তামিম-মুশফিককে নিয়ে যা বলেছিলেন প্রথম অধিনায়ক

>

আজ না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক শামিম কবির । বেশ কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। গত বছর প্রথম আলোর ক্রিকেট প্রতিবেদক রানা আব্বাস একটি সাক্ষাৎকারের জন্য দেখা করেছিলেন তাঁর সঙ্গে।

প্রথম অধিনায়ক শামিম কবিরের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় কী? তাঁর দুই উত্তরসূরি রকিবুল হাসান-শফিকুল হকের কাছে অভিন্ন উত্তর পাওয়া গেল—বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড)। বিসিবির কাছে তাঁর বাসার ঠিকানাটা পাওয়া গেল শুধু। মুঠোফোন নম্বর পাওয়া গেল আরেক সূত্রে।

গত বছরের কথা, মাস তিনেক হলো জাতীয় ক্রিকেট দলের সব অধিনায়ককে নিয়ে বই লেখার কাজ শুরু করেছি। বর্তমান-সাবেক, একে একে সব অধিনায়কের সঙ্গে বসা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। কিন্তু প্রথম অধিনায়কের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কীভাবে? বাসার ঠিকানা আর মুঠোফোন নম্বর পেয়ে যখন কিছুটা স্বস্তি কাজ করছে মনে, তখন জানা গেল শামিম কবির মোবাইল ফোনই ব্যবহার করেন না। বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হচ্ছেন তাঁর স্ত্রী নাজমা নেলী কবির। তিনিই জানালেন, শামিম কবির প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কারও সঙ্গে দেখা করা, কথা বলে নিষেধ। একটু সুস্থ হলে জানানো হবে, কখন সাক্ষাৎকার দেবেন।

কী এক অনিশ্চয়তা, একটু টেনশনও। বাংলাদেশ দলের প্রথম অধিনায়কের সঙ্গে তবে কি দেখা হবে না? দেখা না হলে যে বইটায় একটু অপূর্ণতা থেকে যাবে। অবশেষে শামিম কবিরের সাক্ষাৎকার পাওয়া গেল। ব্যবস্থা করে দিলেন তাঁর স্ত্রী নাজমা।

২০১৮ সালের ৩ মে শনিবার দুপুরে ইস্কাটন গার্ডেনে তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যখন দেখা, শুরুতে বুঝতে পারেননি তরুণ একজন প্রতিবেদক তাঁর সাক্ষাৎকার নেবেন। এ প্রতিবেদককে দেখে ভেবেছিলেন তাঁর অফিসের কেউ! অফিসের কাজকর্ম ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে একবার ধমকেও উঠলেন। পরে পরিচয় জেনে লাজুক হাসলেন। জীবনের গোধূলিতে এসে দাঁড়ানো অধিনায়কের স্মৃতিতে অনেক কিছু ঝাপসা হয়ে গেছে। তবুও প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব, থেমে থেমে শামিম কবির শুনিয়ে গেলেন ৪১ বছর আগের গল্প। প্রায় আধঘণ্টার সাক্ষাৎকারে ধীর কণ্ঠে তুলে ধরলেন চার দশক আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিত্র। কাঁপা হাতে দিলেন একটা অটোগ্রাফও।

১৯৭৫-৭৬ ঘরোয়া ক্রিকেটের মৌসুম শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সের (এখনকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি) কাছে আবেদন করল সহযোগী সদস্য পদ পেতে। ১৯৭৬ সালের জুনে আইসিসির সভায় ওঠে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি। আইসিসি বিসিসিবিকে পরামর্শ দিল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবকে (এমসিসি) আমন্ত্রণ করতে। এমসিসির ট্যুর রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে আইসিসির সিদ্ধান্ত। তখন বিসিসিবি আমন্ত্রণ জানাল এমসিসিকে। বিসিসিবির ধারাবাহিক যোগাযোগে এমসিসি বাংলাদেশে এল ১৯৭৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বিসিসিবি দলকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করল। ১৫ দিনের সফরে আসা এমসিসি শুরুতে দুই দিনের দুটি ম্যাচ খেলল উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বিপক্ষে। ১৯৭৭ সালের ৭, ৮ ও ৯ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখনকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) বিসিসিবির যে দলটি এমসিসির বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচ খেলল, সেটির অধিনায়ক করা হলো শামিম কবিরকে। এ ম্যাচটিই বাংলাদেশ দলের প্রথম ম্যাচ। তখনকার পত্রপত্রিকায় লেখা হলো, বাংলাদেশের প্রথম ‘আনঅফিশিয়াল টেস্ট ম্যাচ’।

এই ম্যাচ নিয়ে কতটা রোমাঞ্চিত ছিলেন, কতটা স্নায়ুচাপে ভুগেছেন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা, সেই স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন শামিম কবির, ‘যারা নতুন এল জাতীয় দলে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা যেভাবে ঘরোয়া লিগ বা কায়েদা আজম ট্রফি খেলেছি, ওভাবেই খেলব। নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটাই খেলব।’

বাংলাদেশ দলের প্রথম অধিনায়ক শামিম কবির চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ দলের প্রথম অধিনায়ক শামিম কবির চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ছবি: প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রথমবারের মতো খেলা, বাংলাদেশ অধিনায়কের সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি ছিল? শামিম কবির সেটিও বলছিলেন, ‘কঠিন কাজ ছিল না হারাটা। আমি অধিনায়ক ছিলাম আজাদ বয়েজে। তবে জাতীয় দলের দায়িত্ব অনেক বড়। মাঠের সব সিদ্ধান্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিতাম। এতে সতীর্থদের মনোবল অনেক চাঙা থাকত।’

অনুজ সতীর্থদের সুযোগ করে দিতে এমসিসির ম্যাচ শেষেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন শামিম কবির। তাঁর অধিনায়কত্ব পাওয়াটাও ছিল বেশ চমকে দেওয়ার মতো। তত দিনে যে খেলা প্রায়ই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। যেভাবেই অধিনায়কত্ব পান, বাংলাদেশ ক্রিকেট শ্রদ্ধাভরে তাঁকে মনে রাখবে। তিনিই যে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক। অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর কখনো বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার, কখনো বিসিবির নানা কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছেন।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে ক্রিকেটের সঙ্গে শেষ দিকে আর জড়িয়ে থাকতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ দলের সব খোঁজখবর তিনি নিতেন। মাঝেমধ্যে স্টেডিয়ামে আসতেন। দেশের এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে মুশফিকুর রহিম আর তামিম ইকবালের খেলা তাঁর ভীষণ ভালো লাগত। দুজনকে নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন ছিল এ রকম, ‘মুশফিক কিপিংয়ের সঙ্গে অসাধারণ ব্যাটিং করে। তামিমও ভালো, তবে সে একটু বেশি চাপ নিয়ে ফেলে।’

গত ফেব্রুয়ারিতে ‘বাংলাদেশের অধিনায়ক’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তাঁকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হলো, হাসিমুখেই সেটি গ্রহণ করলেন। ভীষণ শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে সবার আগে চলে এলেন অনুষ্ঠানে। অনুজ সতীর্থদের একটু দেরিতে আসায় ধমকের সুরে জানতে চাইলেন, ‘কী রে তোদের এত দেরি হলো কেন?’ এ প্রশ্নে গাজী আশরাফের উত্তরটা বেশ মনে পড়ে, ‘আপনি ক্যাপ্টেন, আপনিই তো আগে থাকবেন, আগে আসবেন।’

ক্যাপ্টেন আগে থাকবেন—এ রীতি মেনেই কি বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে তিনিই সবার আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন?