ইরানকে 'না' করে দিল বাংলাদেশ!

ইরানের প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন! ছবি: রয়টার্স
ইরানের প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন! ছবি: রয়টার্স
>

১০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশ শুরু করছে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের মিশন। কিন্তু মূল লড়াইয়ের আগে ৫ সেপ্টেম্বর একাধিকবার বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধি ইরানের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব ছিল। বাফুফে সেটি ‘না’ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্তটা আশাহত করেছে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের।

গত সপ্তাহে একটা সংবাদে ফুটবলপ্রেমীদের মন আনন্দে নেচে উঠেছিল। ফুটবলে এশিয়ার অন্যতম সেরা দল ইরান বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে চায়। বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব সামনে রেখে তারা আয়োজন করতে চেয়েছিল একটি প্রীতি ম্যাচ। কাতারের দোহায় আগামী ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় সে ম্যাচ প্রতিপক্ষ হিসেবে ইরানের পছন্দ ছিল বাংলাদেশকে।

১৯৮৯ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ শেষবারের মতো ইরানের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল। এরপর ৩০ বছর কেটে গেছে, ইরানের মতো দলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর খেলার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের। ইরানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের খবরে স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত ছিল বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। ইরান অসম্ভব শক্তিশালী দল, কোনো অঘটন না হলে বিশাল ব্যবধানে হারই বাংলাদেশের ভবিতব্য, সবকিছু মেনে নিয়েই ইরানের বিপক্ষে ম্যাচটিকে ফুটবলপ্রেমীরা দেখছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলারদের জন্য এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হিসেবে। অনেকেই ম্যাচটিকে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বিশ্বকাপ বাছাই-মিশনের দুর্দান্ত প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।

কিন্তু বিধি বাম! ইরানের প্রীতি ম্যাচের সেই প্রস্তাব নাকি ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। দেশের বিজ্ঞ ফুটবল সংগঠকেরা মনে করেন, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে মাঠে নামার আগে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে একাধিকবার খেলা একটি দলের বিপক্ষে খেললে বাংলাদেশের ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। ম্যাচটিতে বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হারবে এবং সেই হার খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে এমনই বিধ্বস্ত করে দেবে যে তার প্রভাব পড়বে আমাদের বিশ্বকাপ বাছাই মিশনে। উল্লেখ্য, এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে গ্রুপ ‘ই’তে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কাতার, ওমান, ভারত ও আফগানিস্তান। ১০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচ দিয়ে শুরু সে অভিযান। যত দূর খবর, ম্যাচটি নিরপেক্ষ ভেন্যু কাতারে হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

ফুটবল ফেডারেশন আরও একটি কারণ দেখিয়েছে, সেটি হচ্ছে ফিফা র‌্যাঙ্কিং! বাফুফে নাকি বাংলাদেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের উন্নতিতে কাজ করে যাচ্ছে। আর ইরানের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলে আমাদের র‌্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি হবে না। বরং আরও পিছিয়ে পড়ব আমরা। ইরানের মতো দলের বিপক্ষে খেলার চাইতে, প্রায় সম শক্তির দল দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলাকেই ‘বুদ্ধিমানের কাজ’ মনে করে আমাদের ফুটবল ফেডারেশন।

আগেই বলেছি, বাফুফে বিজ্ঞ সংগঠন। তারা দেশের ফুটবলের ভালো বই খারাপ চায় না। ইরানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে নামলে তাদের কুশলী ফুটবলারদের কাছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হেনস্তা হওয়াটা মোটেও শোভন হবে না বলেই তারা ইরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ইরানের বিপক্ষে খেলার চাইতে কাতার বা থাইল্যান্ডের কোনো দ্বিতীয় সারির ক্লাব দলের বিপক্ষে দাপটের সঙ্গে খেলে জয়-টয় তুলে নিয়ে উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মিশন শুরু করাটাই তারা শ্রেয় মনে করেছেন। জাতীয় দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেললেও সেগুলো যেন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল হয়, সে ব্যাপারে তারা সচেষ্ট থাকবেন বলেই জানিয়ে রেখেছেন তারা।

আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের ভাবনটা যতই ‘বিজ্ঞ’ হোক, ইরানের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েও না খেলার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছেন না ফুটবলপ্রেমীরা। বাফুফে কর্তারা যেখানে নিজেরাই বলেন, ব্যস্ত সূচির কারণে মোটামুটি শক্তিশালী দেশের বিপক্ষেও আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে ইরানের মতো এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের একটি দল যখন যেচে এসে বাংলাদেশকে ম্যাচ খেলার কথা বলল, সেটি গ্রহণ না করাকে বোকামিই মনে হচ্ছে। আমরা না হয় ম্যাচটি হারতাম, হয়তো ৭-৮ গোল হজম করতাম, কিন্তু ইরানের সঙ্গে ম্যাচ খেলে আমাদের ফুটবলাররা যে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন, সেটা না বললেও চলছে। বাংলাদেশ বিগত দিনে অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে, কিন্তু ২০১৫ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাকে নিঃসন্দেহে এগিয়ে রাখবেন মামুনুল ইসলাম-জামাল ভূঁইয়ারা। এবার ইরানি পত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যখন ইরানের বিপক্ষে ম্যাচটির সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছিল, তখন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা যে প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন, সেটা বলার জন্য বিশেষ কিছু হতে হয় না। এ ম্যাচ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে যে সবাই হতাশ, সেটা না বললেও চলছে।

চিন্তাভাবনার দৈন্যই বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ সমস্যা অতীতেও ছিল, এখনো তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইদানীং মানের পার্থক্য হয়ে যাওয়াতে ভারত, মালদ্বীপও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। আফগানিস্তান তো সাফ থেকেই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো সাফেই পড়ে আছি। দৃষ্টি প্রসারিত না করলে ফুটবল নিয়ে মানুষের তাও যা কিছু আগ্রহ অবশিষ্ট আছে, সেটাও ভবিষ্যতে থাকবে না। ইরানের বিপক্ষে ম্যাচটি হলে সেটিতে হয়তো আমরা হারতাম, কিন্তু মানুষের মধ্যে ফুটবল নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হতো। কে জানে একটু ভালো খেললে, একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুললে ফুটবল হয়তো নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারত।

বাফুফে সভাপতি প্রায়ই বলেন খেলা হিসেবে ক্রিকেটের সঙ্গে ফুটবলের কোনো তুলনাই হয় না। কিন্তু আমরা মনে করি বাফুফের উচিত দেশের ক্রিকেটের দিকে একটু হলেও চোখ ফেরানো। ক্রিকেট আহামরি অবস্থানে চলে গেছে, এটা হয়তো কেউই স্বীকার করবে না। কিন্তু এটা তো ঠিক, ক্রিকেট নিয়ে দেশের মানুষ ভাবে। এর সবচেয়ে বড় কারণ, ক্রিকেট দেশের মানুষকে মাঝেমধ্যেই সাফল্য উপহার দেয়। ক্রিকেট মাঝেমধ্যেই বড় দলগুলোকে হারিয়ে দেয়। হাসি-আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয় ক্রীড়াপ্রেমীদের। ক্রিকেটের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলা হচ্ছে এ কারণে যে একটা সময় জাতীয় ক্রিকেট দলের কাছে হারই ছিল নিত্যসঙ্গী। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত টানা ৪৭টি ম্যাচে জাতীয় ক্রিকেট দল হেরেছিল। এ সময়ের মধ্যে খেলা ৭৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ৭১টিতেই বাংলাদেশ হেরেছিল বড় ব্যবধানে। হারতে হারতেই ক্রিকেট এক সময় চমক দেখানো শুরু করেছে। হারারা তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকেই নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি বানিয়েছে ক্রিকেট। ফুটবলে আমরা হারব—এটা দেশের মানুষ মাত্রই জানে, বোঝে, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, উজবেকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাতের মতো দলগুলোর সঙ্গে আমরা যদি ১০টি ম্যাচ খেলি, তাহলে ১০টিতেই আমরা বড় ব্যবধানে হারব। কিন্তু নিয়মিত খেলতে খেলতে আমরা এই হারের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দলগুলোর সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলব। প্রথম ও দ্বিতীয় সারির দলগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি খেলার পর বাফুফের প্রিয় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা সাফল্য পাব। এভাবেই ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যাবে আমাদের ফুটবল। কিন্তু বাফুফে এ লাইনে কেন ভাবে না—সেটি সত্যিই বোধগম্য নয় এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে।

ইরানের বিপক্ষে না খেললেও বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে আছে এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন কাতার। গত বছর এশিয়ান গেমসে তাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে হারানোর পর বাফুফে মনে করছে দলটা বুঝি আমাদের নাগালের মধ্যেই। কিন্তু তাদের জাতীয় দলের সঙ্গে আমরা যখন খেলব, তখন পরিস্থিতি যে পুরোপুরি ভিন্ন থাকবে, সেটা অনুভবের বিষয়। গ্রুপে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দল ওমানও দল হিসেবে কম শক্তিশালী নয়। ভারত আমাদের সমশক্তির দল নয়, বহু দিন। তারাও সম্প্রতি এশিয়ান কাপ খেলেছে এবং সেখানে দুর্দান্ত পারফরম করেছে। থাইল্যান্ডের মতো দলকে তারা ৪-১ গোলে হারিয়েছে। যেটি বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য দিবাস্বপ্নই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা ৪-০ গোলে হেরেছি। সুতরাং, প্রস্তুতিটা ঠিকঠাক না নিলে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরীক্ষাই অপেক্ষা করে আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ইরানের প্রস্তাবটি ছিল হাত দিয়ে চাঁদ ছোঁয়ার মতোই ব্যাপার। ইরানের বিপক্ষে না হয় আমরা ১০ গোলই খেতাম, কিন্তু এ ম্যাচটি দিয়ে কোচ জেমি ডে দলের ফাঁকফোকরগুলোর খোঁজ পেয়ে যেতেন, যেটি কম্বোডিয়া, লাওস কিংবা নেপাল, ভুটানের সঙ্গে খেললে পাবেন না। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কৌশল ঠিক করা যেত কাতার, ওমানের বিপক্ষে। ইরানের সঙ্গে খেলার পর ভারত, আফগানিস্তানও আমাদের কাছে অনেক সহজ প্রতিপক্ষ মনে হতো!
ইরানের বিপক্ষে না খেলা বাফুফের আরও একটি বাজে সিদ্ধান্ত—এটা জোর গলায় বলতেই হচ্ছে।