা কঠিন। এখনো সাকিব-তামিম-মুশফিকের চেয়েও ভালো ক্রিকেটার যদি না পাই তবে তো বলতে হবে আমাদের ক্রিকেট এগোল না।’

দলের জুনিয়র ক্রিকেটাররা কেন প্রত্যাশা অনুযায়ী ধারাবাহিক ভালো খেলতে পারেন না, সেটির ব্যাখ্যায় সাকিব-মুশফিকদের আরেক গুরু নাজমুল আবেদীন অনেকটা সালাউদ্দিনের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘ওরা বড়দের ছায়াতেই বড় হতে চায়। তারা কেন ভাবতে পারবে না মুশফিক-সাকিবের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার! বিরাট কোহলি যদি এটা না ভাবত সে এত বড় খেলোয়াড় হতে পারত না। আমাদের জুনিয়র ক্রিকেটাররা ভেবে নিয়েছে সাকিব-তামিমেরা বেঞ্চ মার্ক, ওদের ওপর যাওয়াই যাবে না। ওদের ছাপিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। নিজেদের মধ্যে তুলনা নয়, আমাদের উচিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিটি দলে যে দুর্দান্ত ক্রিকেটার আছে তাদের সঙ্গে তুলনা করা। তাদের তুলনায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি, কতটা চেষ্টা করলে তাদের মানে পৌঁছাব, এসব ভাবতে হবে। হঠাৎ একদিন সেঞ্চুরি করলেই ভালো ক্রিকেটার হওয়া যায় না। ধারাবাহিক হতে পারলে, ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় হতে পারলে, ধারাবাহিক দলকে জেতাতে পারলে তবেই আপনি ভালো খেলোয়াড়। এখানে সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। একজন একটু ভালো খেললে তাকে এমনভাবে তুলে ধরা হয় ওই ক্রিকেটারও ভেবে নেই সে অনেক দুর্দান্ত ক্রিকেটার বনে গেছে। তার ভক্ত-অনুসারী বেড়ে যায়। এই বিশ্বকাপ ছিল আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার মতো। এখানে বোঝা গেছে অন্যদের তুলনায় আমাদের দূরত্ব কতটুকু। এটা অনুধাবন না করতে পারলে খুব বেশি এগোতে পারব না।’

বিসিবির নির্বাচক হাবিবুল বাশার অবশ্য আশাবাদী চার বছরে ভালো কিছু ক্রিকেটার তাঁরা পেয়ে যাবেন, ‘চার সিনিয়র ক্রিকেটার তো আছেই। আশা করি, এই চার বছরে আমরা আরও ভালো কিছু ক্রিকেটার পাব। এইচপি, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে ভালো কিছু ক্রিকেটার পাব। তবে বুঝতে হবে, সিনিয়র যারা শুরু করেছিল তারাও কিন্তু ওভাবে পারফর্ম করতে পারেনি। তাদের সময় লেগেছে। আমরা প্রত্যাশা করি নতুন কেউ এলে সিনিয়রদের মতো ভালো খেলবে। এ সময়ে সৌম্য-মোস্তাফিজরা আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে। এর মধ্যে নতুন কিছু দুর্দান্ত ক্রিকেটার নিশ্চয়ই উঠে আসবে। আরেকটি বিষয় সাকিবের মতো ক্রিকেটার সব সময়ই তৈরি করা যায় না। জন্ম নিতে হয়। শ্রীলঙ্কায় মাহেলা-সাঙ্গাকারা চলে যাওয়ার পর দেখেন ওরা সেভাবে ক্রিকেটার তৈরি করতে পারেনি। একটু ভাগ্যের সহায়তা পেতে হয় এ ধরনের ক্রিকেটার পেতে। হয়তো আমাদের আশপাশে এ ধরনের ক্রিকেটার আছে, আশা করি আমরা খুঁজে বের করতে পারব।’

খুঁজে পাওয়ার এই প্রক্রিয়াটা বিসিবি কতটা সফলভাবে করতে পারে, সেটির দিকেও তাই চোখ থাকবে সবার।