চার বছরে কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ?

চার বছরের ব্যবধানে দুই সৌম্য। এটাই যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিত্র। ফাইল ছবি
চার বছরের ব্যবধানে দুই সৌম্য। এটাই যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিত্র। ফাইল ছবি
>

২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপ—এই চার বছরে কতটুকু এগোল বাংলাদেশ? ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিং বলবে দুই ধাপ। ২০১৫ বিশ্বকাপ শেষে নয়ে থাকা বাংলাদেশ গত চার বছরে সাতকেই নিজেদের অবস্থান বানিয়ে নিয়েছে। আসলেই কি বাংলাদেশের উন্নতি এমন স্থায়ী রূপ পেয়েছে?

সময়টা খুব কম নয়, চার বছরেরও বেশি। ২০১৫ বিশ্বকাপ শেষে এমনই এক ওয়ানডে সিরিজ খেলছিল বাংলাদেশে। সে সিরিজেও প্রথম দুই ওয়ানডে মাত্র এক দিনের বিরতিতে খেলেছিল দল। তৃতীয় ওয়ানডের আগেই শুধু মিলেছিল বাড়তি এক দিনের বিশ্রাম। সে বিশ্রামের দিনটিতেই বারবার আলোচিত হচ্ছিল একটি শব্দ, ধবলধোলাই।

একদম কার্বন কপি না হোক ছাপ ফেলার মতো করেই সে পথে হাঁটছে ২০১৯ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ। কিন্তু চার বছর পর অবস্থা বদলেছে বাংলাদেশের। সেবার সফল এক বিশ্বকাপ শেষে নিজেদের মাঠে পাকিস্তানকে ধবলধোলাইয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিল পুরো দল, পুরো দেশ। এবার ব্যর্থ বিশ্বকাপ শেষে নিজেদের প্রথম সিরিজে উল্টো ধবলধোলাইয়ের পথে দল।

অন্তত একটি মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এই ভিন্ন যাত্রায়। সেবার দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি দিয়ে সিরিজ শুরু করে পরের ম্যাচেও ফিফটি পেয়েছিলেন মুশফিকুর। শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের রান পর্যাপ্ত না হওয়ায় একটুর জন্য ফিফটি ছুঁতে পারেননি। এবার তৃতীয় ম্যাচে কী করবেন সেটা জানা যাবে কালই। তবে এখন পর্যন্ত একটি প্রায় সেঞ্চুরি ও ফিফটিতে ফর্মেই আছেন মুশফিক। বিস্ময়কর হলো, সে সিরিজের ফর্মের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে মাহমুদউল্লাহর মাঝেও। সে সিরিজে তিন ম্যাচে ২৬ করা মাহমুদউল্লাহ এবার দুই ম্যাচে ৯ রান করেছেন।

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সে সিরিজের সঙ্গে মিল এখানেই শেষ। সে সিরিজসেরা হয়েছিলেন দুই সেঞ্চুরি করা তামিম। ব্যাট হাতে খুব বেশি করতে না হলেও ভরসা হয়েছিলেন সাকিব। মাশরাফিও ছিলেন বোলারদের নেতৃত্বে। একঝাঁক তরুণ খেলোয়াড়ে প্রাণচঞ্চল এক দল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তাদের পোস্টার বয় সৌম্য দারুণ খেলেছেন সে সিরিজে। অবিশ্বাস্য প্রতাপে অপরাজিত এক সেঞ্চুরি করেছিলেন পাকিস্তানকে ধবলধোলাই উপহার দেওয়ার মুহূর্তে। সেই সৌম্যকে কিনা এবার দেখাচ্ছে অসহায়, ‘সবাই খুব চিন্তিত, কেন এমন হচ্ছে। আমরা সবাই সব সময় কথা বলছি, সবার সঙ্গে কথা বলছি। আরও কী করলে ভালো হবে।’

ভালো হওয়ার পথ মুশফিকই বাতলে দিতে পারেন। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে অসহায় আত্মসমর্পণ করার পর মুশফিক সবাইকে গত চার বছরের অর্জিত সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ দল যে আসলে ভালো দল, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। সে সুরে সৌম্যও জানিয়েছেন, তারা আসলে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো দল। তবু কেন এভাবে হারতে হবে দলকে? উত্তর মুশফিকই দিয়েছেন, ‘ব্যাট, বল ও ফিল্ডিং—কোথাও ভালো করিনি আমরা। শ্রীলঙ্কা অসাধারণ খেলেনি, স্বাভাবিক খেলাই খেলেছে।’

যে শ্রীলঙ্কা সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনের বিদায়ের ধাক্কা চার বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, যারা তাদের একমাত্র মহাতারকাকে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই বিদায় বলে দিয়েছে, তাদের স্বাভাবিক খেলাই এখন বাংলাদেশের হাতের নাগালে ঠেকছে না। বাংলাদেশ দল নিশ্চয়ই এতটা খারাপ দল হয়ে যায়নি! চার বছর আগের দলটিই তো খেলছে এখনো। চার বছরের বাড়তি অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ দলটির তো এই শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা।

২০১৫ সালে পাকিস্তান সিরিজে বাংলাদেশের বোলিং লাইন আপকে বলা হচ্ছিল এশিয়ার অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণ। টগবগে তাসকিন, গতির ঝড় তোলা রুবেল আর মাশরাফির পেস আক্রমণ। ভারতের বিপক্ষে মোস্তাফিজের আবির্ভাবের ফলে চার পেসার খেলানোর মতো অসাধারণ এক ব্যাপারও দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সে সঙ্গে সাকিব ও আরাফাত সানির দুই ধরনের বাঁহাতি স্পিন। সঙ্গে নাসিরের অফ স্পিনও যে কার্যকর হয়ে উঠেছিল।

মাশরাফি এ সিরিজে আসেননি, তাতে খুব একটা এদিক-ওদিক হচ্ছে না। বিশ্বকাপে বরং মাশরাফির বোলিং পারফরম্যান্স নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হওয়া তাসকিন এখন সাইড বেঞ্চেই থাকেন, রুবেলও টানা দুই ম্যাচ স্কোয়াডে থাকার সম্ভাবনা জাগাতে পারেন না। একসময়ের বিস্ময় মোস্তাফিজের কাটার এখনো কাজ করে, তবে সেটা বড় দীর্ঘ বিরতিতে। এমন অবস্থায় তিন বছর পর ওয়ানডে দলে ফিরেছেন শফিউল।

গত চার বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট সেরা সময় কাটিয়েছে।একটি প্রজন্মের সেরা সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রতিভাবান সব তরুণের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে গুছিয়ে উঠেছিল দলটি। ২০১৯ বিশ্বকাপ ঘিরে তাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল সবাই। কিন্তু অভিজ্ঞতার স্বাদে তৃপ্ত দলের মোহে ২০১৫ সালের সাফল্যের রেসিপিটা ভুলে গিয়েছেন সবাই। সে দলে অভিজ্ঞ পাঁচজনের সঙ্গে একদমই নতুন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সৌম্য, সাব্বির, তাসকিনরা। এ দুই গ্রুপের মধ্যবর্তী একটি অংশ হিসেবে নাসির, রুবেল ও সানিরাও ছিলেন দলে।

বিস্ময়কর হলো, এখনো যখন দলে তরুণদের পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলা হয়, সেখানে সাব্বির, সৌম্য ও তাসকিনদেরই কথা বলা হয়। বাংলাদেশ দলে সর্বশেষ যে দুজন তরুণ এসেছেন, মিরাজ-সাইফউদ্দিনেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা তিন বছর। এঁদেরই এখন মধ্যবর্তী অংশ হিসেবে থাকার কথা ছিল। একসময় তরুণদের বেশি দ্রুত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আনার অভিযোগে দুষ্ট দলটি একটি বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরও ইয়াসির আলী, এবাদত কিংবা আফিফদের সুযোগ দেয়নি শ্রীলঙ্কা সিরিজে। খেলোয়াড় সংকটে পড়ায় ডেকে আনা হয়েছে ফরহাদ রেজাকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই অলরাউন্ডারের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায় নেই, কিন্তু দলের নির্বাচক কিংবা ম্যানেজার কাম কোচই তো বলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তফাত অনেক। নিজেদের যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে ৮ বছর আগে শেষ ওয়ানডে খেলা একজনকে ফিরিয়ে আনা কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? ডেভেলপমেন্ট দল ও ‘এ’ দল ছেঁকেও সাইফউদ্দিনের একজন বিকল্প পায়নি দল। সাকিব-মাশরাফিদের বিকল্পের কথা আরও অনেক দূরের পথ। গত চার বছরে কোনো পাইপলাইন কি সৃষ্টি করতে পেরেছে বাংলাদেশ?

সাফল্য ভরা চার বছর শেষে হতাশার এক বিশ্বকাপ। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বড় ভালো সময়ই বেছে নিয়েছেন সাকিব। তাঁর বিশ্রামটা ভালো একটা শিক্ষা দিল বাংলাদেশকে। সাকিব নামের ছাতা সরে যেতেই নানা ফুটো ধরা পরে গেছে। এই সিরিজের শেষ ম্যাচে জয় হয়তো ক্ষণিকের জন্য আড়ালে ফেলে দিতে পারে সেটা, কিন্তু ভুলেও ভাববেন না সমস্যা সব দূর হয়ে গেছে। ২০২৩ বিশ্বকাপে দর্শক বনতে না চাইলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতেই হবে।