সৌম্য-সাব্বিররা সাকিব-মুশফিক হয়ে উঠবেন কবে?
‘আমরা শুরুতে কেউই বীর পালোয়ান ছিলাম না’—হাসির ছলে ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ চলাকালে এমন কথা বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। আসলেই, বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের অনেকেই ক্যারিয়ারের শুরুতে ধারাবাহিক ছিলেন না। সাকিব বাদে বাকিরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে ৫-৬ বছর সময় নিয়েছেন। তবে নির্বাচকেরা ধৈর্য ধরেছেন, আস্থা রেখেছেন। আস্থার প্রতিদানও দিচ্ছেন মুশফিকরা। অপেক্ষাকৃত তরুণ সৌম্য-সাব্বিরদেরও সময় দিতে হচ্ছে, যেমনটা দিতে হয়েছে মুশফিকদের। বিশ্বকাপ ও শ্রীলঙ্কা সফরের ব্যর্থতার পরও নির্বাচকেরা জানালেন, এই প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়াবেন না। এখন সৌম্য-সাব্বিররা কবে ধারাবাহিক হবেন, সেই অপেক্ষা।
প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের ভাবনা, ‘এই প্রক্রিয়া তো থাকতে হবে। একটা ছেলের যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করার সামর্থ্য থাকে, সেই ছেলেকে একটা সময় পর্যন্ত সুযোগ দিতে হবে। ব্যর্থ হলেও দিতে হবে। আপনি যদি আনা-নেওয়ার মধ্যে রাখেন খেলোয়াড়কে, তাহলে তো খেলোয়াড় গড়বে না।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের নিয়মিত মুখদের সিংহভাগ ক্রিকেটারের অভিষেক হয়েছে সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের সময়ে। প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের সুযোগ দিয়েছেন সাবেক এই অধিনায়ক। পরে যোগ দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। এরাই পরবর্তী সময়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে জাতীয় দলে খেলছেন, বিশ্বসেরাদের কাতারে পৌঁছে গেছেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদ, সাব্বির রহমান, তাইজুল ইসলাম, মোহাম্মদ মিঠুনদের সুযোগ দিয়েছে ফারুক আহমেদের কমিটি। দুই মেয়াদেই সম্ভাব্য সেরা প্রতিভাদের সুযোগ করে দিয়েছেন ফারুক। এঁরাই বর্তমানে বিভিন্ন সংস্করণে জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ।
প্রতিভা জাতীয় দল পর্যন্ত জায়গা করে দিচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিভাকে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে রূপ দিতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। মুশফিকুর রহিমের কথাই ধরুন, তাঁর ক্যারিয়ারকে সহজেই দুই পর্বে ভাগ করা যায়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে মুশফিকের গড় ছিল ২৬.৩৩, স্ট্রাইক রেট ৬৮.১৪। ২০১৪ থেকে ২০১৯—এই ছয় বছরে মুশফিকের ব্যাটিং গড় ৪৮.৬৮, স্ট্রাইক রেট ৮৮.৫৩; যা মুশফিককে বিশ্বসেরাদের কাতারে পৌঁছে দিয়েছে। টেস্টেও গল্পটা একই রকম। ২০১৩ পর্যন্ত ৩২.৪৬ গড়ে রান করেছেন, ৬ বছর পর গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৫৬। টি-টোয়েন্টির গড়টা ১৮.৩৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০.৯১ এ, ১১৭.৩৭ থেকে বেড়ে ১২০.০৯ হয়েছে মুশফিকের স্ট্রাইক রেট।
২০১৪ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের গড় ছিল ২৯.৮৫ স্ট্রাইক রেট ৭৭.৫৫। ২০১৫ সাল থেকে আবার তামিমের ব্যাটিংয়ে আমূল পরিবর্তন। ৪৭.৮৮ গড় ও ৭৭.৯৯ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন গত সাড়ে চার বছরে। টেস্ট ক্রিকেটের গড়টা ২০১৪ সালের আগে ছিল ৩৮.০৯, ২০১৫ সালের পর গড় ৪০ এর ঘরে নিয়ে গেছেন তামিম। আর টি-টোয়েন্টিটা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছেন তামিম। ২০১৫ পর্যন্ত ২০ ওভারের ক্রিকেটে তামিম ২১.২৭ গড় ও ১০৬.২০ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন। এরপর গড় (২৪.৬২) ও স্ট্রাইক রেটে (১২৬.১৭) বেড়েছে তামিমের।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ফিনিশারের দায়িত্ব পালন করে আসা মাহমুদউল্লাহর ওয়ানডে স্ট্রাইক রেটে বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে ৩৩.২৫ গড় ও ৭২.৪৩ স্ট্রাইক রেট ছিল মাহমুদউল্লাহর। ২০১৩ সালের পর পরিসংখ্যানটা অনেক ঝলমলে। সর্বশেষ সাড়ে পাঁচ বছরে ওয়ানডেতে মাহমুদউল্লাহর গড় ৩৪.৩৬, স্ট্রাইক রেট ৮০.২৭ । টেস্টেও বড় লাফ দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। ২০১৩ সাল পর্যন্ত গড় ছিল ২৭.৯০, ২০১৩ সালের পর মাহমুদউল্লাহর গড় ৩৬.৫৩। তবে টি-টোয়েন্টিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে মাহমুদউল্লাহর ক্রিকেটে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত গড় ছিল ১৩.৬০, স্ট্রাইক রেট ১০০.০০, ২০১৪ সালের পর গত সাড়ে পাঁচ বছরে সেই মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং গড় ৩০.২৫, স্ট্রাইক রেট ১৩১.৯২।
সিনিয়রদের মধ্যে সাকিব আল হাসান আবার ব্যতিক্রম। ক্যারিয়ারজুড়ে খুব বেশি বাজে সময় পার করতে হয়নি তাঁকে। পুরো ক্যারিয়ারেই প্রায় একই রকম ধারাবাহিক।
ফারুক আহমেদ এই চার ক্রিকেটারকে তরুণ অবস্থায় দেখেছেন। তবে সবাই এত বড় ক্রিকেটার হয়ে উঠবেন, সেটা চিন্তাও করেননি, ‘ওদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিভা ছিল। সেটার ফল পাচ্ছে, এতটা চিন্তা করিনি যে এত বড় প্লেয়ার হবে। ভালো লাগে, আমরা ঠিক ক্রিকেটারকে সুযোগ দিয়েছি এবং ওরা লম্বা সময়ের জন্য খেলছে।’
মুশফিক-তামিমদের মতোই ক্যারিয়ারের একই জংশনে আছেন সৌম্য সরকার, লিটন দাস ও সাব্বির রহমানরা। নতুনদের মধ্যে আবার ভিন্ন মোস্তাফিজুর রহমান, তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতেই যথেষ্ট ধারাবাহিক। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে সৌম্য, লিটন ও সাব্বিরদের। সাব্বির ও সৌম্য ইতিমধ্যে দুটি বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন, লিটন খেলেছেন একটি। পাঁচ বছর ধরে বিনিয়োগের প্রতিদান দেওয়ার এখনই সময়।